সুখী মানুষ
কাব্যশ্রী মহন্ত
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ –বাসুদেব দাস ##
ভগবান দাসের মনটা হাজার অবসাদে ভরা। অফিসে সারাদিনের জন্য বসা চেয়ারটার হাতলে ঘুণে ধরার মতো দৈনন্দিন কাজের প্রতি থাকা তার উৎসাহেও ঘুণে ধরেছে। প্রতিদিন দশটার সময় কার্যালয়ে এসেই নিজের চেয়ারটার সামনে গিয়ে তাঁর বুকের কাছের একটা শিরা টনটন করে উঠে। এই একই চেয়ারে তিনি গত এগারো বছর ধরে বসছেন। তার আগের তেরো বছর তিনি তিনটে আলাদা আলাদা চেয়ারে বসতেন। কিন্তু চেয়ার আলাদা হলেও তাঁর দৈনন্দিন কাজের প্রকৃতিগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই চব্বিশ বছরের প্রতিদিনই তিনি অফিসে থাকার সময় একই ধরনের কিছু বাক্য বা বাক্যাংশ লিখে, টাইপ করে, ওপরওয়ালাকে দিয়ে অ্যাপ্রুভ করায়, ফাইলে পুট আপ করে, সই নিয়ে আসার পরে নির্দিষ্ট প্রফর্মায় তথ্য সন্নিবিষ্ট করে। সাড়ে এগারো বারোটার সময় সিঙ্গারা, নিমকি বা গজা সহযোগে এককাপ চা খান। তিনটে সাড়ে তিনটায় বাড়ি থেকে পরিবার একটা ছোট ডিবেয় ভরে দেওয়া শুকনো রুটি, আলু-পটল বা মাছ ভাজা দিয়ে খান এবং সন্ধ্যে পাঁচটার সময়…। সকাল দশটায় অফিসে ঢুকেই নিজের চেয়ারটা দেখে তাঁর ভয় লেগে যায়। চেয়ারটাকে তাঁর বাঘ-ভালুক বা একটা বন্য শুয়োরের মতো মনে হয়। তিনি যেন রূপকথার সেই মানুষটার মতো বন্য শুয়োরের লেজ ধরে ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে তাঁর ক্লান্ত লাগছে, কিন্তু ঘোরা ছেড়ে দিলেই সব শেষ।
সারা দিনের কাজের পরে ভগবান দাস যখন বাড়ি যায়, পরিবার তাকে কলা, বিস্কুট বা বাড়িতে তৈরি লাড্ডু-পিঠা সহযোগে এককাপ লাল চা খেতে দেয়। সকালে গোয়ালা দিয়ে যাওয়া দুধ ততক্ষণে শেষ। বিয়ের কয়েক বছর পরে পৈতৃক বাড়িতে একটু ভালোভাবে থাকব ভেবে নতুন করে তৈরি ঘর দুটি সম্পূর্ণ হতে হতে বড় ছেলে নবম শ্রেণিতে উঠে যায়। বৈঠকখানা ঘরে প্রতিদিন ভগবান দাস খবরের কাগজটা নিয়ে বসেন। একটা সময়ে তার মাথা ব্যথা করছে বলে মনে হতে থাকে। খুবই ক্লান্ত লাগতে থাকে। মনে হয়, পরিবার ভাত খেতে ডাকলেই ভাত খেয়ে তিনি শুয়ে পড়বেন। তার খুব শুতে ইচ্ছা করছে। তাঁর স্কুলে পড়া মেয়ে দুটি কখনও পড়া ছেড়ে টিভি দেখতে থাকে। কখন ও বা খিক খিক করে হাসতে হাসতে কথা বলে। তিনি কিছুই বলেন না। ভাত খাবার পরে তার একান্তভাবে কাম্য হয়ে পড়ে বিছানাটা। পার্থিব সমস্ত দুঃখ ভাবনা ছেড়ে তিনি বালিশে মুখ রেখে শুয়ে পড়েন। তাঁর মনে হয় তিনি খুব সুখী।
ভগবান দাস শৈশবে পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক আর হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে কটন কলেজে ভরতি হয়েছিলেন। তিনি কলেজে ভরতি হওয়ার এক বছর পরে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাইশ বছরের ভগবান দাসকে বিএ পড়া সম্পূর্ণ না করেই চাকরিতে ঢুকতে হল। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করলেন। মনে আশা ছিল আইন পড়বেন। আজ কেরানি হয়ে কাজ করা কাচারিতে কাল অ্যাডভোকেট হয়ে জয়েন করবেন। এক এক করে দুই বোনের বিয়ে দিলেন। নিজে বিয়ে করলেন, তিনটি ছেলে মেয়ে হল। পিতার মৃত্যু হল। একটা সময়ে ভগবান দাস দুঃখের সঙ্গে উপলদ্ধি করলেন জমা খরচের তালিকায় বিয়োগের ঘর বাড়ানোর মতো অবকাশ নেই। তিনি প্রতিদিন সকাল দশটায় অফিস যান। নোট লেখেন, ড্রাফটিং করেন, টাইপ করেন, বারোটার সময় চা-সিঙ্গারা এবং তিনটের সময় রুটি-ভাজি খেলেন, প্লাস্টিকের ব্যাগে বাজার করে বিকেলের দিকে বাড়ি যান, কলা-বিস্কুট দিয়ে চা খান, বৈঠকখানায় দৈনিক কাগজটা নিয়ে বসেন। রাত হলে বালিশে মাথা রেখে ভাবেন তিনি সুখী মানুষ। একজন শান্ত সংযত ভগবান দাস, একজন ক্লান্ত নির্বাক পথচারী, একজন ভালোমানুষ দাসবাবু।
স্কুল-কলেজে ভগবান দাসের নাটকাদি করার সখ ছিল। তর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সভা সমিতিতে উপস্থিত থেকে অন্যের কথা শুনতেন, নিজেও কখনও কখনও দুই একটি কথা বলতেন। আজকাল অফিসে কখনও কারও বিদায় সভা, অভ্যর্থনা সভা , কোনো মহৎ লোকের মৃত্যুতে করা স্মৃতিচারণ সভায় পরিচিতরা বলেন-
‘দাস দুই একটি কথা বলুন। ’
‘দাসদা কিছু একটা বলুন’।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দাস বলুন। ’
দাস বলেন, বলার শেষে সবাই হাততালি দেয়। দাসের মন ভালো লাগে। ছাত্র জীবনের শিক্ষাটুকু তাহলে বৃথা যায়নি।
তার বাইরে অন্যসময়ে ভগবান দাস একজন শান্ত-শিষ্ট কেরানি। তিনি সেইসব কেরানিদের একজন নন, যাকে অফিসার নিজের ঘরে ডেকে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাইয়ে গল্প করেন। যে ডিসির রুমে ঢুকেও নিঃসঙ্কোচে পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়তে পারেন। যাকে দেখলে কম বয়সী কেরানিরা নিজেদের ভেতরে গল্প গুজব বন্ধ করে যে যার চেয়ারে বসে কাজ শুরু করে দেয়। একজন অভিযোগহীন নিরীহ ব্যক্তি।
দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে ভগবান দাস নিজের পত্নীর সঙ্গে কখনও উচ্চ স্বরে তর্ক বিতর্ক করেন নি। অথবা যৌবনেও তাঁর প্রিয়তমার মুখমণ্ডলে মেঘে ঢাকা চাঁদের সৌন্দর্য খুঁজতে গিয়ে ব্যাকুল হননি। তিনি নিজের তিন সন্তানকে কখনও তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দমন করেননি। কখনও নিজের পুত্র কন্যাকে রাকেশ শর্মা, বিশ্বনাথন আনন্দ বা কল্পনা চাওলার রূপে কল্পনা করে বিভোর হননি। একজন প্রাবল্যহীন নিরুত্তাপ ব্যক্তি।
গভীর রাতে ভগবান দাস প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখেন। তিনি একটা সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, দুপাশে ছোট ছোট অজস্র বাড়ি, দোকান, স্কুল, বাজার, বাড়ির দরজা জানালাগুলি তিন পার হয়ে যান, কিন্তু কোথাও কারও মুখ দেখতে পান না, কোথাও তিনি জলের কলকল শব্দ শুনেন, কিন্তু নদী বা জলের অন্য কোনো উৎস তার চোখে পড়ে না। তিনি জেগে উঠেন এবং রাতের সুখী মানুষটি একজন অবসাদগ্রস্ত বিষণ্ণ ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হন।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও অফিসের নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে ফাইলের নির্দেশ অনুসারে ভগবান দাস একটা ড্রাফট লিখছিলেন। একজন কনিষ্ঠ সহকারীকে তাঁর অসংযত আচরণের জন্য চাকরি থেকে নিলম্বিত করা হয়েছিল। কর্মচারীটির পত্নী তাঁর বেতনের টাকার অর্ধেকটা দেবার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। চারটে ত্রিশ মিনিটের সময় তাঁর পাশে বসা সহকারীটি জিজ্ঞেস করলেন, ’দাসদা মিটিঙে যাবেন না?’
বিমর্ষ ভাবে এসে সভাগৃহের এককোণে একটা খালি চেয়ারে ভগবান দাস বসে পড়লেন। প্রকৃ্তপক্ষে সভাটির কেন আয়োজন করা হয়েছে তিনি তাও বুঝতে পারেননি। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে জানতে পারলেন অফিসের একজন কর্মচারী ইতিমধ্যে তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইয়ের জন্য সর্ব্বভারতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্য সভার আয়োজন করা হয়েছে। ভগবান দাস চমকে উঠলেন। কী শুনছেন তিনি?কবিতা। যেন বহু বছর বিদেশে থাকা কোনো এক ব্যক্তি শুনতে পেয়েছেন নিজের বাড়ির উঠোনের পোষা কবুতরের কূজন। সভাগৃহের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরের গাছ-পালার সারি। সেই সবুজ পরিমণ্ডলে চোখ রেখে ভগবান দাস ধীরেধীরে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আর্তনাদের জায়গা থেকে যেন উঠে আসছিল সঙ্গীতের সুর। ভগবান দাস কথা বলছিলেন?ঢেলে দিচ্ছিলেন কবিতার প্রতি থাকা তাঁর প্রেম। তাঁর উচ্চারিত শব্দের স্বরে সমবেত প্রত্যেকেই চোখের সামনে অপরিচিত জটাধারী বাসবদত্তার বিবর্ণ দেহে মাখিয়ে দিচ্ছিল চন্দনের প্রলেপ, শুকনো ঠোঁটে ঢেলে দিচ্ছিল জল, শৈলমগ্না উর্বশী হয়েছিল শাপমুক্তা। ভগবান দাস বলে যাচ্ছিলেন, সবাই শুনছিলেন। তিনিই যেন কেবল বলছিলেন না, সবাই নিজেকে নিজে বলছিলেন। প্রত্যেকেরই বুকের মধ্যে অলক্ষিতে বইতে থাকা একটা নদী যেন চেতনার শুষ্কভূমি ভিজিয়ে দিয়েছে। একটা সময়ে ভগবান দাস বসে পড়লেন। প্রবল হাততালির মধ্যে গুঞ্জন ধ্বনি শুরু হল, ‘দাসদা আপনি কেন কেরানি হলেন?’
‘দাস আপনি কিন্তু আজ মান রেখেছেন। আমাদের তো এসব সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই। ’
উত্তর ভারতের কোনো একটি রাজ্য থেকে আগত বিরাট কার্যালয়ের উর্ধতন অফিসার সভার শেষে দাসকে নিজের ঘরে ডাকিয়ে নিলেন।
‘দাসবাবু আপনি তো অনেক ভালো কথা বলেছেন। আপনি কি অনেক পড়াশোনা করেছেন?’
‘না মানে স্যার’
‘আপনি আমাকে অসমিয়া বই দেবেন। আপনার কাছ থেকে আমি ভালো করে অসমিয়া ভাষা শিখব। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে স্যার। ’
পরিচিত পথে ভগবান দাস বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর মনে আনন্দ। হাতে থাকা পয়সা দিয়ে দুটো খাবার জিনিস কিনলেন। প্রসার কুকারের হুইসেলটা বহুদিন থেকে খারাপ হয়ে আছে। কিনে ফেললেন। অনেক টাকা গেল। যাক। চোখের কোণে কালি পরা দাগ এবং বিবর্ণ মুখচ্ছায়ার মধ্যে তাঁর পরিবারের মুখের হাসিটা ভগবান দাসের মনে পড়ল। বাড়ি ফিরে অন্যান্য দিনের মতো ফর্টি ওয়াটের বাল্বের আলোতে খবরের কাগজ মেলে বসলেন না। তার বদলে বারান্দার বেতের চেয়ারটা বের করে তাতে বসে ক্রমান্বয়ে গাঢ় হয়ে আসা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মেয়েদুটির সঙ্গে বসে একসঙ্গে টেলিফিল্ম দেখলেন। পরিবার ভাত খাবার জন্য কয়েকবার ডেকে পাঠাল। ভাতের থালায় বসেই ছেলেটিকে বললেন—‘ঘোরাফেরাটা কিছু কমিয়েছ কি? ম্যাট্রিক যা হবার হয়েছে। হায়ার সেকেণ্ডারিতে ভালো করার চেষ্টা কর। ’
ঘুমোতে গিয়ে ভগবান দাস অনুভব করলেন, তাঁর একটুও শুতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কী করবেন তাও বুঝতে পারছেন না। কিছু সময় ছটফট করে মনের মধ্যে অশান্তির ভাব নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম এল না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্যান্য দিনের মতোই ভগবান দাস মুখ হাত ধুলেন, চা খেলেন, টুক টাক কিছু কাজ করে স্নান করে, ভাত খেয়ে অফিসে এলেন। নিজের চেয়ারে বসে একবার এদিক ওদিক তাকালেন। তখন ও সবাই আসেনি। যারা এসেছেন তারা সবাই নিজের নিজের ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। ভগবান দাস সামনের ফাইলটা টেনে এনে তাতে ওপরওয়ালার নির্দেশ পড়ে দেখলেন। সেই অনুসারে ড্রাফটিং করে টাইপ করে ফাইলে নোট লিখে অফিসারের রুমে পাঠালেন। ঠিক বারোটার সময় ভগবান দাস নিমকি সহযোগে এক কাপ চা খেলেন। কাজের মধ্যে সময় বের করে তিনটের সময় টিফিনে ভরিয়ে দেওয়া রুটি-ভাজা খেলেন। পাঁচটার পরে কাজ শেষ করে অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ি ফিরলেন। চা-বিস্কূট খেয়ে খবরের কাগজটা মেলে অনুভব করলেন তার মাথা ব্যথা করছে। কাগজ সরিয়ে তিনি ভাতের জন্য অপেক্ষা করলেন। ভাত খেয়ে উঠে তিনি সোজাসুজি বিছানায় গেলেন। বালিশ এবং বিছানাই এখন তাঁর একমাত্র কাম্য। বালিশে মাথা রেখে ভগবান দাস অনুভব করলেন পার্থিব সমস্ত রিক্ততা এবং অবসাদ থেকে তিনি মুক্ত। নিশ্ছিদ্র নিদ্রায় কিছুক্ষণের মধ্যে ভগবান দাস ডুবে গেলেন।