শিক্ষা, সমাজ এবং বেগম রোকেয়া
শুভজিত দত্ত, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##
যে সময় মুসলিম নারীদের বাইরের আলো দেখাই নিষেধ ছিল, সেই সময়ই তিনি অনুভব করেছিলেন মুসলিম নারীদের অব্যাহতি দিতে প্রয়োজন নারীজাগরণ।আর শিক্ষাই হল সেই শক্তি যা নারীকে পথ দেখাতে পারে, স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করতে পারে। জয় করতে পারে কুসংস্কারের অমূলক ভীতি, সমাজে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে মানুষ হিসেবে। তবে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে এই পথটা কিন্তু সহজ ছিল না।
সময়টা তখন বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ। দেশজুড়ে চলছে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের রাজনীতির উত্তপ্ত হাওয়া। আবার বিশ্বজুড়ে জার্মানশক্তির প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি প্রস্তুতি। এরকম এক আবহে এক মুসলিম নারীর নারীশক্তি হয়ে ওঠার পথ চলার শুরু, ভাগলপুর থেকে কলকাতায় এসে ১৩ নম্বর ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র চারজন ছাত্রী নিয়ে মেয়েদের জন্য চালু করলেন এক স্কুল, শুরু হলো এক নতুন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা। তখনকার গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজে একমাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের ঘরে ঘরে কড়া নাড়িয়েও তিনজনের বেশি ছাত্রী সংখ্যা বাড়াতে পারলেন না। মেয়েদের পরিবারের লোকেরা ওনাকে দেখলেই দরজা বন্ধ করে দিত, কেউ হু হা করে পাশ কাটাতেন, তো কেউ রূঢ় ব্যবহার করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতেন। সমাজ কোনওকালেই এমন ব্যতিক্রমীদের মেনে নেয় না, তাই খ্যাপাটে মহিলা হিসেবে ওনার নাম সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু তিনি দমবার পাত্রী নন, অদম্য জেদই তাঁর একমাত্র সম্বল। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের মত এখানেও লড়াই চালিয়ে গেলেন, প্রতিদিনকার এক লড়াই শুরু হলো ঘরে বাইরে। সকালে উঠেই পিঠে একটা ব্যাগ আর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন ছাত্রীর সন্ধানে, ঘুরে বেড়াতেন পাড়ায় পাড়ায়, অভিভাবকদের বোঝাতেন কতটা জরুরী নারী শিক্ষা, সেই গোঁড়া অন্ধ সমাজকে বোঝাতেন নারী যদি শিক্ষিত না হয়, অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে স্বনির্ভর না হয় তবে তাদের মুক্তিও সুদূর পরাহত, সমাজের উন্নতির গতিও হবে রুদ্ধ। ধীর গতিতে হলেও অবশেষে তিনি দেখা পেলেন সাফল্যের। অভিভাবকদের নিজের পারদর্শিতায় বুঝিয়ে তিনি মেয়েদের স্কুলগামী করলেন, ধীরে ধীরে স্কুলে বাড়তে লাগলো ছাত্রীসংখ্যা, চার বছরের মধ্যে সেইসংখ্যা বেড়ে হলো ৮৪ জন। পর্দার ভিতর দিয়েই ছাত্রীদের ঘোড়ার গাড়িতে স্কুলে আনা-নেওয়া হত। দেওয়া হত তাফরিসহ কোরানপাঠ থেকে শুরু করে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি প্রভৃতি প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি হোম নার্সিং, ফার্স্ট এইড, রান্না, সেলাই, শরীরচর্চার শিক্ষা। ১৯১৪ সালে এই স্কুল মর্যাদা পেল উচ্চ প্রাইমারির, তারও প্রায় ১৬ বছর পর হাই স্কুলের মর্যাদা, নাম হলো সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাই স্কুল। এতদিনের সংগ্রাম যেন মর্যাদা পেল, পরিপূর্ণতা পেলো তাঁর স্বপ্ন।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও সেখানেও সংগ্রামের ছবিটা স্পষ্ট হয়। ১৮৮০সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত গোঁড়া মুসলিম পরিবারে জন্ম তাঁর। পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত হলেও সেখানে পরিবারের মেয়েদের জন্য কোরান ও ধর্মশিক্ষা ছাড়া আর কোনো শিক্ষার প্রচলন ছিল না। কিন্তু তাঁর শিক্ষালাভের জ্ঞানপিপাসা এতটাই ছিল যে বিলেতফেরত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইব্রাহিমের কাছে ঘরেই লুকিয়ে ইংরেজি ও বাংলা শিখেছেন। ভ্রাতা ইব্রাহিম তাঁকে সবসময় পড়াশোনায় অনুপ্রেরণা দিয়ে বলতেন-“ইংরেজি ভাষাটা যদি শিখে নিতে পারিস তাহলে তোর সামনে রত্নভান্ডারের দরজা খুলে যাবে।” কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল ভাগলপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসেন এর সাথে। স্বামী সাখাওয়াত হোসেনও ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। তার কাছ থেকেও পড়াশোনার ব্যাপারে সবসময়ে উৎসাহ পেয়েছেন। তাই এইসময়টা তিনি পড়াশোনার সাথে সাথে লেখালেখিতেও মন দেন।১৯০২ সালে নবপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ নামক এক প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রথম সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ, লেখা প্রকাশিত হতো মিসেস আর.এস.হোসেন নামে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে: মতিচূর , Sultana’s Dream, পদ্মরাগ প্রভৃতি। এছাড়া আছে অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক রচনা ও অনুবাদ।তার কবিতাগ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘বাসিফুল’, ‘শশধর’, ‘চাঁদ’, ‘নলিনী ও মুকুদ’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘সওগাত’, ‘আপীল’, ‘নিরূপম বীর’।তিনি তাঁর লেখা পদ্মরাগ উপন্যাসটি প্রিয় ভাইকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন-‘দাদা!আমাকে তুমিই গড়িয়া তুলেছ’।তিনি নিজের লেখনীতে বারবার নারীদের নিজস্ব শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন,অর্থ উপার্জনক্ষম হতে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। পুরুষ যেভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে সমাজে, পরিবারে সিদ্ধান্ত দেবার একক পরিমাপক হয়ে উঠেছে তেমনি নারী জাতিকেও শিক্ষায়, মেধায় পুরুষের সমগোত্রীয় হয়ে জীবন পরিচালিত করবার সাহস দিয়েছেন,স্বপ্ন দেখিয়েছেন।যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল তখন জীবনে আবার এক দুঃসংবাদ রূপে এক কালো মেঘ নেমে আসে। জন্মের কয়েকমাসের মধ্যে তাঁর দুই কন্যাসন্তান ও 1909 সালে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি তাঁর স্বামীকে হারান।কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি থেমে থাকেননি।এরপর পুরো সময়টাই তিনি সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাসের মাথায় তিনি ভাগলপুরে সাখওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল চালু করেন।কিন্তু সম্পতিগত পারিবারিক বিবাদের কারণে তিনি স্কুল বন্ধ করে কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৯১১ সালের ১৫ই মার্চ সাখওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল পুনরায় চালু করেন। এটি শুধু একটি স্কুল নয় ছিল নবজাগরণের সূচনা। শত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করেও যার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শিক্ষার আলো সমস্ত বাড়ির অন্দরমহলে। তিনি নারী সমাজের উন্নতিপ্রকল্পে শুধু চিন্তা করেই থেমে থাকেনি তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।এমনকি বিশিষ্ট নেত্রী সরোজিনী নাইড়ুও তাঁর এই কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
মহিয়সী রোকেয়া চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন গঙ্গা তীরবর্তী উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে। ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর পর কলকাতার কোনো সমাধিক্ষেত্রেই তাকে সমাধিস্থ করা যায় না। কারণ তৎকালীন কলকাতার রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ তাকে কলকাতায় সমাধিস্থ করতে আপত্তি জানায়। পুরুষশাসিত কূপমন্ডুক সমাজের গন্ডি থেকে মুসলিম নারীকে মুক্ত করতে যে মহৎ প্রয়াস তিনি করেন তা তাদের কাছে ধর্মদ্রোহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। মৃত্যুর পরে তাই তাকে সমাধিস্থ করা হয় পানিহাটিতেই। কাকতলীয়ভাবে এই সমাধিক্ষেত্র এখন পানিহাটির একটি মেয়েদের স্কুল চত্বরে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের এটা অজানাই ছিল।বহু বছর পর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্বর্গত অমলেন্দু দে সেই সমাধি স্থান চিহ্নিত করেন। স্থানীয় পৌর প্রশাসনের তরফে সেই স্থানে স্থাপিত হয় একটি ফলক।গতবছর আরও একটি ফলকস্থাপন করা হয়।
মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি তাঁর কোন প্রিয়তমা ছাত্রীকে বড় করুণভাবে বলেছিলেন-
“মা, সময় বুঝি হইয়া আসিল। মরণের বোধহয় আর বেশি দেরী নাই। আল্লাহর রহমতে জীবনের সকল আশা-আকাঙক্ষা পূর্ণ হইয়াছে। এইবার ছুটি নিতে হয়। সত্য সত্যই জীবনের কুন্দকুসুম যেদিন ঝরিয়া পড়িবে সেদিন আমার শেষ বিশ্রাম স্থান রচনা করিও আমার প্রাণের এই তাজমহলের একপাশে। কবরে শুইয়া শুইয়াও যেন আমি আমার মেয়েদের কলকোলাহল শুনতে পাই।”
ওনার সমাধিক্ষেত্রের সামনে গিয়ে সত্যিই অনুভব করলাম কাকতলীয় ভাবে হলেও ওনার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তিনি রোজই তাঁর ছাত্রীদের কোলাহলের মধ্যেই আছেন। তিনিই হয়ত এই স্কুলের কান্ডারী। এখনো শিক্ষার পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন, লড়াই করার মন্ত্রে দীক্ষিত করে যাচ্ছেন এই স্কুলের ছাত্রীদের। না হাতে কোনো ফুল ছিল না তাই ওনারই লেখা বাসিফুলের কয়েকটা লাইন দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম এই নারীর সেই অসমসাহসী লড়াই কে।
পিসিমা! তোমার তরে আনিয়াছি ফুল
এত বলি আমি ছুটি
হাতে দিল ফুল দুটি
চেয়ে দেখি, আনিয়াছে দুটি বাসিফুল।”
————————————————————
পুনশ্চঃ: রোকেয়া সাখওয়াত হোসেনকে ‘বেগম রোকেয়া’ নামে অভিহিত করলে অনেকেই আপত্তি তোলেন। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ একটি যুক্তি রেখেছেন -“কেন বেগম রোকেয়া বলাটা বিধেয় নয়? রোকেয়ার সঙ্গে কখনও বেগম ছিল না। রোকেয়ার ব্যক্তিগত পত্র পরীক্ষা করে দেখেছি সেখানে সম্পর্কভেদে কোথাও লেখা হয়েছে রোকেয়া, রোকাইয়া বা রুকু। আর স্কুল পরিচালনা করতে গিয়ে যে দাপ্তরিক চিঠিপত্র লিখেছেন, সেখানে স্বাক্ষর করেছেন আর এস হোসাইন। লেখক হিসেবে তার গ্রন্থে নাম লিখেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যে শব্দ তার নামের অংশ নয়, একে বহু ব্যবহারে নামের অংশ বানিয়ে ফেলা রীতিমতো অন্যায় ও ইতিহাস বিকৃতি। এমনিতে সম্মান দেখাতে গিয়ে শব্দ হিসেবে আমরা ‘জনাব’ ও ‘বেগম’ ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করা যায় না। উনিশ-বিশ শতকের সমাজ বাস্তবতায় ব্যবহার করেছি, আর একুশ শতক পর্যন্ত লালন করে যাচ্ছি। নিষ্প্রভ করে দিতে চাচ্ছি এই মহীয়সী নারীর ঔজ্জ্বল্যকে।”
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: অমিতাভ পুরকায়স্থ।