১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহ ও উধাদেবী

আদিত্য বর্মন 

 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা।  খন্ড – বিখন্ড,  ছোট – বড়,  হিন্দু – মুসলিম নানা ভাগে বিভক্ত ভারত সেই প্রথম একত্রিত হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে।

যদিও আক্ষরিক অর্থে  মহাবিদ্রোহ তার কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে পারেনি। তথাপি এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ১৮৫৭  পরবর্তী কালের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিকট ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিল।

মহাবিদ্রোহ এর বহুল প্রচলিত নেতৃবৃন্দের সাথে সাথে তথাকথিত অনামী বহু সেনানী  দের ও রক্তে লাল হয়েছে ভারতের মাটি। এরকমই একজন যোদ্ধা হলেন উধাদেবী।

কানপুরের দলিত ঘরে জন্ম উধাদেবীর।  ১৮৫৭ এর মে মাসে ব্যারাকপুরের ২২ নম্বর রেজিমেন্টের সেনা মঙ্গল পান্ডে ব্রিটিশ বিরোধী যে  অগ্নি প্রথম প্রজ্জ্বলিত করেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্রোহী আগুন দিল্লী, ঝাঁসী, কানপুর সহ ভারতের এক বিরাট অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে৷

বিদ্রোহের এই উষা লগ্নে উধাদেবী অযোধ্যার বেগম হজরত মহাল-এর নেতৃত্বে গঠিত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।

বেশ কিছু দিনের মধ্যেই নিজ রণ নৈপুণ্য ও বিচক্ষন ক্ষমতার প্রদর্শন দ্বারা বেগম হজরত মহাল এর দরবারে উচ্চপদ লাভ করেন। এমন কি মহাবিদ্রোহে কানপুরের নারী বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি।

১৮৫৭ সালের ৩০ শে মে ক্যাম্বেলের নেতৃত্বে বিপুল সসস্ত্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অযোধ্যা আক্রমণ করেন। এই পরিস্থিতিতে  উধাদেবীর নেতৃত্বে বিদ্রোহী সেনাবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং অনেকাংশে সফলও হন।

যদিও  প্রথম যুদ্ধে বিদ্রোহী সেনাবাহিনী  প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও পুনরায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অযোধ্যা দখল করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন।

১৮৫৭ এর নভেম্বর মাসে কোলিন ক্যাম্বেলের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী  লক্ষৌর সিকান্দার বাগ আক্রমণ করলে বিদ্রোহী সেনাবাহিনী  উধাদেবীর নেতৃত্বে গেরিলা পদ্ধতিতে পুনরায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

১৮৫৭ সালের ননভেম্বরের সিকান্দারবাগের যুদ্ধে উধাদেবীর রণনৈপুন্য কোম্পানী বাহাদুরের সৈন্যবাহিনীকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল, রণস্থলের নিকটস্থ একটি পিপুল গাছের উপর থেকে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করতে থাকেন এবং গেরিলা পদ্ধতিতে অগ্রসরকারী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন।

উধাদেবীর যুদ্ধ পরিচালনা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে  আক্রমনাত্মক করে তুলেছিল। কিছুক্ষন আক্রমণ – প্রতি আক্রমণের পর ব্রিটিশ সেনাপতি কলিন ক্যাম্বেল গাছের উপরে অবস্থিত বিদ্রোহী সেনাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করেন,  এবং গুলিবিদ্ধ মৃত সৈনিকের দেহ উদ্ধার করেন।  অনুসন্ধান মারফৎ জানা যায় যে মৃতদেহটি হল সিকান্দারবাগ যুদ্ধের বিদ্রোহী সেনাপতি  ‘উধাদেবী’ র।

উইলিয়াম ফোর্বস মাইকেল তার রচিত ‘ রিমিনিসেন্সেস অফ দ্য গ্রেট মিউটিনি ‘ গ্রন্থে এ বিষয় আলোকপাত করেন,  তিনি বলেন যে,  উধাদেবী একজোড়া ভারী পুরানো পিস্তল বহন করেছিলেন, যার মধ্যে একটি বন্দুক তখন ও পর্যন্ত অব্যবহৃতই ছিল৷

তিনি তার রচিত গ্রন্থে আরও বলেন যে,  সিকান্দারবাগ এর যুদ্ধে উধাদেবী ৩২/৩৬ জন ব্রিটিশ সেনা কে হত্যা করেছিলেন।  এবং তার সুরণনৈপুণ্যে বিপুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর  প্রায় সম্মুখ ভাগ আহত ও নিহত হয়েছিল।

কথিত আছে যে  মৃত্যুর পর যখন উধাদেবীর সাফা খোলা হয় তখনই প্রথম লক্ষিত হয় যে বিদ্রোহী সেনাপতি একজন নারী৷  একথাও বলা হয় যে সন্মান পূর্বক ব্রিটিশ সেনাপতি কলিন ক্যাম্বেল উধাদেবীর মৃতদেহের সামনে টুপি খুলে রাখেন।

১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহের এক অনালোচিত অথচ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন চরিত্র হলেন উধাদেবী৷  যিনি নিজ যোগ্যতায় না কেবল নিজে উদ্ভাসিত হয়েছেন,  সাথে সাথে নারী,  বিশেষত   দলিত মহিলাদের মনে স্বাধীনতার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছেন।।।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × one =