হেরে যাওয়ার আগে লড়তে শেখায় ‘কাহ্ন পদাবলী’
দীপাঞ্জন রায়
মানুষ যত আধুনিক হয়েছে, ততই আলগা হয়েছে শিকরের টান। আমরা ভুলতে বসেছি ইতিহাস, ভুলেছি আমাদের অতীত। এই ভুলতে বসা ইতিহাসকে আরও একবার মনে করাবে সাউথ গড়িয়া আনন্দ মহল থিয়েটার গ্রুপের নাটক ‘কাহ্ন পদাবলী’। বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই নাটক ইতিমধ্যেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। সম্প্রতি রবীন্দ্র সদনে মঞ্চস্থ হয়ে গেল এই নাটকটি। নাটকের মূল বিষয়বস্তু বাংলা ভাষার গোড়ার কথা। আরও বিষদে বললে চর্যাপদ। চর্যাপদের কবি কাহ্নপাদের জীবনী নিয়েই এই নাটক নির্মিত হয়েছে। এই নাটকের নাট্যকার এবং পরিচালক সৌরভ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে নাটকটি উপস্থাপন করেছেন। প্রায় ২০-২২ জন যুবক-যুবতীর অদম্য উচ্ছ্বাস এই নাটকের প্রাণবায়ু। কবি কাহ্নপাদ রাজা বুদ্ধমিত্রের দরবারে পাখা টানার কাজ করে। তার মনের সাধ রাজদরবারে সে একদিন নিজের লেখা গীত পড়বে। রাজার অনুমতি পেলেও, মন্ত্রী দেবল ভদ্রের কটাক্ষের শিকার হয় কাহ্নপাদ। এখানেই শুরু নাটকের দ্বন্দ্ব। কাহ্নপাদের স্ত্রী শবরী তাঁকে গীত লেখার সাহস যোগায়। অন্যদিকে গ্রামের বিধবা মেয়ে ডোম্বি কানুকে লড়াই করার সাহস দেয়। ডোম্বিকে কাহ্নপাদ ভালোবাসে। সে কথা জানে শবরী, তবুও প্রতিবাদ করে না। কারণ কাহ্নপাদ যে শবরীকে দেবী রূপে পূজা করে। কাহ্নপাদের লড়াই ভালো চোখে দেখে না মন্ত্রী দেবল ভদ্র। অপমানের রোষে কাহ্নপাদের হাতের আঙুল কেটে নেয় মন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েও জিতে যায় কাহ্নপাদ। কানু, দেশাখদের হার না মানা মানসিকতা, লড়তে শেখায় আমাদের।
নাটকের প্রতি দৃশ্যে রয়েছে উৎকন্ঠা, রয়েছে দুর্দান্ত অভিনয়। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়। দুর্দান্ত সংলাপ প্রক্ষেপণ এবং শারীরিক অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। দেশাখের চরিত্রে অমিত মন্ডল অনবদ্য। এই নাটকের সম্পদ তিনি। ডোম্বির চরিত্রে ইন্দ্রাণী পাল নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। দেশাখের বিপরীতে সমানতালে পাল্লা দিয়ে গিয়েছেন বিশাখার চরিত্রে জয়শ্রী। অবশ্যই এই নাটকে আলাদা প্রশংসার দাবি রাখে অরুন চরিত্রটি। একাধারে সূত্রধর এবং দেশাখের সহচরের চরিত্রটি সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন মেহতাব মন্ডল। ছোট চরিত্রের মধ্যেও নিজেকে সুন্দর ভাবে মেলে ধরেছেন কেয়া দে। আর যার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন এই নাটকের মূল প্রোটাগনিস্ট “মন্ত্রী দেবল ভদ্র”। শরীরি ভাষা, সংলাপ বা এক্সপ্রেশন, সবেতেই অতুলনীয়। প্রথমার্ধের শেষে মন্ত্রীর চোখের ক্রুরতা দর্শককে করতালি দিতে বাধ্য করে। এবার আসি নাটকের আনুষঙ্গিক বিষয়ে। গোটা নাটকের আবহ নির্মান খুব ভালো হলেও, প্রক্ষেপণ আরও ভালো হতে পারতো। আলোক পরিকল্পনা খুব সুন্দর। পোষাক এবং রূপসজ্জাও প্রশংসার দাবি রাখে। সব মিলিয়ে বাংলা থিয়েটারে আলাদা মাত্রা যোগ করতে পারে আনন্দ মহলের ” কাহ্ন পদাবলী”।