সম্পাদকীয়, রাখীপূর্ণিমা সংখ্যা ২০১৯

বিয়ে বাড়ি যাওয়া হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে। গিন্নি শাড়ি বাছছেন। হঠাৎ আমার ছেলে কয়েকটি পাঞ্জাবি নিয়ে এসে হাজির- “বাবা একটা পাঞ্জাবি চুনে দাও না”। আলগোছে শুনলাম পাঞ্জাবিতে চুন লেগেছে বোধহয়। কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই সহাস্য উত্তর “চুন লাগেনি, তুমি এর মধ্যে থেকে একটা চুনে দাও”। হঠাৎ মনে পড়ল শোলের সেই বিখ্যাত উক্তি – “চুন চুন কে মারুঙ্গা”। বুঝলাম বেছে দেওয়ার কথা বলছে আমার ছানা। এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ; আমার ভাগ্নে, ভাগ্নি, ভাইপো, ভাইজি, পরিচিত প্রায় সব শিশুকেই প্রায় এভাবে হিন্দি মিশিয়ে কথা বলতে শুনি। ওরা এখন আঠা দিয়ে কিছু লাগায় বা আটকায় না, চিপকে দেয়। ওরা এখন বিরক্ত হয় না, পরেশান হয়। ওদের এখন দুঃখ বা কষ্ট হয় না, তকলিফ হয়। আমার স্ত্রী প্রবাসী বাঙালি, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়া শোনা সবই ইংরেজি এবং হিন্দিতে। পড়শিদের সঙ্গেও হিন্দিতেও কথা বলতে হত। কিন্তু ওকেও আমি এমন অদ্ভুত হিন্দি মিশিয়ে কথা বলতে খুব একটা শুনিনি।

এখন তো কারন বলা বোধ হয় বারণ। তাই অনেককেই কথার মাঝে কারনের পরিবর্তে “কেন কি” বলতে শুনি। কেন কি কথাটা আমার কাছে নতুন নয়, বছর কুড়ি আগেই পুরুলিয়া, আসানসোল থাকতে এই কথাটা স্থানীয়দের মুখে শুনতাম। কিন্তু এই এলাকাগুলি তো প্রায় হিন্দি বহুল, তাই বহু হিন্দিভাষী মানুষ বাংলা বলার সময় তাদের হিন্দি “কিউ কি” কে “কেন কি”-তে পরিবর্তন করে বলতেন। কিন্তু আদতে বাংলা ভাষায় ওই জায়গায় এমন শব্দ ব্যবহার করা যে যায় না, সেটা কেউ তাদের বলেননি বলেই মনে হয়। বরং পরের দিকে সেটা কলকাতা, শহরতলি, মফঃস্বল, এমনকি একটু বড় গ্রামের দিকেও চালু হয়ে গিয়েছে।

ছোটদের এই হিন্দি প্রবণতার একটা বড় কারন মনে হয় টিভিতে কার্টুন বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের প্রায় নিরানব্বই শতাংশই হিন্দিতে দেখা। প্রিয় চরিত্র যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাবে আচরণ করে ছোটরা সেটাকেই অনুসরণ করে। আমাদের দুর্ভাগ্য বাংলা ভাষায় ছোটদের কোন আলাদা চ্যানেল নেই। যেখানে কার্টুন বা অন্যান্য অনুষ্ঠান বাংলার ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভাষায় দেখতে পাবে। কিছু কিছু চ্যানেলে সামান্য কিছু সময় বিক্ষিপ্ত ভাবে কার্টুন বাংলায় দেখানো হয় বটে তবে তার সময়ও কম, এবং গুণগত মানও অতটা ভাল নয়। তাই ছোটরা হিন্দিতেই বুঁদ হয়ে থাকে। আচ্ছা এত চ্যানেল আসছে বাংলা ভাষায়, একটা ছোটদের চ্যানেল কি কেউ করতে পারেন না? অথচ দক্ষিন এবং পশ্চিম ভারতে প্রায় সব চ্যানেলের কার্টুনই সেখানকার ভাষায় ডাব করে দেখানো হয়। ডিটিএইচগুলিতেও দক্ষিন ভারতীয় বিকল্প ভাষা থাকলেও বাংলা প্রায় নেই বললেই চলে।

এখন তো মাল্টিপ্লেক্সের জমানা। মোবাইল থেকে টুক করে টিকিট কেটে নিশ্চিন্তে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বসে পড়ার দিন। একটু কি কেউ খেয়াল করেছেন সব চেয়ে জনপ্রিয় টিকিট বিক্রেতা অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ‘বুক মাই শো’-র সাইটে বহু ভারতীয় ভাষার অপশন থাকলেও বাংলাটা নেই। অর্থাৎ ওরাও জেনে গেছে বাংলা ভাষা না থাকলেও কেউ কিছু বলবে না।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে অন্য ভাষার বিরোধী নই। ইংরেজি, হিন্দি, জার্মান, জাপান, রাশিয়ান যা কিছু যে কেউ শিখতে বা বলতেই পারেন। কিন্তু নিজের ভাষাকে অবহেলা করে নয়। এ যেন অনেকটা নিজের মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে শাশুড়িকে বাড়িতে বসিয়ে সেবা করবার মত। শাশুড়ি সেবা স্বাগত, কিন্তু সঙ্গে থাক মা-ও। আমরা কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেরাই জড়িয়ে যাচ্ছি এই হিন্দি ইংরেজির জালে। আমার এক আত্মীয়া খুব দুশ্চিন্তিত যে, আমার ছেলের গৃহশিক্ষক নাকি ছেলের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে না। সেটা কি খুব দরকার? বাড়িতে তো আমরা কেউই ছেলের সঙ্গে হিন্দিতেও কথা বলি না, প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু খানিক সময় শুনেই সে যদি ওই ভাষাটা শিখে নিতে পারে, তাহলে অন্য ভাষাও শিখে নিতে পারবে। বরং আসুন না ওরা যে মাধ্যমেই পড়ুক, আমরা বাড়িতে ওদের সঙ্গে একটু বাংলায় কথা বলি। বাংলাতেই ফুল ফল পাখি নদীর নাম চেনাই। নিজের ভাষাটাকে ওরাও একটু নিজের মত করেই জানুক না। ক্ষতি কি???

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × three =

preload imagepreload image