সম্পাদকীয়, জুন ২০২২
দিন কয়েক আগে গায়িকা জোজোর একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরে রীতি মত শোরগোল। সেই পোস্টে জোজো উত্তরবঙ্গে পাহাড়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে রিশপ থেকে যে ছবি পোস্ট করেছেন সেই ছবির লোকেশনে জ্বলজ্বল করছে গোর্খাল্যান্ড কথাটি। সেই দেখে তো বাঙালিকুলের বেজায় রাগ, যার ফলে জোজো দেবীকেও বেশ কিছু কথা শোনাতে কেউ ছাড়েননি। জোজো যে এতে পুরোটাই দোষী সেটা বলা মুশকিল আবার দোষ যে নেই সেটাও বলা যাবে না। এই হেয়ালিটা একটু স্পষ্ট করা দরকার। ফেসবুকে লোকেশন ট্যাগ করবার সময় রিশপ দিলে যে বিকল্পগুলি দেখায় তাতে প্রথমটিই হল রিশপ, গোর্খাল্যান্ড, ইন্ডিয়া তার পরে ওয়েস্ট বেঙ্গল আসে। অর্থাৎ গোর্খাল্যান্ড কথাটি প্রথমে আসে। জোজো এখানেই ভুলটি করেছিলেন। লোকেশন ট্যাগ করবার সময় খেয়াল করেননি হয়তো। কিন্তু একটু সতর্ক হলে এই ভুলটা হত না, কারন এর পরে লোকেশনে যে বিকল্পগুলি আসে তাতে অবশ্য রিশপের পরে কোথাও কালিম্পং, কোথাও ওয়েস্ট বেঙ্গল কথাটিই আসে। পরেরগুলি নিলেই তাকে এত কথা শুনতে হত না। আরও একটা কথা না বললেই নয় গুগল ম্যাপেও কিন্তু বাংলার পাহাড়ে গেলেই ইংরেজির সঙ্গে হিন্দি লেখা দেখায়। পশ্চিমবঙ্গের সীমাতে থাকা স্বত্বেও বাংলা গুগলও অফ করে রেখেছে পাহাড়ের ম্যাপে।
জোজোর মত আমিও কদিন আগেই ঘুরে এলাম পাহাড় থেকে। কিন্তু শিলিগুড়ি ছেড়ে গাড়ি সামান্য ওঠার পর থেকেই মনে হয়নি আমি পশ্চিমবঙ্গের কোথাও বেড়াতে এসেছি। ভূপ্রকৃতিগত পার্থক্য তো আছেই, ভাষা সংস্কৃতি সভ্যতা সবেতেই আমাদের থেকে অনেকটা ফারাক। পাহাড়ের মানুষগুলি ভাল না মন্দ সেটা নিয়ে কিন্তু এই আলোচনা নয়। কথাটা হচ্ছে বাংলার রানি বলে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও বাংলা সেখানে কতটুকু আছে? দার্জিলিং সহ পাহাড়ে কেউই বাংলায় তেমন কথা বলতে চান না। আমাদের বাঙালিদের যদিও এতে তেমন সমস্যা কিছু হয়না, কারন তারা যে কোনও ছুতোয় হিন্দি বলতে পারলে বেঁচে যান। তাই তাদের অসুবিধে না হলেও আমার একটু দৃষ্টিকটু লেগেছে। আমি পাহাড়ে এই প্রথম গেলাম এমনটা নয়, আর আগেও বেশ কয়েকবার পাহাড়ে গেছি, এবার অবশ্য বছর তিনেক পরে গেলাম। কিন্তু হিন্দি ভাষার আধিক্য এবার যেন বেশি করে চোখে পড়ল। এর আগে কিন্তু পাহাড়ের মানুষকে দেখেছি বাংলা বলার চেষ্টা করতে, এবারে সেই আন্তরিক ইচ্ছেটা অনুপস্থিত মনে হল। কেউ কেউ বলতেই পারেন তাদের অন্য অভিজ্ঞতা, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আমি জানালাম মাত্র।
পাহাড়ের অন্য কোথাও তো দূরস্ত, খোদ দার্জিলিঙেও কিন্তু বাংলায় লেখা সাইন বোর্ড খুঁজে বের করা কঠিন। যে দু একটি বাংলা বোর্ড আপনি পাবেন সেগুলি শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে, যেমন “এখানে বাঙালি খাবার পাওয়া যায়”, “বাম্পার সেল” ইত্যাদি কিছু কথা। সরকারি বোর্ডেও বাংলা নেই বললেই চলে। একমাত্র বিশ্ববাংলার স্টলে দেখলাম বাংলায় কথাটা লেখা। এমন দুচারটি বাংলা বোর্ড আপনি কাশ্মীর, হিমাচল, হরিদ্বার গেলেও পাবেন। সেখানকার কিছু মানুষও ব্যবসায়িক স্বার্থে বাংলা শিখে নিয়েছে। কিন্তু বাংলার পাহাড়ে যেখানে সিংহভাগ বাঙালি যান সেখানেই বাংলায় কথা বলার বা শোনার প্রবণতা কমছে। আরও একটা জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলাম কোনও দোকানের সাইনবোর্ডে পশ্চিমবঙ্গ কথাটি নেই। দার্জিলিং পর্যন্ত এসেই পিন কোড দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ আবার একটু এগিয়ে গোর্খাল্যান্ড কথাটি লিখে রেখেছেন তার দোকানের বোর্ডে। যারা জোজোকে ট্রোল করেছেন, তারা কি এই দোকানমালিকদের কিছু বলতে পারবেন? হয়তো তারাই জোজোকে কটাক্ষ করেছেন যারা পশ্চিমবঙ্গ কথাটি বেমালুম হজম করে গোর্খাল্যান্ড লেখা বোর্ড থাকা দোকানগুলি থেকে মনপ্রাণ ভরে বাজার সেরেছেন।
পাহাড়ে গিয়ে যেটা দেখে একটু হলেও পশ্চিমবঙ্গ মনে হচ্ছিল তা হল আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কিছু ছবি। গ্রামের দিকে খুব না হলেও দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং এর মত শহরে মাঝে মধ্যেই দেখা মিলবে হাসিমুখে মুখ্যমন্ত্রীর। পাহাড় হাসছে কিনা জানিনা, তবে মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গাতেই হাসছেন। কিন্তু মজার কথা বিভিন্ন গাড়িচালক, হোটেল কর্মী, স্থানীয় দোকানদার, ব্যবসায়ী, বাসিন্দা অনেকের সঙ্গেই কথা বলার পরেও এমন কাউকে পাইনি যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করেন। প্রায় সকলেরই এক কথা, মমতাজি এখানে নাটক করতে আসেন। ভাবুন তাহলে। জানি তৃণমূল কর্মীরা মোটেই খুশি হবেন না, কিন্তু আমার অনুরোধ থাকবে আপনারাও পাহাড় বেড়াতে গিয়ে নিজস্ব পরিচিতি না ব্যক্ত করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। একটা আশার কথাও এক্ষেত্রে আছে। বিমল গুরুংকেও কিন্তু এই সকল মানুষ আর পছন্দ করছেন না। তারা সাফ জানালেন বিমল চোর, বিশ্বাসঘাতক, তাই তাকে ভরসা করবার প্রশ্নই ওঠে না। তাই পাহাড়ের মানুষ এখন নেতা নির্বাচনে বেশ সাবধান। সামনে জিটিএ ভোট নিয়েও দেখলাম তারা বেশ দ্বিধাবিভক্ত। মোট কথা পাহাড়ের রাজনীতি এখন ঝড়ের আগে থমথমে অবস্থার মত। সেখানেই ঘোলা জলে মাছ ধরছে বিজেপি। মমতা বার বার পাহাড়ে গিয়েও সেখানকার মানুষের মন যে জয় করে উঠতে পারেননি তা বেশ অনুভব করলাম, পাশাপাশি এটাও বুঝলাম পাহাড়ের মানুষ এখন রাজনৈতিক অভিভাবকহীন।
পাহাড় বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাহাড়কে আমাদের থেকে আলাদা করতে পারবে না কেউই। এসব কথা শুনতে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু তলে তলে পাহাড় যে আমাদের থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে তা বোধহয় জানেন প্রশাসনিক কর্তা বা নেতারাও। তাই তো তারাও সমাধানের নামে গোর্খাল্যান্ড ( জিটিএ ) কথাটিতে সিলমোহর দিয়েছেন অনেক আগেই। পাহাড়ে রোজগারের ভরসা পর্যটন, যার সিংহ ভাগটাই বাঙালিরা ভরিয়ে রেখেছেন। কিন্তু বাংলাবিহীন পাহাড়কে বাংলার রানি বলে কতদিন মনকে স্বান্তনা দেওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে ফল্গুধারায়।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ