সন্ধ্যামালতী
তনুপ্রিয়া চক্রবর্তী, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##
আজ ইলেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল। ঋদ্ধি শেষ পেপার নৃ-বিদ্যার পরীক্ষা দিয়ে একেবারে ফুরফুরে মেজাজে। পরীক্ষা শেষ, বন্ধুদের সাথে দেখা হবে না বেশ কিছুদিন। তাই আজ আর ফেরার পথে সাইকেলের সিটে কারোরই ওঠা হল না। সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছে হাসি-আড্ডার ফোয়ারা তুলে। চারটের সময় ফিরে ঋদ্ধি দেখল বাড়ির বারান্দায় সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে হাতের প্যাকেটে রজনীগন্ধা ফুলের মালা নিয়ে ইজি চেয়ারে বাবা চোখ বুজে বসে আছে। বাড়ির চাবি তাদের দুজনের কাছেই থাকে,তাই আর ডাকাডাকি না করে সে দ্রুত ঢুকে তৈরি হতে চলে গেল। সে একদম ভুলেই গিয়েছিল আজ বাবার এক প্রিয় ছাত্রের ঠাকুমার শ্রাদ্ধে তাদের নিমন্ত্রণ। সে জানে দেরি করে ফেরার জন্য বাবা তাকে কিছুই বলবে না;বাবা কে তার আসলে কখনো কিছু বুঝিয়ে বলতেই লাগে না, নিজেই সব বুঝে যায়। কিন্তু সেই তিনটের থেকে তৈরি হয়ে বসে থেকে বাবার তো ক্ষিদে পাওয়ার কথা, মাথায় আসতেই ঘর থেকে হাঁক পাড়ল, “বাবা, ফ্রীজে দই আছে, তোমাকে ঘোল করে দেব? খুব ক্ষিদে পেয়েছে বলো?” ক্ষিদে নিলয় বাবুর সত্যিই পেয়েছিল; বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে ওনার স্কুল অনাথবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়। পরীক্ষা শেষের পরে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যা কিছু অতিরিক্ত কাজ কর্মের দায়িত্ব থাকে তা সব মিটিয়েও তিনি ৩ টে ১০ এ বাড়ি চলে এসেছেন আর তখন থেকে তৈরি হয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষারত। মেয়েকে ছাড়া তাই বলে কিছু খেয়ে নিতেও ইচ্ছে করেনি। তিনি উত্তর দিলেন, “নাহ্, এই অবেলায় আমার দই খেয়ে কাজ নেই। তুই জলদি তৈরি হয়ে আয়। “কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা। রাস্তায় যেতে যেতেই মেয়ের পরীক্ষার খবর নিলেন নিলয় বাবু। দশ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে মেয়েটা; সেই থেকে ওর পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া সবদিকই নিলয় বাবু নিজে সামলান। নিলয় বাবুর মত হল,আমাদের দেশের অসংখ্য বিধবা,স্বামীর ঘর ত্যাগ করা স্ত্রী লোক যদি বাবা ও মায়ের উভয় ভূমিকা সামলে সন্তান কে বড়ো করতে পারে তবে তিনি একজন সুস্থ-সমর্থ পুরুষ হয়ে তারই মেয়ের মা ও বাবা কেন হয়ে উঠতে পারবেন না!
পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে ঋদ্ধিরা নিমন্ত্রণ বাড়ি পৌঁছে গেল। এবার তো ঋদ্ধির পেটেও ক্ষিদেরা ইকিড়-মিকিড় খেলছে। ঢোকার আগে চাপা গলায় বাবাকে বলল, “এনাদের রান্না-বান্না সব যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে কী হবে?” তার কথায় হেসে উঠে নিলয় বাবু বললেন, “এইবার দেখ দেরি করে ফেরার মজা, দেখি কপালে কিছু জোটে কিনা। “প্যান্ডেলের ভিতরে ঢুকতেই বাড়ির কয়েকজন এগিয়ে এলেন প্রিয় মাষ্টার মশাই এর আপ্যায়নে। নিলয় বাবু ঋদ্ধিকে মালাটা মৃত ব্যক্তির ফটোয় পরাতে বলে এগিয়ে গেলেন চেয়ারে বসা কয়েকজন বৃদ্ধের দিকে। মালা পরিয়ে, প্রনাম সেরে বোকার মতোই দাঁড়িয়ে থাকল ঋদ্ধি; বাবার সাথে কোথাও বেরোলে এমনই হয়, মাষ্টারমশাইকে সবাই একবার পেলে হল। হঠাৎ বাঁ দিকে চোখ পড়তেই দেখল সাদা কাপড়ে মোড়া প্যান্ডেলে ঢোকার যে পথ তার ঠিক ডান দিকেই একটা অচেনা ফুলের গাছ। টকটকে গোলাপি রঙের পাঁচটা পাপড়ি সমন্বিত ফুল আর মাঝখানে একটা সরু গোলাপি সুতোর মতো পরাগদন্ড বেরিয়ে আছে;এমন সাদা প্যান্ডেলের মাঝে ছোট্ট গাছটা তার উজ্বল উপস্থিতি জানান দিচ্ছে;একরাশ সবুজ পাতার ঝাঁক থেকে ইতিউতি উঁকি মারছে ফিনফিনে গোলাপি ফুলগুলো। হঠাৎ একটা প্রানখোলা কন্ঠস্বরে চমকে দিল ঋদ্ধিকে, “এই যে দিদিমনি, আপনি মাষ্টার মশাইয়ের মেয়ে তো? উনি আপনাকে খাওয়ার টেবিলে ডাকছেন,উনি কথা বলতে বলতে বেখেয়ালে এগিয়ে গেছেন,আপনি আসুন। “ঋদ্ধি দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝারি উচ্চতা ও গড়নের কুড়ি-একুশ বছর বয়সী এক যুবক। তার ব্যক্তিত্বের প্রলেপ লাগানো মুখে বিনয়ের ছাপ স্পষ্ট; তার সাথে সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা চেহারায় যোগ করেছে এক স্নিগ্ধতার আবেশ। ইলেভেনে পড়া ঋদ্ধিকে এই প্রথম কেউ ‘আপনি’ সম্বোধন করল; আচমকা পাওয়া এমন সম্মানের বিস্ময় কাটিয়ে সে বলল, “চলুন”। খাওয়ার জায়গায় প্রবেশ করে সেই যুবক আবার বলল, “মষ্টারমশাই, এই দিকটায় এসে বসুন,ফ্যানের হাওয়া ভালো পাবেন। আমি তো ডাকতে গিয়ে দেখি দিদিমনি ঘামছেন। “তার গলার মায়াময়তায় ঋদ্ধির হঠাৎ লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল। নিলয় বাবু বললেন,” ওর কথা আর বোলো না তপোময়,স্কুল থেকে ফিরতে দেরি করেছে, তাই তাড়াহুড়ো করে আমার সাথে বেরিয়ে এখন ওর গলদঘর্ম অবস্থা। “ওদের খাওয়ার পুরো সময়টাই তপোময় ওখানে বসে থাকল। ঋদ্ধি জানতে পারল, তপোময় নিলয় বাবুর ছাত্রটির জ্যাঠতুতো দাদা;কলকাতায় বাড়ি, পড়াশুনায় খুব ভালো, সেখানকার নামী কলেজে বাংলা অনার্সের ফাইনাল ইয়ার চলছে। খাওয়া-দাওয়া সারতে সাড়ে পাঁচটার বেশি বেজে গেল। ঋদ্ধি কে উঠোনে দাঁড় করিয়ে নিলয় বাবু বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলেন। বেশ খানিকটা সময় যে লাগবে তা ঋদ্ধি জানত। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেই গোলাপি ফুল গাছটার কাছে; একটু খানি দূরে প্যান্ডেলের মধ্যেই ক্রিকেট খেলছে তপোময় ছোট ভাইদের সাথে। সেই ফুল গাছটা তন্ময় হয়ে দেখছিল ঋদ্ধি। হঠাৎ তার পায়ের কাছে ক্রিকেটের বল এসে পড়ায় সামনে তাকাল সে,দেখল ব্যাট কাঁধে নিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে তপোময়। তার সামনে এসে বলল, “স্যরি,পায়ে লাগেনি আশা করি।”
“না, লাগেনি”, হেসে ছোট করে উত্তর দিল ঋদ্ধি। তপোময় আবার বলে উঠল,” এখানে একা দাঁড়িয়ে ফুল দেখছেন? এটা তো সন্ধ্যামালতী ফুল, গন্ধ শুঁকেছেন কখনও?” দুদিকে মাথা নাড়ল ঋদ্ধি। চারটে ফুল ছিঁড়ে ওর হাতে দিয়ে তপোময় বলল, “নিন্, শুঁকে দেখুন। আমার তো দিব্বু লাগে।” বলেই চলে গেল খেলতে। প্রায় সাথে সাথেই নিলয়বাবু এলেন। বাড়ি ফিরে নিলয় বাবু ফ্রেশ হয়ে স্টাডিরুমে ঢুকতেই ঋদ্ধি তার ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াল। সে এখনও কিছুই চেঞ্জ করেনি। বুঝতে চেষ্টা করল কেমন লাগছে তাকে দেখতে, অথচ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কিন্তু একবারও মনে হয়নি আয়নায় নিজেকে দেখার কথা। রোগা চেহারা,হালকা আকাশি চুড়িদার, মাথার দুপাশে দুটো বেনী, সেই স্কুল যাওয়ার সময়ে বাঁধা আর সাদাটে ঘেমো মুখে গোলাপি আভা। “ইশ্ একটুও ভালো লাগছে না আমাকে দেখতে!” কথাটা মনে হতে নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেয়ে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল বিছানায়। আস্তে আস্তে হাতের মুঠো আলগা করতেই নাকে আসল মৃদু অথচ মিষ্টি একটা গন্ধ,যে গন্ধে নেই সৌন্দর্যের ঝাঁঝালো অহংকার;আছে স্নিগ্ধতার প্রশান্তি। ‘তপোময়’, নামটা একবার নিজের মনে উচ্চারণ করেই হেসে ফেলল; মনে ভিড় করে আসতে লাগল ওর সাথে আবার দেখা হওয়ার অজস্র কাল্পনিক সম্ভাবনা। যতই সে ভাবে ততই অপূর্ব এক সুখ সঞ্চারিত হতে থাকে প্রতিটি রোমকূপে। কিন্তু দেখা হলে ঋদ্ধি যে কী করবে বা কী বলবে তপোময়কে সেই কল্পনায় আর অগ্ৰসর হতে পারে না; এই অচেনা অনুভূতির মাদকতা আবিষ্ট করল তার হৃদয় কে; চাওয়া-পাওয়ার অভিকর্ষকে পেরিয়ে ঋদ্ধির অনুভূতিরা পেল মুক্তিবেগ।
এরপরে বাড়িতে অনেক সন্ধ্যামালতীর চারা পুঁতেছে ঋদ্ধি। বেশ কষ্ট করেই খুঁজে বার করতে হয়েছে, আসলে তেমন নামিদামি ফুল গাছ তো নয়। সেদিনের বিকেল আর সন্ধ্যা মালতী ঋদ্ধির জীবনে এক সুখ জাগানো সুগন্ধ হয়ে রয়েই গেল। আর কখনোই দেখা হয়নি তপোময়ের সাথে। তবুও বারবার নানা অবসরে ঘুরে ফিরে আসে তার স্মৃতি,কেন যে তার তপোময়কে খুব ভালো মানুষ, ভরসার যোগ্য মানুষ মনে হয়েছিল সে উত্তর অজানাই থেকে গেল।
সেদিনের কিশোরী ঋদ্ধি এখন ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে ইতিহাসে এম.এ পাশ করা কৃতি ছাত্রী। জীবন ও কেরিয়ারের এই টার্নিং পয়েন্টে এসে বাবা কে জানাল সে চাকরি করতে চায় না,টাকা রোজগারের খুব প্রয়োজন তার নেই; পড়াশুনা শিখে যা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছে তা সে সমাজের কাজে লাগাতে চায়,মানুষের কাজে লাগাতে চায়। বন্ধুর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালিত একটা অবৈতনিক স্কুল আছে সেখানে পড়াতে চায় সে। বাবা খুশি মনেই মত দিলেন আর মেয়ের কাছে অনুমতি চাইলেন বিয়ের পাত্র খোঁঁজার জন্য। ঋদ্ধি আপত্তি করেনি কিন্তু বাবার সাথে বন্ধুত্ব থাকার সুবাদে মন খুলে বলেই দিল ছয় বছর আগে এক বিকেলে তপোময়ের প্রতি যে অনুভূতি দানা বেঁধেছিল সেই কথা। এ কথাও অবশ্য জানাল যে ওটা একটা সুন্দর স্মৃতি যা আজও তাকে প্রশান্তি দেয়,মন খারাপের গ্নানি মুছিয়ে দেয়; সেদিনের সেই অচেনা অনুভূতি কে আজ অনেকটাই চেনে ঋদ্ধি এবং বিশ্বাস করে সে তপোময়ের সাথেই সর্বৈব সুখী হবে; কিন্তু এ বিশ্বাসের কোনো যুক্তি নেই, হয়তো যুক্তিহীন বলেই এই বিশ্বাস এতখানি দাবিহীন। বাবাকে এও বলে ঋদ্ধি যে তার প্রতি তপোময়ের আদৌ হয়তো কোনো অনুভূতি নেই, তাকে হয়তো মনেই নেই ওর; এতদিনে হয়তো অন্য কারোর সাথে এনগেজড্ ও হয়ে গেছে, ঐ একবারই তো আলাপ হয়েছে ওদের আর ওটাই শেষ। সেই আলাপের অনুরনন দুজনের চিত্তবীনায় যে একই সুর তুলবে তা সত্যিই অলীক কল্পনার পর্যায়ে পরে। পাশাপাশি এও ঠিক যে তপোময়ের মুখটা ঝাপসা হয়ে গেছে তার মনে;কলকাতার ভিড়ে কোথাও দেখা হলেও তাকে আর চিনতে পারবে না, প্রথম ও শেষ দেখার নির্যাসটুকু রয়ে গেছে শুধু। তাই আজ অন্য কারোর সাথে ভালোবাসার ঘর বাঁধতে আপত্তি নেই তার; তপোময় কে ঘিরে গড়ে ওঠা অনুভূতিরা ওর চিরকালীন সুখের ঠিকানা হয়ে থেকেই যাবে। তার এ সুখ হারানোর নয়, আবার পাওয়ার আকাঙ্খায় জর্জরিত ও নয়। মেয়ের অভিরুচিটা ধরতে পারলেন নিলয় বাবু। অনেক বছর আগের সেই ছাত্রের বাড়িতে আবার গেলেন তিনি যেখানে তপোময়কে দেখেছিল তার মেয়ে। কিন্তু তারা বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে; অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারলেন না। অগত্যা মেয়ের জীবনসঙ্গী খোঁজা শুরু করলেন, যে সঙ্গী সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হবে। ঋদ্ধি বা তার বাবা কেউই অনুধাবন করতে পারেনি যে কাজটা এতটা কঠিন হবে। ঋদ্ধির সত্যনিষ্ঠ সহজ-সরল কথা, ঘরে-বাইরে কাজ সামলানোর দক্ষতা, এসব কোনো পুরুষ বা তার পরিবারের কাছে গ্ৰহনযোগ্য হল না। সকলেই চায় ইঁট-কাঠ-মার্বেলের গৃহ আর গৃহস্বামীর সেবায় সর্বক্ষণ নিমগ্ন থাকতে চাওয়া পরিপাটি একটা বউ; নাহ্ শুধু যে বউ এর থেকে সেবা নেবে তা নয়, বিনিময়ে দেবে অনেক কিছুই কিন্তু সেসব আবার বিশেষ রকম মানসিক উদারতার পর্যায়ে পড়ে,কোনোটাই আবশ্যিক মানবিক কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে না। ঋদ্ধি প্রত্যেকবার হতাশ হয়ে দেখল একটা ভালোবাসার ঘরে দেওয়া-নেওয়ার হিসাব যে কত অকিঞ্চিতকর সেটাই কেউ বোঝে না; কেউ মানুষ খোঁজে না,বন্ধুত্বের আশ্রয় খোঁজে না বা দিতেও চায় না। অর্থের ভরসা, বিত্তের ভরসা, বিলাসবহুল জীবনের ভরসা সকলেই দিতে রাজি কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার মানসিক ভরসা দিতে পারার মানুষ নেই; সেসব প্রায় সকলের কাছেই আবেগী মনের অপরিণত ভাবনা। কাগজে-কলমে উচ্চ শিক্ষার ডিগ্ৰিধারী পাত্রী সকলেই চায়; কিন্তু পাত্রীর জীবনে, মননে ও বিশেষ করে আচরণে যদি প্রকৃতপক্ষে সেই শিক্ষা প্রতিফলিত হয়, তাহলেই বিরাট সমস্যা। ঋদ্ধিরা প্রতি ক্ষেত্রেই দেখল, গড়পড়তা বেশিরভাগ পরিবারে আজও ব্যক্তিত্বহীন ও প্রশ্নহীন মেয়েদেরই প্রভূত কদর। তারা অবাক হল দেখে যে বেশিরভাগ পুরুষই গতানুগতিক কিছু সুখ আর ঐশ্বর্যের ডালি অবলা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে আত্নতৃপ্তি লাভ করতে চায়; উভয়ের মিলিত প্রয়াসে উভয়েই যে একে অপরকে সুখী করতে পারে সেই concept নেই কারোর মনে। এছাড়া মুশকিল হল, সে বা তার বাবা কেউ ই নিজেদের কাজের বিজ্ঞাপন দিতে জানে না,তাদের ধারণা হল মানুষ হিসাবে যা যা করতে পারে তা তো মানুষেরই স্বাভাবিক কর্ম, এ সব আবার ঢাক বাজিয়ে লোককে বলার কী আছে! এদিকে সময়-কার্যের অঙ্কের পরিমাপে সকল পাত্রপক্ষ মাপতে চাইল মেয়েটাকে। তাই কেউ ই তার যথার্থ মূল্যায়ন করে উঠতে পারল না; প্রত্যেকবার পাত্র পক্ষের সাথে মানসিক দ্বন্দ্বে খসে পড়তে লাগল ঋদ্ধির অন্তরে লালিত হওয়া ভালোবাসার ঘরের এক একটা ইঁট। অবশেষে বাপ-মেয়েকে রণে ভঙ্গ দিতে হল। মেয়ের জন্য নিলয় বাবুর চিন্তা হত ঠিকই কিন্তু বুঝতেন, তিনি তো মেয়েকে ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষা দিয়েই বড়ো করেছেন;সে আজ শুধু ঘরের বউ হওয়ায় সীমিত গুনাবলী নিয়ে চলবে কীভাবে! বিয়ে না করলেও আক্ষেপ ছিল না, বাবা-মেয়ের সংসার আর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে আনন্দেই কাটিয়ে দিল ঋদ্ধি পঁচিশটা বছর। কিন্তু কালের করাঘাত সকলের দরজাতেই যে পড়তে বাধ্য। পঞ্চান্ন বছর বয়সে শোকের করাল ছায়া নেমে এল তার জীবনে; ৭৯ বছরের বৃদ্ধ নিলয় বাবু হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলেন। আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হল না ঋদ্ধিকে; বাবার জমানো টাকা ছিল আর তাছাড়া তাঁর ওপর নির্ভরশীল অবিবাহিত মেয়ে হিসাবে অর্ধেক পেনশন ও পেতে লাগল সে। কিন্তু গভীর এক শূন্যতা জমতে লাগল তার চোখের তলায়। ফাঁকা বাড়িটা যেন গিলতে আসে তাকে; চতুর্দিক থেকে ছুটে আসে বাবার স্মৃতির মধ্যে বাস করেও বাবাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা। বাবা যে ছিল তার আশ্রয়, অবলম্বন, বন্ধু- সবকিছু। তাছাড়া বাবা চলে যাওয়ার পর সে খেয়াল করল তারও বয়স হচ্ছে; নিজের শরীর, মন,কর্মক্ষমতা কোনো কিছুই আর আগের মতো পুরোটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। কাজে ডুবে থেকেও নিস্তার পেল না যখন, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় অন্য ভাবে খুঁজে নিল।
বাড়ি বিক্রি করে ঋদ্ধি চলে এল তার নতুন ঠিকানায়; সাঁঝবাতি বৃদ্ধাশ্রমের একটা খোলা মেলা ঘর তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। এই বৃদ্ধাশ্রমটি ঋদ্ধির বিশেষ পছন্দ হল কারণ এদের সাথে ঋদ্ধিদের এন.জি.ও-র collaboration এ কিছু কাজ করার কথা চলছে আর এরা ধনী-দরিদ্রের ভেদ করে না। আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ যেসব মানুষ এখানে স্বেচ্ছায় থাকতে আসে তাদের যেমন যত্মে রাখা হয় আবার কোনো এন.জি.ও থেকে পাঠানো অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেও একই রকম আদরে তারা গ্ৰহন করে। ঋদ্ধির যখন-তখন বাইরে গিয়ে কাজ-কর্ম করার ব্যাপারেও এরা কোনো বাধা দেয়নি বরং স্বেচ্ছায় বেশ মোটা অঙ্কের টাকা গচ্ছিত রাখার বিনিময়ে এখানে সে পেতে চলেছে নতুন জীবন,নতুন বন্ধু তথা সহকর্মী, সহমর্মি কয়েকজন পরিচারিকা,এমনকি আজীবন দেখ-ভালের অঙ্গীকারও আর যা পাওয়ার কথা ছিল না,প্রথম দিন নতুন ঘরে ঢুকে দেখল তাকেও পেয়েছে;তার ঘর লাগোয়া একফালি বারান্দায় একটা টবে উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যামালতী।
সাঁঝবাতিতে প্রথম যখন যোগাযোগ করেছিল তখন কর্ণধারের নাম দেখেছিল সীমা রায় আর অফিসিয়াল সব কাজ-কর্ম করেছিল এক ম্যানেজার। যেদিন প্রথম আসে এখানে সেদিন সন্ধ্যায় নিজের ঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে বারান্দায় বসে ছিল ঋদ্ধি চেয়ারে গা এলিয়ে। তার বারান্দায় একটা টবে টকটকে গোলাপি সন্ধ্যামালতী ফুটে আছে; এটা খুবই অপ্রত্যাশিত এক প্রাপ্তি ঋদ্ধির কাছে। দরজাটা আলগা ভাবেই দেওয়া ছিল। হঠাৎ একটা পুরুষ কন্ঠ বলল, “আসতে পারি?” ঋদ্ধি দরজার পাল্লা সরাতেই দেখল সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা প্রায় ষাট বছর বয়সী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। দেখা মাত্রই বহু বছর আগের সেই ঝাপসা হওয়া মুখটা যেন জেগে উঠল বুকের ভিতর। কিন্তু একী! চোখের নিষ্প্রভ অস্বাভাবিক চাহনি তো বলছে ইনি দৃষ্টিহীন। ঋদ্ধি তাকে ভিতরে আসতে বলল। হাতের লাঠিকে ভরসা করে ভিতরে এসে বসলেন ভদ্রলোক। বিহ্বলতা কাটিয়ে প্রশ্ন করল ঋদ্ধি, “আপনি কি…” তার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর এল, “হ্যাঁ আমি তপোময় রায়। আপনার অ্যাপলিকেশন ফর্মটি যখন ম্যানেজার বাবু পড়ে শোনাচ্ছিলেন তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আপনি মাষ্টার মশাইয়ের মেয়ে। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আবার যে কখনো দেখা হবে সেটা really astonishing;” এই পর্যন্ত বলে স্মিত হাসি মুখে এনে তপোময় আবার বলল, “যদিও আমি আর দেখতে পাই না, তবু জীবন যখন সময় দিয়েছে, কয়েকটা কথা বলার সুযোগ হারাতে আমার ইচ্ছা করল না। “নিজের সাবলীল আচরনে মনে মনে অবাক হয় তপোময়;আসার আগেও বহুবার ইতস্তত করেছে। ভাবতে পারেনি সেই চল্লিশ বছর আগে প্রথম ও শেষ দেখা হওয়া মানুষটার সাথে এতটা সচ্ছন্দে কথা বলতে পারবে। হয়তো বাস্তব আর মনের জার্নি আলাদা পথে চলে বলেই এমনটা সম্ভব হল। ক্লান্ত পায়ে মুখোমুখি চেয়ারে এসে বসল ঋদ্ধি। ক্ষনিকের নীরবতার পরে বলল, “আপনার চোখ…..কী করে হল এমন?” উত্তরে তপোময় যা বললেন ঋদ্ধির কাছে তা ছিল চরম অপ্রত্যাশিত।
সেদিনের সেই একটুকরো বিকেল তপোময়ের মনকেও রাঙিয়ে ছিল গোলাপি আভায়। কলেজের পড়াশোনা আর ক্রিকেট খেলার ফাঁকে মাঝে মাঝেই চোখের ওপর ভেসে উঠত মাষ্টারমশাইয়ের মেয়ের দুপাশে বেনী ঝোলানো মুখটা। চাকরির পড়া শুরু হতেই গ্ৰামে কাকার বাড়িতে আসা তার বন্ধই হয়ে গেল। আ্যপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েই ঠিক করেছিল আগামী রবিবারই যাবে গ্ৰামে; বুকে যতটা সাহস আছে সবটা একত্র করে মাষ্টারমশাই কে বলেই ফেলবে মনের কথা আর তিনি মত দিলে তবেই জানাবে নিজের বাড়িতে। আসার পথে এক ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আঘাত লাগে তার মাথায়; দীর্ঘকাল হাসপাতালে থেকে শরীরের বাকি জখমগুলো নিরাময় হলেও দুটো চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে এবং কয়েক মাসের মধ্যে সে পুরোপুরি দৃষ্টিহীন হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় জীবন যুদ্ধের অন্য এক অধ্যায়। কয়েক মুহুর্তের নীরবতায় নিজেকে সামলে নিয়ে আহত ধীরু স্বরে ঋদ্ধি বলে, “আপনি তার পরেও আর কেন যোগাযোগ করলেন না? আমার ও যে সারাটা জীবন এই একই অপেক্ষায় কেটে গেছে; আপনি জানেন না বাবা কত চেষ্টা করেছিলেন আপনার সাথে যোগাযোগ করার। “দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপোময় উত্তর দিল, “আসলে নতুন করে কারোর বোঝা হতে চাইনি। নিজের জীবন নিয়ে নিজে কী করব সেটারই ঠিক ছিল না। সম্পূর্ণ নতুন জীবনকে অ্যাকসেপ্ট করে নিজেকে নতুন করে আবার গড়ে তুলতে অনেকটা সময় লেগে গেল। জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও পাল্টে গেল। ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতার যন্ত্রণা পেরোতে গিয়ে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠল। শেষে, মায়ের তত্তাবধানে এই বৃদ্ধাশ্রম খোলার সিদ্ধান্ত নিই; ব্যবসায়িক লাভের জন্য নয়,অসহায় মানুষদের পাশে থাকার জন্য। আমি কয়েকটি কলেজের গেস্ট লেকচারার পদে আছি। তাই আমার গ্ৰাসাচ্ছাদন হয়েই যায়। “হতাশার সুরে ঋদ্ধি বলল, “আপনি কারোর বোঝা হতে চাইলেন না, অথচ আজ দেখুন নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা, কর্মের আনন্দ আর আশ্রয় চাইতে আমিই এসেছি আপনার দ্বারে।” কথাটা শেষ করতেই গলা বুজে আসে ঋদ্ধির। সেই বিকেলের মতোই মায়াময় অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে তপোময়, “এসব যে আপনার অধিকার স্বরূপই প্রাপ্য। তখন পারিনি অর্পণ করতে, আজ অন্তত গ্ৰহণ করুন। আপনার চেকটা কিন্তু ফিরিয়ে নিতে হবে। জীবনের এই শেষ বেলায় এসে যেটুকু দেওয়া-নেওয়ার আছে তা না হয় আমরা আমাদের কর্মযজ্ঞেই আহুতি দেব!”মনের ভিতরে চলা চরম আন্দোলনে কথা ফোটে না ঋদ্ধির মুখে; জীবনের এই প্রান্তিকে পৌঁছে তারা দুজনেই যেন দুজনের সামনে ‘অবাক করা উপহার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু ইতস্তত করে ফের বুক ভরে শ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করে তপোময়, “সন্ধ্যামালতীর টবটা পছন্দ হয়েছে? ” স্মিত হাসিতে উপচে পরে ঋদ্ধির চোখের জল, মৃদু স্বরে বলে, “খুব পছন্দ হয়েছে।” প্রশান্তির আলো ছড়িয়ে পড়ে তপোময়ের চোখে-মুখে, যার প্রতিফলনের আভা ছুঁয়ে যায় ঋদ্ধির চোখকেও। নতুন করে দেওয়া-নেওয়া শুরু হয় সমস্ত রুদ্ধ আবেগের, সকল জমে থাকা কথার। দিনের আলোয় গুটিয়ে যাওয়া সন্ধ্যামালতীর পাপড়িগুলো জেগে উঠতে থাকে বারান্দার নরম অন্ধকারে, আর ঘরময় ছড়িয়ে দিতে থাকে আদুরে সুবাস।
Golpo lekha sohoj noi.sohoj jinish ke golpo kore tola, jar mone golpo ache tarai bolte pare.tor lekha sabolil o sochol r sohojato.valo laglo pore.erokom aro likhe ja.onek valobasha roilo.
অনেক ধন্যবাদ দাদা।