সম্পাদকীয়, মার্চ ২০২২

উত্তর প্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে ঘটে যাওয়া নির্বাচনে একটা বিষয় পরিষ্কার, মানুষ কংগ্রেসের পরে আর আস্থা রাখছেন না। এই নিয়ে বহু দিগগজেরা নানাবিধ মন্তব্য করেছেন, পাতার পর পাতা ভরিয়েছেন, তাই সেই চর্বিত চর্বনে যাব না। কিন্তু নির্বাচনকালে খুঁটিয়ে সংবাদপত্র পড়ার পর একটাই জিনিস চোখে লাগল এই সব এলাকায়, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে, ভাল মানুষ, ভাল কাজ এসব কোনও ফ্যাক্টরই না। মূল ভাবনা শুরুই হয় জাতকে ঘিরে। প্রার্থী নির্বাচনকে ঘিরে জাতপাত বা ধর্মের প্রাধান্যই গুরুত্ব পেয়েছে। গোটা নির্বাচন জুড়ে শুধু জাত এবং ধর্মের সমীকরণ, সেই অনুযায়ী প্রার্থী বাছাই। এখানে কাজ বা উন্নয়নের কোনও জায়গা নেই। এখনও নির্বাচন শেষে বিপুল ভাবে জয় পেয়েও বিজেপি নেতৃত্ব ধন্দে রয়েছেন তাদের হেরে যাওয়া উপমুখ্যমন্ত্রীকে ফের মন্ত্রী করা হবে কিনা তাই নিয়ে। এর পিছনেও সেই জাতের রাজনীতি। পরাজিত বিজেপি প্রার্থী তথা প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী মৌর্য ওবিসি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। অর্থাৎ মানুষটি খুব কাজের কিনা, তার চাইতেও জরুরী একটা সম্প্রদায়কে খুশি করা।

বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পর অনেককেই বলতে শুনেছিলাম বাংলার মানুষ এইসব জাতপাতের বা ধর্মের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেন না। শাসক দলের নেতারাও একই সুরে গলা ফাটিয়েছেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? বাংলাতেও রয়েছে প্রবল ধর্মীয় মেরুকরণ। ধর্ম বা জাতের ভিত্তিতে বাংলাতেও প্রার্থী বাছাই হয়েছে। যোগ্যতা থাক বা না থাক শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া পরিবারের সদস্য হওয়ায় সেই পরিবার থেকে একাধিক দলের প্রার্থী হয়েছেন সহজেই। মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী সকলেই এসে মাথা ঠুকেছেন সেখানে। সেই সম্প্রদায়ের মানুষ ৮০ টিরও বেশি বিধানসভায় নির্নায়কের ভূমিকা রাখেন। এটা জানা বা বোঝার পর সব দলই সেই বাড়ির সদস্যদের প্রার্থী করবার জন্য হত্যে দিয়েছেন, দিচ্ছেন। এটা ধর্মীয় মেরুকরণে ভোট নয়? বামেদের মত তথাকথিত উদারচিন্তার মানুষগুলি যখন শুধু মাত্র ভোটলাভের আশায় একটি অতি কট্টর সংখ্যালঘু সংগঠনের সঙ্গে হাত মেলায় তখন সেটা ধর্মীয় মেরুকরণ নয়? এগুলি মানুষও বোঝেন। কিন্তু বুঝেও তারা নিরূপায়। বিকল্প নেই।

হ্যা, এটাই সার সত্য। সঠিক বিকল্প নেই। বিজেপির মত একটি ধনী তোষণকারী দল, যারা খামখেয়ালিও বটে। তেলের দাম শিখরে তুলে দিয়ে কুম্ভীরাশ্রু নিক্ষেপ করছে, হঠাৎ খেয়ালে আট হাজার কোটি টাকার বিমান কিনে ফেলছে, কারও ইচ্ছায় কুড়ি হাজার কোটি খরচ করে নতুন সংসদ বানিয়ে ফেলছে করোনাকালে। তেমন দলকে খুব ভালবেসে সকলে ভোট দিয়েছেন বলে কি মনে হয়? কৃষক আন্দোলনে সব চেয়ে অগ্রণী ছিল পঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশ। সেখানকার কৃষকেরা কি এখনও ক্ষুব্ধ নন? কিন্তু, সঠিক বিকল্প কোথায়? বাংলা যেমন এর আগে বাম আমলের অত্যাচার, নিপীড়ন দেখেছে তেমনই উত্তরপ্রদেশও এর আগে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টির শাসন দেখেছে। কারও অসংখ্য সমাজবিরোধী প্রার্থী তো কেউ ক্ষমতায় এসে নিজের মুর্তি গড়ে মন্দির বানিয়েছেন। সুশাসনের পথে কেউ হাঁটেননি। তাই চেনা বিপদকে ফের আনার সাহস করতে চাননি অনেকেই। অন্য বিকল্প রইল কংগ্রেস, তার যে আর কোনও শক্তিই নেই তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। তাই পড়ে রইল বিজেপি। ঠিক যেমন ঘটেছে আমাদের রাজ্যে। বামেদের অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষ খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিকল্প বলতে তখন তারাই। কিন্তু আজ দশ বছর পরে যখন দেখা যাচ্ছে তৃণমূলও মুদ্রার ওপিঠ। তখন হাতে তেমন বিকল্প কই? বিজেপির শাসন তো কেন্দ্রে দেখেই মানুষ বুঝে গিয়েছে তাদের কাছ থেকে কি পেতে পারি। তাই বাংলাতেও পাল্টানোর সাহস মানুষ এবারে দেখাতে পারেনি।

 পেরেছে পঞ্জাব। তাদের কাছে কংগ্রেস বা বিজেপি ছাড়াও বিকল্প বলতে ছিল আপ। কংগ্রেসের নিজেদের মধ্যে লড়াই, সুশাসনে মন না দেওয়ায় পঞ্জাবের মানুষজন কিছুটা বিরক্ত ছিলেনই। তারাও একটা ঠিকঠাক বিকল্প খুঁজছিলেন। পাশের রাজ্যেই শাসন করা আপ কিছুটা ইতিবাচক প্রভাবও ফেলেছিল পঞ্জাবের মানুষের উপরে। তাই তারা বিকল্প বেছে নিতে দেরি করেননি। পঞ্জাব ভুল করেছে না ঠিক করেছে তা সময় বলবে। কিন্তু তারা একটা সুযোগ পেয়েছেন তার সদ্ব্যবহারও করেছেন। যেটা অন্য রাজ্যের মানুষেরা সেভাবে পাননি।

এ রাজ্যে আপ তাদের প্রভাব বিস্তার করবে কিনা তা সময়ই বলবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপ প্রধান কেজরিওয়ালের সম্পর্ক আপাতভাবে ভালই। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখার, আপ কিন্তু গোয়াতে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে রাজি হয়নি। একা লড়ে আসনও পেয়েছে তারা। তাই এ রাজ্যে দফতর করবার জন্য মধ্য কলকাতায় জায়গা দেখছে তারা এমন খবরও রটেছে। এ রাজ্যের কিছু মানুষও আপ নিয়ে আশাবাদী। আসলে এই ধর্মের মেরুকরণে রাজনীতি এবং জাতের দোহাই দিয়ে রাজনীতি দেখতে দেখতে সকলেই ক্লান্ত। সকলেই চান সুস্থ বিকল্প, কিন্তু সেটা কে, তা জানা নেই কারও। আপ কি? সে তো সময় বলবে। কিন্তু ততদিন…?       

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − ten =