স্পিতি উপত্যকা
জয়িতা সরকার, বেঙ্গালুরু ##
পৃথিবী ত্রস্ত, করোনার করাল থাবা, ঘরবন্দি দশায় দিন কাটছে, এই সময়ে স্মৃতির সরণী বেয়ে মন ছুটল উত্তরে। প্রায় দেড় বছর আগে হৈ হৈ করে পাড়ি দিয়েছিলাম শীতল মরুভূমির দেশে। শহুরে জীবন থেকে এক অন্য জীবনে। এখনও কংক্রিটের জালের মায়ায় তাকে বাঁধতে পারেনি আগ্রাসী উন্নয়ন। আদিমতা আর বিচ্ছিন্নতা নিয়ে নিজের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রহরী হয়ে রয়েছে কিন্নর কৈলাস।
হ্যা ঠিক ধরেছেন আমি হিমাচল এর সেই প্রত্যন্ত গ্রামের কথাই বলছি। যেখানে এখনও পৌঁছায়নি এই কৃত্রিমতা। প্রকৃতি এখানে নিজেকে সাজিয়েছে আপন খেয়ালে। আপেল বাগান, বরফে মোড়া পাহাড় শৃঙ্গ, ধূসর পাহাড়, শীতল মরুভূমির বুক চিরে বয়ে যাওয়া পিন, স্পিতি, সবুজের মাঝে বাসপা সব মিলিয়ে জীবনের সব পেয়েছির দেশ।
২০১৮ এর সেপ্টেম্বর, আমাদের গন্তব্য ছিল স্পিতি ভ্যালি। নামটার সঙ্গে কম বেশি সবাই পরিচিত। এক শীতল, অনুর্বর, নেই রাজ্য ভ্রমণের বৃত্তান্ত। যাত্রা শুরু ছিল দিল্লি থেকে। দিল্লি থেকে রাতের বাসে শিমলা। শিমলা নিয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরের দিন ভোর ৬ টায় রওনা পরের গন্তব্যের উদ্দেশে। শিমলা পার হতেই প্রকৃতির যে রূপ শুরু হল তা প্রকাশ করার মতো কোনো শব্দ নেই। পুরো রাস্তায় আমাদের পাশে ছিল শতদ্রু বা সাটলেজ। আর রাস্তা ছিল ভয়ংকর সুন্দর। পুরো দিন শেষে পৌঁছলাম আমাদের সেইদিনের গন্তব্য রক্ছম ভিলেজে। রং তুলির ক্যানভাসে আঁকা সেই গ্রামের সুইস টেন্টে আমাদের রাত্রি যাপন। টেন্টের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বাসপা। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই যে সকাল দেখেছি তা আর কোনদিন আসবে বলে মনে হয়না। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা সাংলা ভ্যালির এই গ্রামটা মন কেড়েছিল। এক পাহাড়ে রোদ অন্য পাহাড়ে মেঘ। রোদ মেঘের খেলায় নিজেকে হারাতে সময় লাগেনি এক মুহূর্ত। এবার রক্ছম ছেড়ে চললাম কয়েক কিমি আগে এই প্রান্তের শেষ গ্রাম ছিটকুলের দিকে। পৌঁছতেই যে দৃশ্য ভেসে এলো তা মনের সিন্দুকে তুলে নিলাম সযত্নে। এবার চললাম পরের গন্তব্য কালপার দিকে। সেখানে পৌঁছতেই বেলা শেষ হয় হয়, নেমে গেল বৃষ্টি। তবুও তার মাঝেই দেখলাম সুইসাইড পয়েন্ট। যা দেখে হাত পা কেঁপে উঠেছিল। পরের দিন ভোর হতেই ব্যালকনি থেকে উঁকিঝুঁকি কখন মেঘ সরে যাবে আমরা দেখব কিন্নর কৈলাসকে। অবশেষে দেখা মিলেছিল।
কালপাকে বিদায় জানিয়ে আমরা এবার টাবোর পথে। ক্রমশ উচ্চতা বাড়ছে। শুরু হয়েছিল মাথা ঘোরা, হাত ঝিমঝিম। চোখ বন্ধ করে রাখলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু কি জানি মিস করে ফেলেছি ইতিমধ্যে। হ্যা প্রকৃতি এতো সৌন্দর্য্য সাজিয়ে রেখেছে চারিদিকে এক পলক ফেললেই হারিয়ে যাবে অনেক কিছু। পথের প্রতিটি বাঁকে নতুন রূপ। সবুজ পাহাড় ক্রমশ হয়ে উঠছে ধূসর। এভাবেই পৌঁছলাম নাকো। চারিদিকে উইলো গাছে ঘেরা নাকো লেকের সৌন্দর্য্য ছিল অবর্ণনীয়। সেখান থেকে টাবো। প্রাচীনতার ছোঁয়া রয়েছে এই গ্রামে। এখানে না এলে জানা হত না রাতের আকাশে এতো তারা রয়েছে। সেই রাত ছিল শুধু তারায় মোড়া।
পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নতুনের উদ্দেশে। এইদিন আমাদের গন্তব্য ছিল পিন ভ্যালি। যাওয়ার পথে ধনকার মনেস্ট্রি, ইতিহাসে পরিপূর্ণ এই মনেস্ট্রির গঠনশৈলী সত্যি নজর কেড়েছিল। সেখান থেকে চললাম পিন ভ্যালির দিকে। রাস্তা আর নদী কোথাও কোথাও মিশে গিয়েছে আর পাহাড়, ভূগোলের পাতায় যা পড়ে এসেছি সব রয়েছে এই পথে। অনুর্বরতার যে এতো সৌন্দর্য্য হতে পারে তা দেখতে হলে পিন ভ্যালি আসতেই হবে। যাকে বলে barren beauty।
পিন থেকে বেরিয়ে পরের দিন চললাম কাজার দিকে। কাজাকে ঘিরে যে গ্রামগুলো রয়েছে সেগুলো দেখার পালা। প্রথমেই চললাম হিক্কিম এর উদ্দ্যেশে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ডাকঘর রয়েছে এখানে। সেখান থেকে বাড়ির উদ্দেশে চিঠি লেখা। সে এক অন্য উত্তেজনা আলাদা অনুভূতি। সেখান থেকে বেরিয়ে কমিক এর পথে। এদিনের রাত্রিযাপন ছিল লাংজাতে। যেখানে প্রাচীন বুদ্ধ রয়েছে প্রহরায়। আর এই গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে তার ফসিল সম্ভারের জন্য। সারা বছর ভূবিজ্ঞানীদের আনাগোনা রয়েছে এই গ্রামে। গ্রামের মাটিতে একটু খুঁজে দেখলেই মিলতে পারে অন্য রকমের পাথর।
বুদ্ধকে সেই প্রহরীর দায়িত্ব দিয়ে গ্রামের সরল মানুষগুলোর থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম এই ট্রিপ এর অন্যতম আকর্ষণ কি মনেস্ট্রির উদ্দেশ্যে। দূর থেকে দেখতে দেখতে কখন যে পৌঁছে গেলাম বুঝতে পারিনি। কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে কি, তার গল্প শোনা হল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর থেকে। অতিথি আপ্যায়নে ছিল চা। সেই বিকেলের পড়ন্ত বেলায় মন জুড়ে শুধুই এক প্রশান্তি।
পরের দিনের পথ ছিল দীর্ঘ। কি থেকে চন্দ্রতাল। পথে পড়েছিল কিব্বর, যা শীতে স্নো লেপার্ড এর ঘর, লোসার, এতো সুন্দর ভূমিরূপ পৃথিবীতে থাকতে পারে লোসার না দেখলে জানতে পারতাম না। অবশেষে কুনজুম পাস পেড়িয়ে চন্দ্রতাল এর টেন্ট। উষ্ণতা মাইনাস তিন। প্রবল হাওয়া, তার মধ্যে দেড় কিমি পথ হেঁটে ধূসরতায় নীলের ছোঁয়া। প্রথম দেখাতেই মোহিত। এমন সোম্মোহণী রূপ তার যা ভুলিয়ে দেবে বাস্তবতা। সূর্য তখন পশ্চিমের পথে পা বাড়িয়েছে। আমরাও ফিরতি পথে। টেন্টে রাত কাটিয়ে পরেরদিন ভোর হতেই মানালির পথে। সেই নিঃশব্দ ধূধূ সৌন্দর্যের পাশে মানালি সবুজ, প্রাণবন্ত। তবুও কোথাও যেন সবুজ হার মেনেছে ধূসরের কাছে।
Sundor
কি দারুন লিখেছিস জয়িতা। তোর ভ্রমন কাহিনী পড়ে মনে হচ্ছে উড়ে চলে যাই হিমাচলের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। কি করে যাই, এখন যে লক ডাউন। তোরকাছে গুপি বাঘার মোবাইল নম্বরটা হবে। তাহলে কটা দিনের জন্য ওদের কাছ থেকে জুতো জোড়া ভাড়া নিয়ে নিতাম।
অসাধারণ! ছবি ও বর্ণনায়, মানসচক্ষে ঘুরে এলাম।
মন ছুঁয়ে গেল, সুযোগ পেলে কোনোদিন প্রকৃতির কোলে উপত্যকার রূপ চাক্ষুষ অনুধাবন করার ইচ্ছাপ্রকাশ করলাম।