হেরিটেজ

সঞ্জীবসেন, পানিহাটী, উত্তর ২৪ পরগনা

 

আকাশ ভেঙে আয়রে তুই বরষা”

সঙ্গে সঙ্গে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ, দক্ষিনদিকের জানালা খুললে হাওড়া ব্রিজটাকে পুরো দেখা যায়, এই হাওড়া ব্রিজটাকে ঘিরে গোটা একটা গোটাএকটা হিন্দি সিনেমা হয়েছিল, অশোক কুমার নায়ক ছিল, শুধু একটা কেন আমাদের মনিরত্নমের একটা সিনেমাও তো এই হাওড়া ব্রিজকে ঘিরে, এই হাওড়া ব্রিজটি যেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেখানেই কত সুকান্তের পূর্ণিমা বয়ে গেছে কত ইতিহাস রচিত হয়েছে কত আবার বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছে তার শেষ নেই। এই যে সন্ধ্যা হলেই কলকাতা সহ হাওড়া ব্রিজটা রানীর মত সেজে ওঠে এক সময়ের “সিটি অফ জয়” এর মাথায় কটা পালক রাখতে পারলো বা কতটাই ম্লান করতে পারলো তা নিয়ে তর্ক থেকেই যায়…।

এমন দিনেই তো বর্ষার গান গাইতে হয় কিম্বা গুলজারের কবিতা,,

“কিসি মৌসম কা ঝোকা থা,

জো ইস দিবার পর লটকে হ্যুয়ে তসবির পর, উতার আয়ে…”

চার দিকে এত বহুতল, পাখির বাসার মত তার মধ্যে আমার এই বাড়ি প্রাচীন বট গাছের মত দাঁড়িয়ে আছে এটা কম গর্বের, হাওড়া ব্রিজ এর থেকে!

“অনেক হয়েছে বর্ষা বন্দনা, দেখে যাও একটু আগে একটা জায়গা দিয়ে

পড়ছিল এখন পুরো রান্না ঘর থেকেই জল পড়ছে, এমন ঘরে সংসার করা যায়?”

অতনু রান্না ঘরে গিয়ে দেখলো সত্যিই এই ঘরে রান্না করা খুবই কষ্টের,

সুতপা আজকে করে নাও কালকেই মিস্ত্রী লাগাচ্ছি,,

সে নয় ঠিক আছে, এবার একটু ভাবনা চিন্তা কর,

কিসের?

সবাই যা করছে, দেখেছো; পুরনো বাড়িকে উনি চোখের জলে ধরে রেখেছেন!

এই যে প্রানপন বাবুও তাই করল, তাও তো ওদের কত শরিকি বিবাদ, সব মিটিয়ে কি সুন্দর হয়ে গেল, কালকেই তো রেজিস্ট্রি হয়েছে , ছোট ছেলের বৌ বিনিতা বলছিল।

আমাদের তো সেই সমস্যা নেই। তোমার বোন মধু ছাড়া, ওর ব্যাপারটা তো দেখতেই হবে, ওসব ঠিক হয়ে যাবে, আগে ঠিক করে সিদ্ধান্ত নাও।

=সে না হয় ঠিক আছে, চার কাঠার একটু বেশী এইটুকুতে কে কাজ করবে বল তো,

কে বলছে হয়না, আগে তো কথা বল, না হয় প্রানপনবাবুর যে প্রোমোটার তাকে দিয়েই না হয় কাজটা করাবো।

“আষাঢ় বয়ে যায় শ্রাবণের স্রোতে,

তার সাথে মন খারাপের তিস্তাও বয়ে যায়…

এফ এমে রেডিও জকি সুমিষ্ট ভাষী মেয়েটি বর্ষা স্পেশাল গানগুলির ক্লিপিং শোনাল, রসিদ খান, শোভা মুদগল তারপর থাকছে গুলজারের একটা অনন্য কবিতা শুধুমাত্র আপনাদের জন্য।

অতনু জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়।

অতনু ভাবে, এত বড় একটা সেতু এত বছর ধরে এত মানুষের মনে এত ভাবে দাগ কাটল তার বৃত্তান্ত আজও সে ভাবে লেখা হয়নি, টেমস নদীর উপর সিকি দুয়ানি ব্রিজকে নিয়ে কত কাব্য কথা লেখা হয়েছে, আর দ্যাখো, হাওড়ার ঝুলন্ত ব্রিজটাকে নিয়ে তেমন কোন বৃত্তান্তই লেখা হয় নি, যতটা না উচ্চশ্রেনির উন্মাদ হাওড়া ব্রিজ এর উপর উঠে যানজট তৈরী করেছে, মাঝে মাঝে মনে হয় শুধুমাত্র এই ব্রিজটার জন্য একে হাওড়া না বলে কলকাতা ব্রিজ বলা আর সেটাই হবে পঁচাত্তর বছরে উপযুক্ত সন্মান।

ব্রিজ ওপেনিং এর প্রথম দিন

যে কয়েক জন নদী পেরিয়েছে তাদের খোজঁ চলছিল, আমার বাবাই তো, তখন বছর পাঁচেক হবে তার বাবার সঙ্গে নদী পেরিয়েছেন, গল্পে গল্পে বলেছিল, তারপর থেকেই হাওড়া ব্রিজ আমার জীবনে দারুণ ছাপ ফেলে, নিজের সঙ্গেই কথাগুলো বলছিল।

 

শুভা মুদগল এর গানটা শেষ হতেই ফোনটা বেজে ওঠে, ওদিক থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

কি রে অতনু, কি করছিস

আরে বল, মিলন কেমন আছিস, কি খবর, তালে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করেই ফেললি, কি বল! নতুন বিবাহিত জীবনের জন্য অভিনন্দন রইল, আরে ওখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে নাকি, এখানে একটু কমেছে, ফোনে পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি, মনে আছে তোর এমন বৃষ্টির দিনে আমাদের ফুটবল খেলা!

=হ্যা মনে থাকবে না, বাবার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় থাকলেও মায়ের কাছে বকা খেয়েছি অনেকবার।

কি করছিস এখন?

=কিছু না, গান শুনছি এফএমে,

ঠিক আছে রাখছি রে, পরে কথা হবে, সুতপা রান্নাঘর থেকে ডাকছে, রাখলাম।

 

 

সুতপা, তাহলে মধুকে আসতে বলি, বসে আলোচনা করে নিই কি বলো, পরে আবার বাংলা সিরিয়ালের মত বৌ বোন এ ঝগড়া বাবার চার কাঠা সম্পত্তির জন্য, এটা ভালো দেখায় না।

তুমি যা ভাল মনে করবে তাই করো, মধু আমার ননদ যেমন আবার আমার ক্লাসমেটও তো।

যা করবে তাড়াতাড়ি করবে বর্ষা কমে গেলেই প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলবে,

নাও এবার খেয়ে নাও, এর বেশী কিছু করতে পারিনি,

বাহ্, এমন দিনেই তো খিচুড়ি খেতে হয়, জমে যাবে,

খাওয়া শেষ করে ঘরে আসে।

সত্যিই রান্নাঘর থেকে যে ভাবে জল পড়ছে ছাতা মাথায় দিয়ে খেতে হল, সত্যিই খুব খারাপ পরিস্থিতি।

 

অতনু প্রোমোটারের অফিসে আগে নিজে গেল, জানাজানি হয়ে গেলে সমস্যা বাড়বে, এ যুগে বুদ্ধিদাতার অভাব নেই, মানে বদবুদ্ধির।

প্রোমোটারের ঝঝকঝকে মারবেল ফিনিস, গ্লাস উইন্ডো দেখে অতনুর বেশ ভাল লাগল, এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় এসির কোন দরকার ছিল না, ঘুরে ঘুরে দেখছিল অতনু,

প্রোমোটার সিদ্ধার্থ রয়, অবাঙালী হলেও অনেকদিন এই কলকাতায়,

চা খাবেন তো, না কফি?

অতনু চুপ ছিল দেখে নিজে থেকেই চা আনতে বলে কমবয়সী ছেলেটাকে,,

নিন, এবার আসল কথায় আসা যাক,

আমি কিন্তু ফিফটি ফিফটিতে কাজ করি না, সিক্সটি ফর্টিতে যদি রাজি থাকেন তালে কথা এগোতে পারে।

নিন চা নিন,

সিদ্ধার্থ লোকটা খারাপ না, কাজও ভাল, বিনিতাদের ফ্লাটটাও ওই করছে, তখন একবার কথায় কথায় বলেছিল এবার আপনারাও করে ফেলুন, একটা সুন্দর টিপটপ ফ্লাট হবে, কে চায় বলুন তো, ছাঁদ থেকে জল পড়বে পুরোন দিনের পলেস্তরা খসা ঘরে থাকতে, কাজটা আমায় দিন দেখবেন, কেমন কাজ করি, সত্যি কথা বলতে কি ভগবানের ইচ্ছায় যে কটা কাজ করেছি সব কটাই এ ক্লাস, কোন গণ্ডগোল নেই, মানে আপনারা যেটাকে শান্তিপূর্ণ সমাধান বলেন।

দলিলটা এনেছেন তো সঙ্গে, অতনু দলিল সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল, প্রোমোটার দলিলটা এক নজর চোখ বুলিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিল।

বলল, আমরা আসলে প্রোমোটারের জাত, পাশা ওল্টাতেও পারি যেমন তেমনি, গন্ধ থাকলে দূর থেকে পেয়ে যাই সেই ক্ষেত্রে কাজ করা খুব রিস্কি হয়ে যায় বুঝলেন কিনা, আপনার জমির তো কোন সমস্যাই নেই বললেন, দাবি দাওয়াও নেই একমাত্র বোন ছাড়া, মানে মোটামুটি ক্লিন, তবুও দেখতে হয়, নাহলে, পরে যদি কোন অবজেকশন আসে তালে মাঝ পথে সব কিছু ভেস্তে যাবে।

তাহলে, দুদিন পর আপনাকে জানাচ্ছি, আপনাকে আসতে হবে না, আমিই জানিয়ে দেবো, ক্লিয়ার আছে, এবার নিশ্চিন্তে এগোন যাবে।

 

সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ, স্ট্রীট লাইট সব জ্বলে উঠেছে, হাওড়া ব্রিজটা সেজে উঠেছে আলোর মালায়, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে, সুতপা চা নিয়ে এসেছে,,

কথা হল প্রোমোটারের সঙ্গে?

দলিলটা একটু দেখে নেবে, দুদিন পর জানাবে বলেছে,

শোনো, মধুর সঙ্গে কথা হয়েছে ওরা আসবে বলেছে, সামনের মাসে,

কথাগুলো বলে সুতপা নিজের কাজে চলে যায়,

টিভিতে বিশ্বকাপ চলছে, অ্যাপেল এর দৌলতে ভিআইএল মানে রাশিয়ার লেলিন আমাদের গোষ্টপালের স্টাইলে কিক করছে, এসব দেখলে খারাপ লাগে না, এটাই ঠিক, যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকেও পালটে ফেলতে হয় না হলেই পিছিয়ে পড়তে হয়, আর মানুষের মনকে বোঝাটাও প্রয়োজন, এটাই হয় তো সমাজ তন্ত্রের একটা ভুল ছিল।

 

দুই দিন পর

,,, ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছিল, খাওয়া শেষ করে অফিসে যাওয়ার আগেই ফোনটা বেজে ওঠে,

ওদিক দিয়ে সিদ্ধার্থবাবু বলে, আরে আপনি তো আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছেন।

অতনু ঘাবড়ে যায়

আমি আবার কি করলাম?

নানা, সরি, আপনি না, আপনার দলিল, আপনাকে বলেছিলাম না, আমরা প্রোমোটারের জাত গন্ধ থাকলে দূর থেকে পেয়ে যাই।

ঠিক আছে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ফ্লাট উঠে যাবে কোন সমস্যাই নেই, শুধুমাত্র এই দলিলের উপর ভরসা করে।

মানে?

মানে হচ্ছে এই দলিলটা একমাত্র দলিল নয়, আরেকটা দলিল আছে, আর সেটা আছে হেরিটেজ দফতরে, দেখুন ভাল করে খুঁজুন পুরনো বাড়ি কোন সিন্দুকে কোন ক্লু পেয়ে যাবেন, তালে পাশা উলটে দিতে পারি।

অতনু কিছুই বুঝতে পারছে না,

দাদা, আমার তো মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না,

হ্যা, আমারও ঢোকেনি, পরে বুঝতে পেরেছি, আপনিও পারবেন, আমি দলিলের কপিটায় মার্ক করে দিয়েছি।

আমি আপনার বাড়ির পাশের প্রানপনবাবুর জমিতে আছি, আসুন এখানেই কথা হবে।

অতনু গিয়ে সিদ্ধার্থবাবুর কথায় তেমন কোন ভয়ের বার্তা খুঁজে পায়নি, প্রোমোটারের এক মত, বলছে ফ্লাট তো উঠে যাবে পরে কোন সমস্যা হলে,পরিস্কার ভাবে তো এগোতে হবে, আমি যা বুঝলাম, আপনার বাড়ির প্রথম দলিলটি হয়েছিল আঠেরোশো আটানব্বই সালে মানে একশ বাইশ বছর আগে দূর্গাচরনবাবুর হাতে, আর দ্বিতীয় দলিলটি হয়েছে, ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সালে, মানে চুয়াল্লিশ বছর পর নতুন করে দলিলটি হয়, আপনার পিতামহ মানে ঠাকুরদার হাতে।

দাড়াঁন, দাদা আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

এতেই এই অবস্থা! কটা সালের হিসাব দিয়েছি, আর আমাদের কত জিনিস মাথায় নিয়ে চলতে হয় দেখেছেন?

ঠিক আছে, আজ থেকে আপনার কোন মাথা ব্যাথা করতে হবে না, যা করার আমিই করব, কথা দিলাম। কিন্তু তার আগে একবার হেরিটেজ দফতরে যেতে হবে, আমি যেতে পারবো না, অসুবিধা আছে, আপনিই যাবেন, সেখানে তিয়াস বলে এক জন কমবয়সী ছেলে থাকবে, তাকে সব বলাই থাকবে, সে শুধু জানাবে কি কারনে হেরিটেজ দফতরে এই ফাইলটা এল।

 

অতনু প্রমোটারের কথা মত হেরিটেজ দফতরে গেছিল, সেখানে তিয়াসের সাহায্যে যা জানতে পারলো তাতে চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার কথাই, তিয়াস জানাল, একটা সিম্পেল ফাইল, হেরিটেজের কোন গন্ধ নেই এই ফাইল এখানে এল কি করে, আর বিয়াল্লিস বছর পর নতুন দলিলের সঙ্গেও তেমন কোন পার্থক্যও নেই, তিয়াসসেভাবেকিছুইবলতেপারলোনা।

তিয়াস এও বলল ফাইল যে ভাবে ঘুমিয়ে আছে সে ভাবেই থাকুক না, অসুবিধা কি?

তিয়াসের কাছ থেকে অতনু ফিরে এল অস্বচ্ছ একটা ভাবমূর্তি নিয়ে।

প্রোমোটার ফোন করেছিল আসার পর, অতনু ধরে শুধু বলেছিল আপনার সঙ্গে দুদিন পর দেখা করছি।

 

সন্ধ্যা হয়ে গেছিল অনেকক্ষণ, অতনু সোফায় হেলান দিয়েছিল, সামান্য চোখটা ধরেও এসেছিল, তিয়াসের কথাটা মাথায় ঘুরছিল, ফাইলটা যেমন ঘুমিয়ে আছে তেমন ঘুমাতে দিন, অসুবিধা নেই যখন, পুরনো বাড়ি নিয়ে আমাদের কাজ, কত গল্প লুকিয়ে আছে দেওয়ালে দেওয়ালে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ সে আমরা জানি।

সুতপা এসে ডাকায় হুঁশ ফেরে,

নাও চা নাও,

তিয়াসের দেখা পেয়েছো কথা হয়েছে?

অতনু বলে, ফাইলটা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগানো কি সত্যিই কোন দরকার আছে,

সুতপা, অতনুকে বলল তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, পরিস্কার করে একটু বলবে,

অতনু বলল, জানো, আমার বাবা বলত, সত্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়াটা যেমন কষ্টকর, তেমনি একটা মিথ্যেকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার পর নিজের কাছে হারটাকে মেনে নেওয়াও কষ্টকর।

সুতপা বলল তুমি দেখছি দার্শনিক হয়ে গেছো, আমি বলছি তিয়াসের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা…

অতনু চুপ ছিল দেখে সুতপা দূর! বলে চলে গেল,

অতনু আবার সোফায় হেলান দিয়ে রইল,

ঘড়ির কাটা সাতটা ছুঁয়েছে, প্রোমোটারের কথাটা মাথায় ঘুরছে, দেখুন, খুঁজে পুরনো সিন্দুকে কিছু পেয়ে যাবেন,

তিয়াস বলল পুরনো বাড়ির ভিতর কত কত গল্প চাপা পড়ে আছে কেউ কোন দিন

জানবেও না।   অতনু সুতপাকে ডেকে বলল কাল একবার পুরনো সিন্দুকটা খুলবো, কোন হারিয়ে যাওয়া কাহিনী থাকলেও থাকতে পারে,

সুতপা রান্নাঘরের কাজে গেল অতনু মাথায় ভিড় করা কিছু কথার হদিস খুঁজছিল,

বাবা, গল্পচ্ছলে বলতেন আমাদের বাড়ি পুজোর সময় এক সাহেব আসতেন, সে ছিল ডাকসাইটে একজন বিদেশী সাহিত্যিক, কলকাতার দুর্গাপুজো দেখে নিজের দেশে ফিরে যেতেন, তিনি প্রেসিডেন্সিতে পড়েছেন আমার বাবার সাথে মানে তোর ঠাকুরদা অতনুর এরকম ভাসাভাসা প্রশ্নের বেশী জানা ছিল না।

সকালে চিলেকোঠার ঘরে সিন্দুকটি অনেক কষ্ট করে খোলার পর একটা ডাইরি ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না, তাও আবার খাপছাড়া কিছু লেখা। ডাইরিটা নিচে নিয়ে আসে, দেখতে লাগে।

মনে হচ্ছে কোন আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছিল মাত্র, হয় তো শুরু করেছিল।

প্রথম পাতাতে সত্যিই লেখা বাবার সেই কথার মিল খুঁজে পেল অতনু।

“সেবার পুজো ছিল কার্তিক মাসে, ইতিমধ্যে একমাস আগেই সাহেব এসে উপস্থিত, এদিকে কুসুমের মন খারাপ, তার কোন কারন জানতে পারলো না কেউ, সে শুনেছিল সাহেব এবার হয়তো আসতে পারবে না, সাহেব আসবার মাত্র কুসুমের মনের যে পরিবর্তন হয়েছিল, সে একমাত্র আমিই বোধ করি বুঝতে পেরেছি।”

তার কয়েক পাতার পর আবার লেখা।

“হাওড়া কান্টিলিভারের প্লানের কাজ চলছিল, তখন। রেন্ডল পামার এন্ড ট্রাইটন কোম্পানির হয়ে কাজে নিযুক্ত হয়। কয়েক মাস আমাদের বাড়িতে থেকেছিল, সাহেব ছিল মৃদুভাষী, খুব মার্জিত, বাংলা সাহিত্যের প্রতি দারুণ অনুরাগী, সাহেব তার স্বরচিত কয়েকটি গল্পের অনুবাদ করেছিল এক বাঙালী সাহিত্যিকের কাছ থেকে শুধুমাত্র কুসুমকে পড়াবে বলে।

সেদিন ছিল বিজয়া দশমী, বিসর্জন, সবাই আমরা ঘাটে ছিলাম, সাহেবও ছিল, সিঁদুরখেলা চলছিল সাহেব বাঙালী রীতি জানতো না, ভুলবসত কুসুমের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়, কুসুম লজ্জায় ঘরে ঢুকে যায়, কেউ নজর করেনি সেদিন।

কুসুম সাহেবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিল, পুরোটাই বাবার নজর এড়িয়ে। সাহেব সেদিন, ঘুড়ি উড়াচ্ছিল, কুসুম সাহেবের সাথে হাস্যালাপ করছিল যা, বাবার চোখে পড়ে যায়।”

তার পরের পাতাগুলো ছেঁড়া ছিল, তার সাথে অন্ধকারে থেকে গেল অতনু।

একটা চিঠি ডাইরির ভিতর থেকে নিচে পড়ে গেল, আর সেটাই অতনুকে টলিয়ে দিল,

কুসুম লিখছে “দাদা, যখন এই চিঠি পড়বে, তখন আমি সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে অনেকটাই চলে গেছি, বাবাকে জানিও, আমি ভাল মেয়ে হতে পারিনি, কিন্তু সাহেব খুব ভাল মানুষ, পরে জানতে পারবে”।

অতনু ডাইরি বন্ধ করে,,

সুতপা…ডাইরিটা কাল ভাসিয়ে দেবো, চিরতরে ঘুমিয়ে থাকবে নদীর বুকে, কেউ জানবে না,

সুতপা ম্লান দৃষ্টি দিয়ে চেয়েছিল, আলোর শহর আজ যেন এখনো ঘুমিয়ে আছে আশ্চর্যজনক ভাবে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − two =