সম্পাদকীয়, আগস্ট ২০২১
যেটার আশঙ্কা ছিল সেটাই হয়েছে। পেগাসাস নামের একটা জুজু বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে পেট্রোপন্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সব প্রতিবাদের মিছিলকেই এখন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে পেট্রোপন্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলই প্রকৃত বিদ্রোহ করতে চায় না। কারন ক্ষমতায় এলে সব রাজনৈতিক দলেরই আয়বৃদ্ধির বড় উপায় হল পেট্রো পন্য। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ বিজেপি, যারা বিরোধী থাকাকালীন ইউপিএ আমলে পেট্রোপন্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যপক হইচই করেছিল আজ তারাই ক্ষমতায় এসে জ্বালানি তেল বা গ্যাসের দাম কোথায় তুলে দিয়েছে তা সকলেরই জানা। অন্যদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা একই রকমের। তাই জনগনের মন রাখতে পেট্রোল ডিজেল বা গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য প্রতিবাদ করলেও মন থেকে কোনও রাজনৈতিক দলই পেট্রোপন্যের জন্য আন্দোলনে উৎসাহী নয়।
লুকিয়ে অন্যের কথা শোনা অপরাধ। অন্যের ফোনে আড়ি পাতা সুস্থ গণতন্ত্রের বিপক্ষে। কিন্তু পেগাসাস ব্যাপারটাই একটু ধোঁয়াশায় মোড়া। শোনা গিয়েছে ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, এখনও ঠিক বিষয়টা কারও জানা নেই। তবু শুরু হয়ে গিয়েছে আন্দোলন। এ ব্যাপারে রহস্য বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্রও, তারাও কিছুতেই ব্যাপারটা খোলসা করছে না। আদৌ পেগাসাসের ব্যাপারটা সত্যি কিনা, কেন্দ্রের এই ব্যাপারে সত্যিই কোনও দায় বা ভূমিকা আছে কিনা, কিছুই স্পষ্ট করে বলছে না কেন্দ্র সরকার। এতেই রহস্য বেড়েছে। কারও কারও মতে কেন্দ্র ইচ্ছে করেই বিষয়টা নিয়ে খেলছে। কারণ পেগাসাস নিয়ে বিরোধীদের এই আন্দোলন, প্রতিবাদ কেন্দ্রের অন্য বহু জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে তলায় ফেলে উঠে এসেছে এক নম্বরে। এই আন্দোলন নিয়ে কেন্দ্রের খুব একটা ভয় নেই, কারণ তারা জানে সাধারণ মানুষের কাছে পেগাসাস খুব একটা নিত্য প্রয়োজনীয় ইস্যু নয়। খেটে খাওয়া আম জনতা ব্যাপারটা ভাল করে বোঝেই না। বরং পেট্রোপন্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অনেক বেশি প্রভাব পড়বে সাধারণের মনে। তাই কেন্দ্রও চায় পেগাসাসের পিছনে পড়েই সময় এবং জনসমর্থন নষ্ট করুক বিরোধীরা।
একটু খেয়াল করে দেখুন সামনে বছর দেড়েকের মধ্যে কোনও বড়সড় ভোট নেই। কেন্দ্রের বিজেপিও তাই নিশ্চিন্ত, বেপরোয়া। তাই তো এখনও থেমে নেই পেট্রোপন্যের দাম। পেট্রোলের দাম ১০০ ছাড়িয়েছে কবেই। এখন তা ১০২ টাকা পার করে ছুটছে। আরও কত দূর, কোথায় গিয়ে থামবে এই দৌড় কেউ জানে না। কেন্দ্র ভুলেও বলেনি তারা পেট্রোপন্যের দাম কমানোর ব্যাপারে ভাবছে। বাজারে সব জিনিসের দাম আগুন। কোভিড পরিস্থিতিতে বহু মানুষের খাওয়া জুটছে না। এই সময়ে ধীরে ধীরে পেট্রোপন্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আন্দোলন শুরু করেছিল বিভিন্ন বিরোধীদলগুলি। সাধারণ মানুষের পূর্ণ সমর্থনও ছিল সেই আন্দোলনে। কেন্দ্র বুঝতে পারছিল জনরোষ বাড়ছে, সুযোগ নিচ্ছে বিরোধীরা। সেই মুহূর্তেই বাজারে এসে পড়ল পেগাসাস। ব্যস… বিরোধীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, নিশ্চিন্ত হল কেন্দ্রও। সব আন্দোলন এখন পেগাসাসকে ঘিরে, আগ্রাসী পেট্রোপন্য চাপা পড়ে গিয়েছে ফোনে আড়ি পাতার চক্রান্তের নিচে।
এটাই তো চেয়েছিল কেন্দ্র। পেগাসাস ইস্যুতে শেষমেশ কি হতে পারে? প্রথমত কেন্দ্র তো স্বীকারই করবে না, প্রমাণ হলেও বড় জোড় একটু ক্ষমা চেয়েই ঝামেলা মুক্ত হয়ে যাবে। ভাবমুর্তিতে সামান্য কালি পড়লেও আর্থিক বা অন্যান্য ক্ষতি খুব একটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পেট্রোপন্য সোনার ডিম দেওয়া হাঁস। তাকে কেটে খাওয়ার ভুল কেন্দ্রের অতি ব্যবসায়ী সরকার করবে বলে ভুলেও ভাবা ঠিক হবে না। তাই পেগাসাস নিয়ে চলতে থাকুক গন্ডগোল, অচল হোক সংসদ। এই সুযোগে বাড়তে থাকুক তরল সোনার দাম। ভরতে থাকুক কেন্দ্রের ভাণ্ডার। কেন্দ্রের বিজেপি একটা কথা ভাল মতই বুঝে গিয়েছে দেশে তাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মত কোনও বড় জাতীয় দল এখন নেই, কিছু আঞ্চলিক দল আছে বটে, কিন্তু নানান স্থানীয় ইস্যুতে তারাও ছন্নছাড়া। তাই দেশে ঠিকঠাক বিরোধী দল এবং সামনে কোনও নির্বাচন না থাকার পরিপূর্ণ সুযোগ তারা নিচ্ছে। এলোমেলো বিরোধী দলগুলি এক হওয়ার চেষ্টা করলেও এক সঙ্গে এক ইস্যুতে বিরোধীতার মত অস্ত্র এখনও শানাতে সক্ষম হয়নি। এই তো চাই… বেনিয়া সরকার এটারই সুযোগ নিচ্ছে চেটেপুটে। তিলোত্তমা যেমন ছলাকলায় অসুরদের ভুলিয়ে দেবতাদের অমৃতপানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তেমনই কেন্দ্র বিরোধীদের পেগাসাস দেখিয়ে, তাই নিয়ে ব্যস্ত রেখে পেট্রোপন্যের আরও দাম বাড়িয়ে রাজকোষাগার ভরে চলেছে নিরন্তর, নিরুপদ্রবে, নিরুদ্বেগে।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ