রেশমি সফর রেশম পথে
কাকলি সরকার (নীপা)
##
ঠিক সকাল ছটায় আমরা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠলাম। প্রতিদিনের ঘরকন্যা, কর্মব্যস্ততা, টেনশন আর অজস্র চিন্তার মায়াজাল কাটিয়ে, রবীন্দ্রনাথের খোয়াই নদী অতিক্রম করে, ছায়া সুনিবিড় পলাশরাঙা লালমাটির শান্তিনিকেতনকে পাশ কাটিয়ে আমাদের ট্রেন যখন নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছল তখন সন্ধে হব হব। অন্ধকার শহরটাকে ক্রমশ আড়াল করতে শুরু করেছে। দূরে তখনও পাহাড় প্রকৃতির আবছায়া আলেখ্য। যেন কোন শিল্পীর তুলির মায়াবী আঁচড়। এখানে একটু জলখাবার খেয়ে উঠে পড়লাম পাহাড় থেকে আসা বোলেরো গাড়িটিতে। দুপাশে গভীর অন্ধকার, পাহাড়ি পথ। দূরে বাড়িগুলিকে দেখলে মনে হয় অন্ধকারে জেগে ওঠা জোনাকি যেন। সোজা চলবার উপায় নেই। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকগুলি যেন অষ্টাবক্র মুনিকেও হার মানায়। দুর্গম অরণ্য প্রকৃতি, আশ্চর্য মানুষের অধ্যবসায়। পাথরের ধাপ কেটে কেটে সুনিপুন ভাবে তৈরি হয়েছে এই রাস্তা। অসংখ্য নাম না জানা গাছ আর ফুলের সমারোহ। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় সবটা দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মত অল্পে সমগ্রতা উপলব্ধি করা যায়। চাতক পাখির মত চারিদিক চেয়ে চেয়ে অন্ধকারের গভীরতা চিরে একসময় পৌঁছে গেলাম সিলেরি গাঁও। রাত তখন দুটো প্রায়। ওই গভীর রাতেও পাহাড়ি মানুষগুলি আমাদের স্বাগত জানিয়ে গরম গরম খাবার পরিবেশন করল। গভীর রাত, গা ছমছমে পরিবেশ, আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি আর সুদূরের পিপাসা আবারিত নিঃস্বর্গ সৌন্দর্যতৃষ্ণা নিয়ে আমরা সেখানেই রাত্রিবাস করলাম। মেইন রোড থেকে ৬ কিলোমিটার গ্রামের কাঁচা রাস্তা অতিক্রম করে এই ছোট্ট গ্রামটিতে তখন (আজ থেকে সাত বছর আগে) বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। মাত্র ১৫১ জন লোকের বাস। চার দিকে ওক্ আর পাইন গাছের জঙ্গল। আধুনিক সভ্যতার করাল দৃষ্টি থেকে একেবারে মুক্ত। এই পাহাড়ি অরণ্য যেন প্রকৃতির মানসপুত্র। এখানে পথের দু’ধারে পাহাড়ি পাইন আর দেবদারুর রহস্য সারাক্ষণ ছায়া ফেলে। আকাশ কখনও স্বর্ণমণ্ডিত কখনও বা মেঘমদির। প্রকৃতি যেন এক দীর্ঘ শান্ত সুষমামণ্ডিত। বিভূতিভূষণের রাজু পাঁড়ের কথা মনে পড়ে যায়, অরণ্য প্রকৃতিকে নির্মুল করে চাষের জমি প্রস্তুত করাকে যে অপরাধ মনে করত, তার ধারণা ছিল এই অরণ্যভূমি দেবতাদের বিচরণ ক্ষেত্র। তাদের মনোরঞ্জনের জন্যই এত ফুলের সমারোহ। যেন কোন অপ্সরীর স্বহস্তে রচিত নন্দন কানন।
এখানকার মানুষজনের জীবনযাত্রা আচার আচরণ রাজু পাঁড়ে, গনু মেহেতা, ছিরুপালকেও (আরণ্যকের চরিত্র) হার মানায়। এদের জানতে গেলে বুঝতে গেলে আরও কয়েকশো বছর পিছিয়ে যেতে হয়। স্কোয়াশ, বুনো মুরগী, ইয়াক বা শূকরের মাংস এদের প্রধান খাদ্য। খাবার এখানে কমই সিদ্ধ হয়। পাহাড়ি মেয়েরা পিঠে ঝুড়ি বেঁধে কাঠ কেটে আনে জঙ্গল থেকে। তা দিয়ে জ্বাল দেওয়া হয় গরুর খাঁটি দুধ, তৈরি হয় মোমো। সূর্যদেব চোখ বুজলেই এখানে নেমে আসে গভীর রহস্যময় অন্ধকার। ল্যাম্পের আলোয় ভুত – পেত্নী আর চিতাবাঘের গৃহপালিত পশু ধরে নিয়ে যাওয়ার কাহিনী – টারবারো বা বুনো মহিষের গল্পের মতই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
মাত্র গুটিকয়েক কটেজ এখানে। কটেজের জানালা দিয়ে সোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়া। সাদা বরফে ঢাকা শিখরে সূর্যের আলোর প্রথম স্পর্শ। অপূর্ব তার সৌন্দর্য। যেন স্বর্ণনির্মিত কিরিটির কৈলাশ ভূমি। পাদদেশে গভীর খাতের প্রান্তে তৃষিত তিস্তার সুপ্রশস্ত বিস্তার। রূপালী সুতোর মতই দৃশ্যমান। তবে এই কাঙ্ক্ষিত অরণ্য প্রকৃতির শান্তি, সুষমা ও সৌন্দর্যের মাঝে স্বপ্ন ভঙ্গের অস্বস্তি আনে ছোট ছোট ছিনে জোঁকের উপদ্রব। একবার ধরতে পারলেই পেট পুরে রক্ত খায়। রক্তের পিপাসা বুকে নিয়ে গুটি গুটি সে উঠে যায় শরীরের যে কোনও অংশে, উদরপুর্তি হলেই ঝরে পড়ে টুপ করে। যদিও লাঠির মাথায় নুনের পুটুলি করা থাকে ওদের জন্য। সেই লাঠি হাতে গামবুট পায়ে নামতে হবে এই রক্তক্ষয়ী অভিযানে, তবেই মিলবে অসম্ভব অ্যাডভেঞ্চারের অনাবিল আনন্দ।
পরদিন এই সৌন্দর্যভূমিকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা দিলাম জুলুকের উদ্দেশে। সিলেরীগাঁও থেকে জুলুক ৭৫ কিলোমিটার দূরে। সিল্ক রুট ধরে রংপো বাজার, পেডং ছাড়িয়ে জুলুক। প্রকৃতি এখানে খানিকটা রূক্ষ এবং ধূসর, যেন গেরুয়া বসনধারী যোগী তপস্যায় রত। কোথাও বড় গাছ নেই। এখানে কিন্তু খুব ঠান্ডা, তবে ফায়ার প্লেসের ওম মিলবে।
পরদিন সকালে চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আশপাশ দেখতে, সঙ্গে আদি বাবা মন্দিরের পথেও। সমতল থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড় কেটে তৈরি এই রাস্তা। কেবল কিছু তৃণলতা আর গুল্ম গুচ্ছ এদিক সেদিক ছড়িয়ে। পাথরের এই রাস্তা দেখলে মনে হয় হাজার হাজার বছর আগেকার কোন পিরামিডের রাজ্য বুঝি। আঁকা বাঁকা রাস্তার দুধারে ছোট বড় গুহায় বন্য কুকুরের বাস। আকৃতিতে এরা যেমন বৃহৎ, প্রকৃতিতেও এরা হিংস্র। দলবদ্ধ অবস্থায় থাকলে এরা একাকী পথযাত্রীকে অনায়াসেই নেকড়ে বাঘের মত খুবলে খেয়ে নিতে পারে। তবে এ হেন রুক্ষ উপত্যকায় যতদূর চোখ যায় ততদূর এই স্বপ্নের মায়ার আবেশ ছড়িয়ে দেয় অজস্র রডোডেনড্রন গুচ্ছ। কঠিনে কোমলে সে এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ধুসরতার বৈপরিত্যে রঙের সমারোহ। লাল, হলুদ, নীল, গোলাপী কত রং সে ফুলের। আপনা থেকেই ফুটে ওঠে তারা। দেখলে মনে হয় গৈরিক তপস্বীর কন্ঠে পুষ্প মালার বিন্যাস।
জটাধারী শিবের জটা থেকে যেমন করে ঝরে পড়ে জাহ্নবী, তেমনই পাহাড়ের বুকের উপর কোথাও কোথাও জমে আছে তুষার ধবল বরফ। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি তাই বরফের আতিশয্য না থাকলেও যেটুকু রয়েছে তাই সূর্যালোকের প্রভাদীপ্ত। ভারতবর্ষের ভিতরে এ কোন ভারতবর্ষ? প্রকৃতির এ কেমন প্রান জুড়ানো শীতলতা? চন্দ্রগুপ্ত নাটকের কথা মনে করে যেন বলতে ইচ্ছে করে – “সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ’’। যার একপ্রান্তে যখন গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত, অন্য প্রান্তে শরীর ওম রাখার জন্য শীত বস্ত্রই যথেষ্ট নয় ফায়ার প্লেসেরও প্রয়োজন। একদিকে নগর জীবনের কৃত্রিমতা ক্লান্তি, অবসাদ, হতাশা অন্যদিকে শীতের কুয়াশার বঙ্কিম নিশ্বাসের নির্জনতা, স্নিগ্ধতা, সৌন্দর্যমুখরতা।
প্রাচীন পুরানের কাহিনীতে বিশ্বকর্মা যেমন তক্ষকভূমিতে ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মান করেছিলেন অনুরূপ ভাবে ভারতীয় সেনা বাহিনী এই দুর্গম ভূমিতে পাহাড় কেটে তৈরি করেছে ফুটবল খেলার মাঠ, গলফ্কোর্স, এয়ারপোর্ট, আবার কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে নদী, কোথাও ঝরঝর ঝর্ণা। তারা বড়ই আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু তাদের দর্শনে আমাদের চোখ যে তৃপ্ত হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এরপর কিউকুলা নদী ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে রয়েছে তিব্বত চিনের চেকপোস্ট। তার কিছুটা দূরে বাঁ দিকে যে রাস্তাটা নেমেছে সেখান থেকে ৫২০ কিলোমিটার দূরে তিব্বতের লাসা শহর। সাংগু লেক, মেমেন্চু লেক পার হয়ে সেরাথাং আদি বাবা মন্দির। প্রথাগত কোব দেবতার মন্দির নয় এটি। কোন পৌরাণিক দেবতার অধিষ্ঠান সেখানে নেই। এর দেবতা একজন সৈনিক, হরভজন সিং। সীমান্ত রক্ষা করতে গিয়ে কোন এক ঐতিহাসিক কালে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। তাঁর ছবি, পোশাক, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী সবই সুরক্ষিত এখানে। প্রতিদিন সেগুলি যত্নে সাফ সুতরো করে রাখা হয়। জনশ্রুতি যে তিনি নাকি এখনও সীমান্ত পাহারা দেন। কথাটা সত্যি কিনা জানিনা। তবে এই পাহাড়ি পরিবেশে এর সত্যতা নিয়ে মন কোন প্রশ্নও করে না। এই মন্দিরের প্রসাদ মিছরি, নকুলদানা আর কিসমিস্। শুধু ভ্রমণার্থীরাই নয় সৈনিকেরাও রোজ তাঁকে স্যালুট করে ওই প্রসাদ গ্রহন করে। প্রায় ১২ হাজার ফুট উপরে ঠাণ্ডার প্রকোপ খুবই বেশি। বাতাসে শিমুল তুলোর মত হালকা তুষারও ঝরতে দেখা যায়। তবে ঠাণ্ডায় শরীর যতই কাবু হোক সেখানকার ইয়াকের দুধ আর পাহাড়ি জড়িবুটি দিয়ে বানানো চা মুহূর্তেই শরীর চাঙ্গা করে দেয়।
এতক্ষণ যে রাস্তাটা দিয়ে আমরা উপরে উঠেছিলাম, ওই রাস্তাটির নাম জিগ্ জ্যাগ্ ওয়ে। অম্ভি নামে এক ভারতীয় সৈনিক এই রাস্তা তৈরির দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সফর হয়েছিলেন।যদিও তাঁকে নিয়েও রয়েছে একটা লোককথা। সেই অম্ভি ভিউ প্যারেলে দাঁড়িয়ে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার্থিব সৌন্দর্য দেখলাম। এরপর নাথাং ভ্যালি পার হয়ে লাল, হলুদ, গোলাপি রং এর রডোডেনড্রন গুচ্ছকে পিছনে ফেলে এলাম নতুন বাবা মন্দিরে। মানুষ এবং যানবাহন এখানে অনেক বেশি। লেপচা বাহিনী নিয়ে তিব্বতীরা সিকিম দখল করতে এলে ভারতীয় সেনার সঙ্গে এখানেই তাদের সংঘর্ষ হয়েছিল। প্রায় ২০০০ সৈন্যের মৃত্যু হয় এখানে। এই মন্দিরেও আরাধ্য দেবতা হরভজন সিং।
একটু এগিয়ে এলে এলিফ্যান্ট লেক, দূর থেকে দেখলে শুয়ে থাকা একটা হাতির আকৃতি। প্রকৃতি ওকে এমন করেই বানিয়েছে, ভাবলে অবাক হতে হয়। আরও অবাক লাগে এই লেকগুলিই কোন না কোন নদীর উৎসস্থল এটা ভেবে। প্রায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছলাম। চায়না মার্কেট নাকি এটা। দু একটা দোকান মাত্র। তবে চিনা লেপ, কম্বল বা শীত বস্ত্র বেশ কম দামে মেলে এখানে। জায়গাটার নাম কুপুপ। রাস্তায় আমার মেয়ের হিল ডায়রিয়ার কারনে ফের আমাদের জুলুকে ফিরে আসতে হল। সেখানকার সেনা হাসপাতাল থেকে ওষুধ নেওয়া হল। রাতে একধরনের শাক খেলাম। গ্রিন হাউসে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট মুলোর শাকের মত এক ধরনের শাক হয়। বেশ সুস্বাদু কিন্তু শুনলাম প্রেসারকুকারে না দিলে নাকি সিদ্ধ হতে চায় না।
পরের দিন নিচে নামার পালা। যাত্রা শুরু রিশির উদ্দেশে। এবার প্রায় দু হাজার ফুট উচ্চতায়। রিশি এক মনোরম স্থান। রিশি নদীর গর্ভস্থ এই স্থানটির চারিদিকে উঁচু পাহাড়। মাঝখানে উপত্যকা। তারই মাঝে ছোট ছোট কটেজ ও লম্বা লম্বা সবুজে হলদে মেশানো সতেজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। পাশ দিয়ে কুল কুল ধবনিতে বয়ে চলেছে রিশি নদী। ঠাণ্ডা এখানে অনেক কম। নাতিশীতোষ্ণই বলা যায়। বড় বড় উপলখণ্ড, তাঁর মধ্যে দিয়ে জলের ধারা। এমনি দেখলে মনে তেমন জল নেই, নামলে কিন্তু গলা পর্যন্ত অনায়াসে তলিয়ে যায়। সেখানে দারুণ স্নান সারা হল। বিকেলে নদীর ধারে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলা। সন্ধ্যায় গোন্সা এবং তার সঙ্গীরা নদীর ধারে আগুন তৈরি করল। সেখানে ঝলসানো হল মুরগির মাংস। ওরা ওটাকে বার্বিকিউ বলে। আবছা চাঁদের আলোয় বার্বিকিউ, সঙ্গে হোটেল মালিকের হাওয়া নেপালি সঙ্গীত। সেদিনের সন্ধেবেলাটা এক অন্যরকমের ছন্দ এনে দিল। কলকাতায় যার স্বাদ মেলা ভার।
এখানকার কটেজগুলোর বারান্দা বাঁশের রেলিং দেওয়া। রাতের অন্ধকারে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসে এখানে। হোটেল মালিকেরা বলেন ভল্লুকের ডাক। কিছু দেশজ ফলের গাছও চোখে পড়ে এখানে। শোনা যায় বর্ষার মরশুমে রিশি নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। বাঁশের সাঁকোটি সেই কথারই সায় দেয়। সফর তো শেষ, এবার বাড়ি ফেরার পালা।
ফিরতে ফিরতে রবী ঠাকুরের ভাষাতেই বলতে হয় –
“হায়রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু
পথ প্রান্তে ফেলে যেতে হয়”।