সম্পাদকীয় (মে সংখ্যা)
আমরা এখন শাঁখের করাতের মুখে। আমাদের একদিকে করোনা, অন্যদিকে অনিশ্চিত অতি দুর্ভাবনাময় একটা ভবিষ্যতের আশঙ্কা। বাড়ির বাইরে পা রাখলেই চোখ রাঙাচ্ছে করোনাতঙ্ক, অন্যদিকে মাসের পর মাস বাড়িতে বসে থেকে সঞ্চয় শূন্য। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৭০% মানুষজন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। যেখানে সিংহ ভাগেরই দিন গেলে সেই রোজগারে খাওয়া জোটে। এখন তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গৃহবন্দী মানুষ, খাওয়া জুটবে কি করে? এটাই ভারতের এই সিংহ ভাগ মানুষের এক এবং এক চিন্তা। শুধু ভারত কেন পড়শি দেশ বাংলাদেশের অবস্থাটাও এর চেয়ে কিছু কম নিদারুণ নয়। থেমে আছে চাকা; যানবাহন, কলকারখানা সবকিছুরই। আধুনিক সমাজে চাকা বন্ধ মানে সভ্যতার একটা বড় অংশই স্তব্ধ। তাই তো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে করোনা থেকে রক্ষা পেলেও পরবর্তীতে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ রক্ষা পাবেন কি ভাবে? বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কারখানা, গুটিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা, লাটে উঠেছে ছোটখাটো কাজ করে দিন গুজরান করা মানুষগুলির রোজগার। গৃহবাসী হয়ে করোনা থেকে বেঁচে গেলেও, অনাহার, অপুষ্টি, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্দিনের ভাইরাসটা যে আরও জাঁকিয়ে বসবে, তখন…? বাড়বে হাহাকার, বাড়বে বেকারত্ব, বাড়বে চুরি ডাকাতি, বাড়বে হিংসা অপরাধ। আমরা তাই ঠিক শাঁখের করাতের মুখে।
তাবড় তাবড় দেশ পারেনি, করোনায় তাদের বেহাল দশা। তাদের কাছে ভারতের আক্রান্ত বা মৃত্যুর পরিসংখ্যান নগন্য। কিন্তু লকডাউনের মাঝেও ছড়িয়েছে রোগ। তাই আরও আরও বেশি করে লকডাউন, ঘরে আটকে রাখার পালা। কিন্তু লকডাউন না করেও যে এই রোগের মোকাবিলা সম্ভব সেটাও তো করে দেখিয়েছে কোনও কোনও দেশ, এবং তারা সফলতাও পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে সে কথা কেউ তো বলে না। খালি আমেরিকা, স্পেন, ব্রিটেন কেমন করে ব্যর্থ সেই পরিংখ্যান তুলে ধরেই বোঝানো হচ্ছে আমরা কত সফল সেটা।
চিনের পর প্রথম যে দেশগুলিতে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল করোনা, তাতে ইতালি ও ইরানের পাশাপাশি নাম ছিল দক্ষিণ কোরিয়ারও। ফেব্রুয়ারি মাসে সেই দেশে হু হু করে বাড়ছিল কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা। এখন কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব একেবারে নিয়ন্ত্রণে বলা যেতে পারে। ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ থেকে মার্চের ১২ তারিখ পর্যন্ত সে দেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছিল লক্ষ্যনীয় ভাবে। এরপরেই নামতে থাকে গ্রাফ, এখন তা প্রায় নেই বললেই চলে। এই লেখা পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্ত প্রায় ১১ হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন প্রায় ন হাজার মানুষ। মৃত্যু ২১৮ টি। এখানে কোথাও লকডাউন হয়নি।
আর একটি দেশের কথাও না বললেই নয়, ছোট দেশ কিন্তু তাদের কাজও শিক্ষণীয়। আশপাশের দেশে যখন জাঁকিয়ে বসেছে করোনা তখন ভিয়েতনামে এখনও পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৬৮ জন, যাদের মধ্যে ২২২ জন সুস্থ হয়ে গিয়েছেন, মৃত্যু নেই। আছে, আরও কিছু উদাহরণ নিশ্চয় আছে, দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তর্কের খাতিরে কেউ কেউ বলতেই পারেন দক্ষিণ কোরিয়া বা ভিয়েতনামের জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক কম। মানছি, কিন্তু এটাও বলব ওদের সদিচ্ছাটা আমাদের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এই দেশগুলি সতর্ক হয়েছে ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে শোনা মাত্রই। আন্তর্জাতিক উড়ান থেকে নামা মাত্রই কড়া পরীক্ষা করেছে সক্কলকে। একটু বেচাল দেখলেই হাসপাতাল। জনগনের মধ্যেও পরীক্ষার মাত্রা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। যার ফলও মিলেছে। লকডাউন না করেই তারা প্রায় করোনামুক্ত। পাশাপাশি আমাদের সতর্কতা এসেছে মার্চের মাঝামাঝি। আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ হয়েছে মার্চের শেষ সপ্তাহে। তখন তো যা হবার হয়েই গিয়েছে, মুখ বাঁচাতে তড়িঘড়ি লকডাউনের ঘোষণা। এর আগে অন্যদের দেখে শিখিনি আমরা। তার ফল এভাবেই ভোগ করতে হচ্ছে। হয়তো আমাদের যা জনসংখ্যা তার নিরিখে আক্রান্ত বা মৃত্যুর হার কম, কিন্তু দীর্ঘদিন এই লকডাউনের ফলে যে অন্য একটি ভাইরাসে আমরা আক্রান্ত হয়েছি বা হব, তার আক্রান্ত বা মৃত্যুর হার এর চেয়ে ঢের বেশি হবে তা বিশেষজ্ঞ না হলেও বলে দেওয়া যায়। তাই বলছিলাম, আমরা এখন শাঁখের করাতের মুখে। আসতে তো কাটছেই, যেতেও যা কাটবে তা জুড়তে সময় লাগবে বহুদিন থুড়ি বহু বছর।
ভাল থাকার চেষ্টা করবেন সকলে। আজ এই পর্যন্তই। কথা হবে সামনের সংখ্যা। আশা করি ততদিনে কেটে যাবে লকডাউন।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক
অবেক্ষণ