সম্পাদকীয়, অক্টোবর ২০২৩

দুপুর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যস্ততা। বাড়িতে বাড়িতে মা মাসিদের দম ফেলবার সময় নেই। বিকেলে মাকে বরণ করবার আগে বিজয়ার প্রস্তুতিটা সেরে রাখতে হবে না। বিসর্জন হলেই তো বাড়িতে বাড়িতে মানুষের ঢল। বছরকার দিনে তখন তাদের মুখে কিছু দিতে হবে না? তাই তো ময়দা মেখে চলছে শেষ বেলায় কুচো নিমকিতে কুঁচির কাজ। নারকেল কুরানোর চেনা আওয়াজে এদিক ওদিক মুখরিত। একটু পরেই হাতে হাতে তৈরি হবে নাড়ু অথবা ছাপা (ছাঁচে ফেলা নারকেলের সন্দেশ)। বাড়ির ছোটরা এদিক ওদিক ঘুরছে আর মাঝে মধ্যেই সদ্য তৈরি হওয়া কুচো নিমকি মুখে পুরছে। প্রশ্রয় জড়ানো বকুনি মায়ের, ‘সব শেষ করে দিস না, লোকে এলে কি দেব?’ এর মধ্যেই ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে বুট বা মটর। সন্ধেয় গরম গরম ঘুগনি তৈরি হবে।

ব্যস্ত বাবাও, দোকান থেকে মিষ্টি আনাটা কি চাট্টিখানি ব্যাপার। সকাল থেকে মিষ্টির দোকানে মাছি গলবার জো নেই। তারই মাঝে লড়াই করে একটু মিহিদানা, বোঁদে, নিকুতি নিয়ে সদ্য বাড়ি ফিরে গর্বের হাসি দিচ্ছেন। চারটে বাজতেই শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি, বরণ করতে যেতে হবে। সন্ধে নাগাদ সিঁদুর খেলা সেরে হাসিতে হিল্লোল তুলে বাড়ি ফিরল মায়েরা। লাল পাড় সাদা শাড়িতে ছেড়ে, মুখে লাগা সিঁদুর তুলে এবার একটু হাল্কা সাজার পালা। তারপর নদীর ঘাটে বিসর্জন দেখতে যাওয়া। একের পর এক প্রতিমা বিসর্জন হবে, সার দিয়ে সকলে দাঁড়িয়ে, প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা আসছে পর পর মিছিল করে। তখন তো কার্নিভাল কথাটা কেউ জানতাম না, তাহলে সেটাই বলতাম। প্রায় একই দিনে অধিকাংশ ঠাকুরই বিসর্জন দেওয়া হত। প্রথম বিসর্জন দেওয়া হল জমিদার বাড়ির ঠাকুর। শুরু হয়ে গেল বিজয়া দশমী।

বিসর্জন দেখে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই শুরু হয়ে গেল এর ওর আনাগোনা। কোলাকুলি, প্রণাম তার পরে প্লেট সাজিয়ে নোনতা মিষ্টির আসা যাওয়া। সব মিলিয়ে বেশ একটা বিজয়া বিজয়া ব্যাপার স্যাপার আর কি। পরের দিন সকাল থেকে আরও ব্যস্ততা। আমাদের ছোটদের তো মহানন্দ, প্রায় সারাদিনই শুধু প্রণাম  আর খাওয়া দাওয়া। যে বাড়িতেই যাচ্ছি প্লেট ভরে খেতে দিচ্ছে, সে এক সম্মানেরও ব্যাপার বটে। শুধু পরিচিত নয়, অপরিচিতদেরও আসতে দেখতাম বিজয়া করতে। তখনই হয়ে যেত পরিচয়। বহু দিনের মনোমালিন্য থাকলেও বিজয়ায় দেখা হলেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে দ্বিধা করতেন না কেউই। বিজয়া যেন প্রকৃত অর্থেই মিলনোৎসব। দু-তিনটি দিন সত্যিই এক আনন্দে ভেসে যেতাম সকলে। যদিও প্রায় কালীপুজো পর্যন্তই থাকত বিজয়া করবার রেওয়াজ।

বিজয়া এখনও আসে। এখনও ভেসে যাই, তবে আনন্দে নয়, মোবাইলে মেসেজের বন্যায়। ভাল খারাপ জানি না, তবুও রীতিটুকু আছে এটাই স্বস্তি দেয়। তবে খুব মিস করি ওই দিনগুলি। সেই ব্যস্ততা, সেই খাওয়া দাওয়া। এখন তো রাস্তায় বেরিয়েও খুব পরিচিত ছাড়া কাউকে শুভ বিজয়া বলতে শুনিনা। কোলাকুলি বা প্রণাম তো দূরেই থাক। আমার ফ্ল্যাটে থাকা ছোটরাও আমাকে হোয়াটসএপে প্রণাম জানায়। আমিও মেসেঞ্জারেই কোলাকুলি করে নিই পাশের দরজার প্রতিবেশীর সঙ্গে।

মিষ্টির দোকানে এখন নারকেলের নাড়ু, কুচো নিমকি পাওয়া যায়। কিন্তু মা মাসিদের হাতে তৈরি সেই নাড়ু নিমকির স্বর্গীয় স্বাদ কি আর ফিরে আসবে? বোধ হয় না, কিছু জিনিস কালের নিয়মেই হারিয়ে যায়। আমাদের বিজয়াও বোধ হয় তেমনই। অনেক দিন আগেই হয় তো বিসর্জন হয়ে গিয়েছে আমাদের সেই পরিচিত বিজয়ার। এবার নতুনের পালা…

পুজোর শুরুতেই বিজয়ার কথা বলে বিষাদ এনে দিলাম বোধহয়, কিছু মনে করবেন না। পুজো এলে একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি। বয়স হচ্ছে বুঝতে পারি। যাই হোক সকলে ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। অবেক্ষণ পরিবারের তরফ থেকে অনেক ভালবাসা রইল।   

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + five =