শেষে এসে সমে
শারদীয়া ভট্টাচার্য, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##
জানলার
গ্রিলে ঠোঁট চেপে কত কথাই না এক নাগাড়ে
ভেবে যাচ্ছিলেন মনীষা। তাঁর
শান্তশিষ্ট রুটিনমাফিক মন গহীনে বিষাদ চেপে আনন্দকে সঙ্গী করে
দিব্যি কেটে যাওয়া দিনগুলোর মাঝে হঠাৎই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিনিসুতোর মালা
গাঁথছিলেন মনীষা। মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়ছিল অতীত উদ্ভাসের ঝলক।
‘সেদিন কেন যে মরতে একলা
বেরিয়েছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে, নইলে তো
আর দেখাই হত না।’
মনে মনে ভাবেন মনীষা।
‘ঈশা’ ডাকটা বহু শতাব্দী পর শুনে চমকে থমকে
গিয়েছিলেন তিনি। প্রথমটা ভুল শুনেছেন ভেবে এগোতেই আবার ডাক- ‘দাঁড়াও ঈশা… প্লিজ’।
পিছন ফিরে চমকে উঠেছিলেন মনীষা-
‘সম্বুদ্ধদা তুমি?’ চল্লিশ বছর পরেও দুজন দুজনকে চিনতে
এতটুকু ভুল হল না।
-‘এখনও এত
রাগ আমার ওপর?’
কফির ধোঁয়া ভেদ করে দেখা প্রিয়
গম্ভীর মুখটির প্রতি প্রশ্ন রাখলেন সম্বুদ্ধ।
মনীষা কিছুই বলতে পারছিলেন না।
তিনি তো প্রথমে আসতেও চাননি সিসিডিতে। কিন্তু অমোঘ জাদুমন্ত্রে ফেরাতে পারেননি
সম্বুদ্ধকে।
-‘রেবাদি, আমার ফিরতে একটু দেরি হবে’ আশ্রমে ফোন করে বলে দিয়েছিলেন।
# # #
কফির
কাপের ধোঁয়া ওঠা কখন বন্ধ হয়ে গেছে ওঁরা খেয়ালও করেননি। শুধু কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ
মুখ কুঁচকে গেল- ঠান্ডা জল হয়ে গেছে।
– ‘থাক ওটা আর খেও না।’
-‘ইশ! এত দামের জিনিস!’
– ‘হয়েছে। তুমি কবেই বা ঠাণ্ডা কফি
খেতে পারো শুনি?’
চমকে তাকালেন মনীষা। মনের কথা
বুঝতে পেরে সম্বুদ্ধ বললেন, ‘সব মনে
আছে আমার।’
###
-‘বলিস কি
রে? এ তো সিনেমা।’ সবটা শুনে রেবা বললেন। মনীষা আর রেবা
যে শুধু সহ-আবাসিক তাই নয়; এক ঘরে
থাকতে থাকতে তাঁরা পরস্পরের সুখ-দুঃখ যাপনের সবচেয়ে কাছের সই হয়ে উঠেছেন।
-‘সত্যি গো। এতগুলো বছর আমি ভুল
ধারণা নিয়ে কাটিয়ে দিলাম।’
-‘তোর দাদাটাও বা কি রে?’
-‘আজ তিনি স্বর্গে গেছেন। বলাটা
ঠিক নয়। তাও বলছি রেবাদি, দাদা
চিরকাল এমনটাই করে এসেছে আমার সাথে।’
-‘তবে তোর বউদিও সোজা মেয়েমানুষ
নয় এ আমি পষ্ট বলে দিলাম মনি।’
-‘মায়ের কাছে আর কি মাসির গল্প
করবে রেবাদি?’
###
পরদিন
বিকেলে কাছের পার্কে আবার দেখা করেছিলেন সম্বুদ্ধ। কত কথা, কত গল্প। মনে পড়ল সেদিনের কথা। তখনও
ওরা মাঝেমাঝেই দেখা করত। সেদিন সম্বুদ্ধ আর মনীষা হাত ধরে পার্কে হাঁটছিল। পার্কের
মাটিতে অমলতাসের গড়াগড়ি-দোলের কয়েকদিন আগেই মনীষার দুগাল যেন আবীরে রেঙে উঠেছে।
মিহিস্বরে সম্বুদ্ধকে শোনাচ্ছে, ‘তোমার
হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে
দান…’
-‘বাহ! অনেকদিন পর তোমার গান
শুনছি মনি।’
চমকে তাকিয়েছিল ওরা। মনীষার
বউদি আবার বলল- ‘বাড়িতে রেওয়াজ করো না কেন ভাই?’
মনীষা শক্ত করে ধরে আছে
সম্বুদ্ধের হাত। বাপ মরা দাদার অনুগ্রহে থাকা মনীষা ততক্ষণে টের পেয়ে গেছে আজ বাড়ি
গিয়ে কী হতে পারে।
-‘ভাল তো সব খবর? মলয়ের সাথে দেখা হয়নি অনেকদিন।’ সহজ গলায় বলেছিল সম্বুদ্ধ।
-‘বেশ তো। বলে দেব আপনার বন্ধুকে
দেখা করতে।’
হিসহিসিয়ে বলে ঝটকা দিয়ে চলে
গিয়েছিল মনীষার বৌদি।
সম্বুদ্ধ বলেছিল, ‘আরে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আর মলয়? কিচ্ছু বলবে না। ও আমার খুব ভাল
বন্ধু। ভয় পেও না এত।’
মনীষা চিনত ওর দাদাকে। বাড়ি
ফিরে সেদিন অতবড় মেয়েটার কপালে জুটেছিল মার। বাকিটুকু আর নাই বললাম। সম্বুদ্ধও কম
অপমানিত হয়নি।
দাদা অনেক চেষ্টা করেছিল মনীষার অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার। হার মেনেছে মনীষার জেদের কাছে। কিন্তু দাদা বউদির বদান্যতায় সম্বুদ্ধর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারেনি কোনদিন।
মাসকয়েকের মধ্যেই দাদা খবরটা এনেছিল। মুখের ওপর কথাটা বলে আর কার্ডটা ছুঁড়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে গিয়েছিল। বউদির মুখেও বিজয়িনীর হাসি। কার্ডের ওপর ‘সম্বুদ্ধ আর রুমেলা’ নামটুকু দেখে ছুটে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। অভিমানে, লজ্জায় রাগে মেয়েটার যেন একবার মৃত্যু হয়েছিল সেই মুহূর্তে। এভাবেও বিশ্বাস ভাঙতে পারে মানুষ!
আর দেরি
করেনি। দূর শহরে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল মনীষা। একাই কাটিয়েছে জীবন। তারপর অবসরের
পর এই ‘অবসরে’ ফিরেছে কোলকাতায়। শুধু শুনেছিল সম্বুদ্ধও নাকি কোলকাতা ছেড়ে চলে
গেছে।
###
– ‘রেবাদি, নিজের দাদা এভাবে ঠকাবে বুঝিনি গো।’
-‘আর তুইও হাঁদাগঙ্গারাম। তোর
দাদার যে আরও একটা বন্ধু আছে ওই একই নামে তা বুঝলি না। এই তোর ভালবাসার জোর?’
আসলে
মলয়ের দুটি বন্ধু ছিল সম্বুদ্ধ নামে। মনীষার সম নয়- অন্য সম্বুদ্ধের বিয়ে হয়েছিল
রুমেলার সাথে।
মলয় বোনকে চিনত। জানত কার্ড
খুলে দেখবে না অভিমানী মেয়ে। তাই এই ছল করেছিল।
এদিকে সম নিজেও বিয়ে করেনি আর। মনীষার সাথে যোগাযোগের বহু চেষ্টা করেও না পেরে দূর দেশে চলে গিয়েছিল। সম্প্রতি তাঁরও প্রত্যাবর্তন।
###
এসব
ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ যে কেটে গেছে কে জানে! সম্বিৎ ফিরল রেবার ডাকে।
-‘এখানে একা বসে কী করছিস? নিচে চলো তিনি এসেছেন।’
-‘এখানে?’ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন মনীষা।
-‘নয়ত কি?’
-‘ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে
এখানে দুম করে আসে কেউ!’
-‘মনীষা তাড়াতাড়ি চল। উনি ওয়েটিং
রুমে। আর কত অপেক্ষা করাবি? ‘ আন্তরিক
খুশির হাসি হাসলেন রেবা।
এই শেষ বয়সেও রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ে মনীষার মুখে।