সম্পাদকীয় (ডিসেম্বর, ২০২০)
গড়বেতা শহরের পাশে আমলাগোড়া গ্রামের এই দোকানটিতে ব্যপক বিক্রি। এই দোকানের সিঙ্গাড়া এবং জিলিপি আমার খুব প্রিয়। ছোট্ট দোকান, তিন ভাই বোনে চালান। সেদিনও দোকানে ঢুকে অভ্যস্ত গলায় কুশল বিনিময়ের পর সিঙ্গাড়া চাইতেই ধাক্কাটা খেলাম। দোকানের দাদা খুব বিনীত গলায় জানালেন “আলু মিলছে না পলাশদা, তাই সিঙ্গাড়া এখন বন্ধ রেখেছি”। হতবাক আমি। বলে কি? দোকানেই সামনেই হিমঘর, আলুর শহরে আলু মিলছে না? জানা গেল মিলছে কিন্তু সেখানেও পঞ্চাশ টাকা কেজি।তাই এত টাকা দিয়ে গ্রামের দোকানের পক্ষে আলু দিয়ে সিঙ্গাড়া করে চার টাকা বা পাঁচ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি করা কঠিন, বেশি দাম করলে কেউ কিনবেও না। উভয় সংকটে পড়েই সিঙ্গাড়া ধর্মঘট।
চন্দ্রকোনা এবং গড়বেতা, দুটি জায়গাই আলুর শহর বলে খ্যাত। দু ডজন মত হিমঘর আছে এই এলাকায়। মাঠে মাঠে আলুর রবরবা। এবার আলু কেজিতে পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের কাছেই শুনছিলাম হিমঘরে আলু রাখার সময় তারা কিন্তু সর্বচ্চো ১৫ টাকা কেজি দরে আলু দিয়েছেন। এখনকার এই আকাশ ছোঁয়া দরে তাদের কিছুই যায় আসে না। সেই আলুর দেশেই এখন আলু মহার্ঘ্য।
মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে হাতিহলকা গ্রাম। কংসাবতীর ধারে সার দিয়ে সবজি এবং ফুলের ক্ষেত। নদীর শোভা দেখতে সেই ক্ষেতের মধ্যে দিয়েই নেমে গিয়েছি আমি। মাঠে কাজ করছিলেন বেশ কয়েকজন কৃষক। তারই মধ্যে একজন আমায় দেখে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন। পরিধান বা পরিচ্ছদে শহুরে অহং দেখা না গেলে এখনও গাঁয়ের মানুষগুলি যেচেই কথা বলেন। প্রত্যাশিত ভাবেই সেই কৃষক আমায় ডেকে কোত্থেকে আসছি তা জানতে চাইলেন। তারপরে একটা দুটো থেকে অনেক কথা, এগিয়ে এলেন অন্যরাও। সকলেই প্রায় প্রৌঢ়ত্বের কোটা ছাড়াতে চলেছেন। অধিকাংশেরই ছেলেরা বাইরে চলে গিয়েছে অন্য চাকরির সন্ধানে, চাষে তাদের মন নেই। দুঃখ ঝরে পড়ল তাদের গলায়, আশঙ্কা ঘিরে ধরল আমায়।
সিঙ্গুর কাণ্ডের সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তার ভাষণে প্রায়শই বলতেন – “চাষির ছেলে কি শুধু চাষিই হবে? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কিছু হবে না?” হবে তো নিশ্চয়, হচ্ছেও তো। কিন্তু এই বক্তব্য থেকে একটা বিষয় পরিস্কার, আমাদের কাছে কৃষক বা কৃষি কাজ সেই মর্যাদা পায়নি। তাই ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হলে, ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হলে সেটা গর্বের, কিন্তু কৃষকের ছেলে কৃষক হলে সেটা কাম্য নয়। এবার প্রশ্ন হল কৃষক তাহলে হবে কে? কৃষকের ছেলে মেয়েরাই যদি কৃষি কাজ করতে না চায় অগৌরবের পেশা বলে, তবে তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, নিদেন পক্ষে কেরানীর ছেলেও নিশ্চয় স্বেচ্ছায় কৃষি কাজে এগিয়ে আসবে না, এ কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
আশঙ্কাটা দানা বাঁধে এখান থেকেই। আমরা জানি উৎপাদনের পরিমানে বা পরিমাপে দামেরও ওঠানামা হয়। এবার ধীরে ধীরে দেশে কমছে কৃষক। গত কুড়ি বছরে আমাদের দেশে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন ঋণ বা লোকসানের দায়ে। বাবা কাকাদের এই পরিণতি দেখে নতুন প্রজন্মও বিমুখ। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় গ্রামীণ ভোটারদের মোদী কথা দিয়েছিলেন চাষের খরচের ওপরে ৫০% লাভ রেখে সহায়ক মূল্য ধার্য হবে। আশ্বাসই সার, সহায়ক মূল্য শম্বুক গতিতে বেড়েছে। অন্য দিকে, চাষের খরচ বেড়েই চলেছে। চাষির লোকসানও। এক সমীক্ষার ফল বলছে, দেশের ৪০% কৃষক কৃষি ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে চান। এই যদি হাল হয় তবে তো সহজেই অনুমেয় আগামী দিনে কৃষির অবস্থা কি হবে। আর কৃষি বেহাল হলেই কৃষিজ পন্যের অবস্থাও যে আরও বেহাল হবে তা বলাই বাহুল্য।
অতএব সাধু সাবধান। আগামী প্রজন্ম সকলেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা অন্যান্য তথাকথিত সম্মানজনক, লোভনীয় পেশা বেছে নিতেই পারে, কিন্তু তাদের খাবারের যোগান কে দেবে সেটা কিন্তু চাপের বিষয়। যে চাপ এখন থেকেই পেতে শুরু করেছি আমরা।আজ সিঙ্গাড়ায় আলু জুটছে না, কাল গম ধান উৎপাদন ব্যহত হলে সিঙ্গাড়ার ছালটুকুও জুটবে না। এখনও সময় আছে, নিজে না করুন অন্তত কৃষককে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিন, কৃষিকে পেশা হিসেবে সম্মান দিন, নিজেরাও বাঁচবেন, বাঁচবে দেশও।
ভাল থাকবেন সকলে। এই দুঃসময়ে এটুকুই চাওয়া। এক অনাস্বাদিত কষ্টক্লিষ্ট বছর ছিল এই ২০২০। ২০২১ এর কাছে তাই আমাদের অনেক আশা, অনেক দাবি। নতুন বছরে উঠুক নতুন সূর্য, আসুক নতুন সুদিন। ফের কথা হবে আগামী বছরে, আগামী সংখ্যায়।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ