হস্তশিল্প
রাজর্ষি বর্ধন ##
বউটা রোজগার করে। স্বামীটা বসে খায়।
লোকে বললে বলে, অন্নপূর্ণার আশ্রয়ে আছি, দেবী আমায় যা তুলে দেন মুখে, তাতেই আমার চলে যায়!
এসব কথা বলে সে সবার কাছে পরিহাসের পাত্র হয়ে ওঠে। স্ত্রীর অন্নে প্রতিপালিত পুরুষের ব্যাক্তিত্ব বলে কিছু থাকে না, তারও ছিল না।
স্ত্রী স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। খুব সামান্যই আয় হয়, মাসের পুরো খরচটাও ওঠে না। স্বামীটা সংসারের কোন কাজে লাগে না – কাজের মধ্যে বসে বসে গাছের ডাল কাটে, কারুকাজ করে নানা রকম আকৃতি তৈরি করে, কোনটা মনে হয় হরিণের, কোনটা নারীর! সম্পূর্ণ ভাবে না, তবে একটা পাওয়া যায়!
কেউ কেউ বলে – ব্যাটা ছাই চাপা আগুন। জাত শিল্পী, কিন্তু নিজের প্রতি মনোযোগ দেয় না, নইলে এতদিনে কোথায় পৌঁছে যেতো!
কেউ বলে, যত দোষ বউটার, আশকারা দিয়ে স্বামীটাকে কুঁড়ে বানিয়েছে, বউটাও যদি একটু কড়া হতো!
স্বামীটা রাজ্যের যত ডালপালা, ভাঙ্গা কাঠ কুটো জোগাড় করে এনে, সকালবেলা দু থেকে আড়াই ঘণ্টা সেগুলোর ওপর কাজ করে আশ্চর্য সব আকৃতি তৈরি করে। এটাও এক রকমের শিল্প, নাম – কাটুমকাটাম !
সে ঐ কাটুম-কাটামগুলো নানা হস্তশিল্প মেলায় পাঠায়। সেখানে তাঁর হাতের কাজের প্রশংসা হয়, ভালো বিক্রি হয়! এমনকি কলকাতায় যে প্রতিবছর হস্তশিল্প প্রতিযোগিতা হয়, সেখানেও পাঠাচ্ছে গত তিনবছর ধরে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোন বারেও সে প্রথম পুরস্কার পায়নি। সেটার অর্থ মুল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। সাথে সরকারি মানপত্র। তবে সে একবার তৃতীয় হয়েছে , আর পেয়েছে দশ হাজার টাকা!
লোকে বলে, ওসব যায়গায় জানাশুনো থাকতে হয় , নইলে শিকে ছেড়ে না! সে বিশ্বাস করে না, মন-প্রান দিয়ে কাজ করে যায় –
দিন চলে যায় যেমন যাওয়ার। দেখতে দেখতে প্রত্যেকবারের মতো আবার প্রতিযোগিতার দিন চলে আসে। স্বামীটা মরিয়া হয়ে ওঠে – এইবার যা করার করতেই হবে, মাথা খাটিয়ে এমন একটা নকশা তৈরি করতে হবে যা দেখে সবার তাক লেগে যায়! অধিক উত্তেজনা নিয়ে সে কাজ আরম্ভ করে!
এরকমই এক অলস দুপুরে সে হাতের কাজ শেষ করে ঘুম দিচ্ছিল। তাঁর অলক্ষেই রান্নাঘরের দরজা খোলা পেয়ে একটা বিড়াল টুক করে ঢুকে রান্না করা মাছ চুরি করে পালায়। দৃশ্যটা বউটার চোখে পড়ে যায় , সে তখন হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছিল হাফ ছুটির পর। সেই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে ওঠে বাড়ি মাথায় করে। স্বামীটার ঘুম ছুটে যায়, সে ধরমড় করে উঠে বসে! তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে হাতের ঠ্যালায় মাথার কাছে রাখা সদ্য তৈরি করা কাটুম-কাটামটি মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে যায়!
লোকটা একটা টুকরো কুড়িয়ে নেয়। সেটা দেখে সে অবাক হয়ে যায়! ভাঙ্গা টুকরোটা অবিকল শিবের মূর্তির মতো দেখতে লাগছে! সে টুকরোটাকে একটা প্রণাম করে ।
সামান্য কারুকাজ করে মূর্তিটার পাশে একটা ত্রিশূলের মত করে সেটা পাঠিয়ে দেয় প্রতিযোগিতায়। নাম দেয় “অলস স্বামী” !
সেবারই সে প্রথম পুরস্কার বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পেল।