স্বপ্নবিলাস

তনুপ্রিয়া চক্রবর্তী, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##

“ওরে ওঠ, আর কত ঘুমাবি?  সাড়ে আটটা বাজতে যায়! বাপির স্নান হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট করতে বসে তোকে টেবিলে না দেখতে পেলে বাপি কিন্তু না খেয়েই অফিসে চলে যাবে” – ঘুমের আবেশে পাশবালিশে লেপ্টে থাকা রুমি মায়ের একদমে বলে যাওয়া কথা গুলো শুনল। কিন্তু বিছানা ত‍্যাগ করার কোন লক্ষণই তার মধ্যে দেখা গেল না। সবে মাত্র বাপির হাত ধরে ট্রেকিংটা শুরু করতে যাবে তখনই মা এসে ঠ‍্যালা দিয়ে ডেকে সবটা ভেস্তে দিল। সেই ভোর থেকে কত জার্নি করে প্রায় মিস্ হয়ে যাওয়া ট্রেন ধরে তারা দার্জিলিং পৌঁছাল; যতই স্বপ্ন হোক তবু জার্নি তো হয়েছে, ট্রেন ধরার টেনশনটাও পুরো নিতে হল। কিন্তু আসল মজাটাই হল না। মায়ের আরেক প্রস্থ চেঁচামেচি শুরু হওয়ার আগেই উঠে পড়ল সে। ব্রাশ করে, হাত-মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাপিকে বলতে লাগল তার এক্সাইটিং স্বপ্নের কথা। সিক্সে পড়া রুমি এমনিতেই হাত-পা নেড়ে গল্প বলতে ওস্তাদ; তার ওপরে সে পাহাড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছে। বাপির হাতঘড়ি যতই তাড়া লাগাক মেয়ের স্বপ্নের পুরোটা না শুনে টেবিল ছেড়ে ওঠার জো নেই। রুমির স্বপ্নের গল্প শেষ হতেই তাড়াহুড়ো করে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন, “তুই ট্রেকিং করতে চাস? খুব কঠিন কিন্তু।” রুমি দুধে ভেজানো এক চামচ কর্ণফ্লেক্স মুখে পুরে খেতে খেতেই উত্তর দিল, “হ‍্যাঁ, জানি তো ভীষণ কঠিন। টিভিতে দেখেছি। কিন্তু আমি কি আর একা যাব? তুমি তো থাকবেই সাথে। স্বপ্নেও তো দেখলাম, আমি তোমার হাত ধরেই উঠছি পাহাড়ে। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, তাই না? দিব্বু উঠছিলাম পাহাড়ে, অমনি মা এসে ডাকাডাকি শুরু করল আর আমাদের ট্রেকিংটা ভেস্তে গেল।” তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে চুলগুলো আলতো আদরে ঘেঁটে দিয়ে অফিসে বেরিয়ে গেলেন বাবা।

মা এতক্ষণ খুব ব‍্যস্ত ছিলেন রান্নাঘরে তাই রুমির স্বপ্নের গল্পটা ভালো করে শুনতেই পাননি। এবার কাচা জামা-কাপড়ের বালতি নিয়ে তিনি ছাদে যেতেই রুমিও কর্ণফ্লেক্স এর বাটি হাতে নিয়ে চলল তার পিছন পিছন; গল্পটা একেবারে গুছিয়ে মাকে না বলা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। স্কুল যাওয়ার তাড়া না থাকায় সে আরও নিশ্চিন্ত। আগামী সপ্তাহেই মা দূর্গার বোধন। তাই শনিবারের এই অলস সকাল থেকেই রুমির পুজোর ছুটি শুরু হয়ে গেছে। বকবক করতে গিয়ে খাবারটা শেষ করতে দেরি হয়ে গেল; তাই বকুনিও শুনল মায়ের কাছে। এমন ঝকঝকে সকালে, পুজোর ছুটির আমেজে ঐ একটু আধটু মায়ের বকুনি গায়েই লাগেনা রুমির। সারাটা দিন মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরেই কাটিয়ে দেয়। মা-মেয়েতে মিলে একসাথে রোদে দেয় পুরানো শাড়ি ও জামাকাপড়। দুপুরে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে আনন্দমেলার শারদ সংখ‍্যায় ডুবে গেল সে। তার মা একটা রান্নার বই এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, “আজ বিকেলে একটা নতুন রান্না করে তোদের চমকে দেব দেখিস।” রুমিও আবদার করল নতুন রান্নায় তাকে সাথে নিতেই হবে, সেও বানাবে। সবটা জানার জন্য বিকেল অবধি ধৈর্য্য ধরতে সে নারাজ; মাকে জিজ্ঞাসা করে জানল খাবারটার নাম উত্তাপম, দক্ষিণী খাবার। দুজনে মিলে যুক্তি করল বাপি বাড়ি ফেরার একটু আগেই ওটা বানিয়ে ফেলবে আর বাপি এলেই গরম গরম খেতে দেবে। নাহ্ শুধু খেলেই খেল্ খতম নয়, খেয়ে বাপিকে বলতে হবে ওটা কি কি দিয়ে বানানো। মায়ের কাছে রেসিপিটা শুনতে শুনতে হঠাৎ যেন নাকে পোড়া গন্ধ পেল রুমি। রান্না হওয়ার আগেই বিছানায় শুয়ে এত তীব্র পোড়া গন্ধ পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসল। দেখল মা পাশে নেই আর পোড়া গন্ধটা রান্নাঘর থেকেই আসছে। বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল গ‍্যাসের ওভেনে গনগনে আঁচে পুড়ে নিজেদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছে কোনো একটা তরকারি। গ্যাসটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করল রুমি। মা ভাড়া বাড়ির ছাদ থেকে জামা-কাপড় মেলে ফিরে এসে দেখলেন তরকারির অবস্থা। রুমিকে বললেন, “ছ’টা পনেরো বেজে গেছে, এখন তরকারি রাঁধতে গেলে টিউশনি, স্কুল সবেতেই দেরি হবে। আমি ভাতটা চাপিয়ে টিউশনিতে বেরোচ্ছি, তুই নামিয়ে উবুড় দিয়ে পড়তে চলে যাস। টেবিলের ওপর বাটিতে জল-মুড়ি দেওয়া আছে, খেয়ে নিস। পড়া সাতটা থেকে তো? “রুমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। পরনের ছাপা শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে পায়ে চটি গলিয়ে মা রুমিকে বলে গেলেন, “পুজোর আগে আজই শেষ স্কুল। আজ দিনটা মা-মেয়েতে আলুর চোখা আর ভাত খেয়ে চলে যাই, এরপর তো এক মাস ছুটি তখন তোকে ভালো করে রান্না করে দেব, কেমন?” রুমি হেসে মাকে বলল, “আলুর চোখা তো আমার ফেবারিট মা, তুমি এখন নিশ্চিন্তে এস, না হলে দেরি হয়ে যাবে। রাস্তাঘাটে দেখেশুনে হেঁটো, যা তাড়াহুড়ো করো সবসময়!” রুমি জানে প্রতিদিন সকালে ন’টা পর্যন্ত বাইরে টিউশন পড়িয়ে এসে আবার সাড়ে দশটায় স্কুলে বেরোতে মার কাল ঘাম ছুটে যায়; নিয়মিত সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে সারাদিন যন্ত্রের মতো খাটে মানুষটা। তাই মায়ের রান্না যখন যেমনই হোক না কেন সে সোনা মুখ করেই খায়।

মা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়াল রুমি। ঘড়ির দিকে চোখ যেতে দেখল সাড়ে ছ’টা বাজে। সকালের দিকে এক একটা স্বপ্ন এমন আঁকড়ে ধরে যে মাথা থেকে স্বপ্ন ও ঘুম কোনটার রেশই কাটতে চায় না। ব্রাশ করতে করতে ভাবনার দোলাচলে দুলতে লাগল তার মন। এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখল সে, এটাই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল মনে। বাবাকে তো শেষ দেখেছে তিন বছর আগে। তিনি ওদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন আর তার মা তাকে মুক্তি দিয়ে নিজের কাঁধে সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। বোধ হয়ে থেকেই বাবা ও মায়ের মধ্যে সমস্যা দেখে এসেছে সে। তার প্রতিও বাবার বিশেষ কোন ভালোবাসা কখনও টের পায়নি রুমি। তাই বাবার সাথে কোনদিনই অনেকটা সময় কাটায়নি সে আর সবচেয়ে অবাক হল এটা ভেবে, কোনদিন তার বাবাকে সে ‘বাপি’ বলে ডাকেই নি। মাকেও তো কখনও দেখেনি পরম নিশ্চিন্তে বই এর পাতা ওল্টাতে বা ব‍্যস্ততার তাড়নাকে উপেক্ষা করে সারাদিন ধরে ঘরের কাজ করতে। টিচারদের কাছে মাঝে মধ্যে অবচেতন মনের কথা শুনেছে রুমি কিন্তু তার অবচেতনে এত অবাস্তব ভাবনা চিন্তা কী করে এল তার কূলকিনারা পেল না সে। ইতিমধ্যে পৌনে সাতটা বেজে গেছে। ভাত উপুড় দিয়ে রুমি রেডি হতে লাগল ইংরেজি স‍্যারের কাছে পড়তে যাওয়ার জন্য। পৌঁছে দেখল আগের দিনের মতোই স‍্যারের কোলে বসে রয়েছে তার দেড় বছরের মেয়ে তিতলি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে একবার স‍্যারের কোলে বসলে তাকে আর নামানো যায় না। রোজকারের মতো সেদিনও তাদের পড়ার পুরো সময়টাই তিতলি তার বাবার কোলে বসে থাকল; একেবারে শান্ত হয়ে যে বসে থাকে না তা বলাই বাহুল্য। বই, পেন নিয়ে টানাটানি তো চললই আর থেকে থেকেই চেঁচিয়ে উঠছিল, “বাপি বেরু তলো।”

স‍্যারের স্ত্রী ফোনে ন‍্যাশনাল জিওগ্ৰাফি চ‍্যানেল খুলে পশু, পাখি, পাহাড় দেখিয়ে মেয়েকে অনেকবার আকৃষ্ট করতে চাইলেন কিন্তু মেয়ে কিছুতেই বাপির আকর্ষণ ছাড়তে পারল না। ছোট্ট মেয়ের দুষ্টুমির কাছে বাবা-মায়ের নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে ব‍্যাচের সবাই হাসাহাসি করছিল। শুধু রুমি জুলজুলে চোখে তাকিয়ে দেখছিল বাপির কোলে বসে তার হাত থেকেই একবাটি দুধ কর্ণফ্লেক্স খেয়ে তৃপ্ত হওয়া তিতলির মুখ। অস্ফুটে একবার বলেই ফেলল, “ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় কখনও?” কথাটা বলতেই ঠোঁটের কোণে চলে এল এক চিলতে হাসি। সবার অলক্ষ্যে নিজের মাথায় একটা চাঁটি মারল রুমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + 1 =