দে দৌড় দেউলপাড়ায়

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

দুপাশে ঘন সবুজ ধান ক্ষেত। মাঝে নির্জন শান্ত স্টেশন। ট্রেনের আনাগোনায় সামান্য ব্যস্ততা এলেও বাকি সময়টুকু স্বাভাবিক আলসেমিতে বুঁদ হয়ে থাকে এ অঞ্চলের স্টেশনগুলি। আমাদের যাদের কলকাতা বা সংলগ্ন অঞ্চলে বাস তাদের কাছে রেল স্টেশন মানেই হৈচৈ-কলরব-দোকান পাট-নতুন পুরনো মানুষের আসাযাওয়ার ধারাবাহিক ব্যস্ততা। তাই সেই ব্যস্ততা ছাড়িয়ে আমাদের গন্তব্য হুগলির তালপুর-তকিপুর-মায়াপুর। যেখানে এখনও প্ল্যাটফর্মে দেখা মেলে জবা, জুঁই বা মাধবীলতার। ট্রেন না এলেও স্বাভাবিক সবুজের মাঝে বসে কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকটা সময়।

হাওড়া থেকে আরামবাগ লোকালে সরাসরি আসা যায় এ তল্লাটে। তাছাড়া তারকেশ্বরে এসে ফের ট্রেন বদলে বা বাসে করেও যাওয়া সম্ভব। তবে যেদিক দিয়েই যান না কেন হাঁটাহাঁটির অভ্যাস না থাকলে কিন্তু এ পথে যাওয়ার মানেই হয়না। সকাল সকাল রওনা দিয়ে হাওড়ার বালি স্টেশন থেকে আরামবাগ লোকাল ধরলাম আমি। ঘন্টা দেড়েকের পথ। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে কেটে গেল সহজেই। সরাসরি গিয়ে নামলাম মায়াপুরে। না নদিয়ার বিখ্যাত মায়াপুর নয়, হুগলির এই মায়াপুরেরও নিজস্ব একটা পরিচয় রয়েছে। ট্রেন থেকে নেমেই মনটা ভাল হয়ে গেল স্টেশন চত্বর দেখে। পরিচ্ছন্ন প্ল্যাটফর্ম, ট্রেন চলে যেতেই নিঃঝুম চারদিক। বসে রইলাম খানিক ক্ষণ।

ট্রেনে আসার পথেই দেখে নিয়েছি সামান্য ব্যবধানে দু দুটি নদী পেরতে হয়েছে। মায়াপুরের কাছে রয়েছে মুণ্ডেশ্বরী নদী। এক ঝলক দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম মুণ্ডেশ্বরীর। হাঁটা লাগালাম সেদিক পানেই। রাস্তা আছে বটে তবে সে পথ গিয়েছে অনেকটা ঘুরে, তাই রেললাইন ধরেই চলার শুরু। এ পথে ট্রেন কম তাই রেললাইনে হাঁটায় বিপদটাও তুলনামূলক কম। দুপাশে ধানের ক্ষেত, মাঝে লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মুণ্ডেশ্বরীর ধারে।

হাঁটুজল নদীতে, কোথাও কোথাও আরও কম। নদীর ধার বরাবর যাওয়া যায় অনেকটা দূর। গ্রাম ছাড়ালেই সবুজ ঘাস, একাকী নদী এবং নির্জনতা। ঘাসের ওপরে বসে রইলাম বেশ কিছুটা সময়। জলে নেমে কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যাওয়া গেল শৈশবে। দূরে মাছ ধরছে গ্রামের কচিকাঁচার দল। ঠান্ডা জলে বেশ ভালই লাগছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার জো নেই, অন্য নদীটাও টানছে যে।

মুণ্ডেশ্বরী পেরিয়ে বেশ খানিকটা গেলে তকিপুর রেলস্টেশন। সেটিও ভারি সুন্দর। মায়াপুরের মতই ফাঁকা, নির্জন, গাছগাছালিতে ভরা। স্টেশনের পাশ দিয়ে গিয়েছে রাস্তা, ট্রেকার যায় দেউলপাড়া-অমরপুর রোডে। আমি কিন্তু পদব্রজেই স্বচ্ছন্দ। গুটিগুটি পায়ে প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর দেখা পেলাম দামোদরের। সবুজ জলে রেলব্রিজের ছায়া। ওপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনের জলছবি ভাল লাগায় নতুন করে। দামোদরের এদিকটায় লোকবসতি কম। তাই নিরিবিলি নদীর সঙ্গে গল্প করাই যায়।

দামোদর দর্শন সেরে এবার আমার গন্তব্য দেউলপাড়া। এখান থেকে খুব দূর নয় মাত্র চার কিলোমিটার। ট্রেকার আছে বটে তবে সংখ্যায় অনেকটাই কম। নদীর ধার দিয়ে পিচঢালা সুন্দর পথ দেখে আমি এবারেও হিউএনসাং-এর অনুগামী। আসলে এখানে আসার সময়ই শুনে নিয়েছিলাম এই হুগলি জেলার অন্যতম পর্যটন স্থল দেউলপাড়া।

আধ ঘন্টার হাঁটা পথ, পৌঁছে গেলাম দেউলপাড়ায়। বাঁ হাতে দূর থেকেই নজরে পড়ছিল মন্দিরচূড়া। আর একটু এগোতেই মন্দিরের ফটক। হুগলী জেলার একমাত্র বৌদ্ধ মন্দিরটি কিন্তু বয়সে নেহাতই নবীন। ন’ বিঘা জমির এই মন্দির চত্বর সুন্দর করে সাজানো নানা ফল ও ফুলের গাছ দিয়ে। মূল মন্দিরের ডান দিকে পাথরের ফলকে লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৮৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলাই লামা এই ‘ত্রিরত্ন সংঘ শান্তিবন বুদ্ধবিহার’-এর উদ্বোধন করেন। ভিতরে প্রশস্ত উপাসনাকক্ষ। বেদীর উপর শান্ত সমাহিত শ্বেত পাথরের ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি। এটি নাকি বিদেশ থেকে আনা। চারটি বিরাট পুষ্পস্তবক। বেদীর নীচে মোমবাতি জ্বলছে। হলঘরের তিন দেওয়ালে তথাগতের জীবনকথা নিয়ে বড় বড় তৈলচিত্র।

মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা তারকচন্দ্র বাইরি প্রয়াত। জানা যায়, সস্ত্রীক উত্তর ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে এক বুদ্ধমন্দির দেখে তাঁর মনে অন্য উপলব্ধি জাগে। শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ, মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং উদ্বোধনের জন্য দলাই লামাকে আমন্ত্রণ। বুদ্ধপূর্ণিমায় জাঁকজমক করে উৎসব হয়। দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটক আসেন। হিন্দুদের পবিত্র ও জনপ্রিয় ধর্মস্থান তারকেশ্বরের কাছেই এই বৌদ্ধ ধর্মস্থান।

দেউলপাড়ায় রয়েছে আরও প্রাচীন মন্দির। এর মধ্যে দেবনাথ বাড়ির শিব মন্দির উল্লেখযোগ্য। দুটি পাশাপাশি মন্দির, কিন্তু দেখভালের অভাবে ধ্বংসপ্রায়। একটি মন্দির কোনও রকমে টিকে আছে। এত দূর থেকে তাঁদের বাড়ির মন্দির দেখতে এসেছি শুনে বেশ খুশি হলেন দেবনাথ পরিবারের সদস্যরা। সেই সঙ্গে একটু আক্ষেপও বেশ কয়েকবার দেখে যাওয়া স্বত্বেও সরকারের তরফে এই মন্দির সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ঠিক এই কারনেই দেব বাড়ির প্রাচীন মন্দির ভেঙে সেখানে গড়ে উঠেছে নতুন মন্দির। টেরাকোটার কাজের সুন্দর সাবেকি মন্দিরের পরিবর্তে সাদামাটা এই নতুন মন্দির অবশ্য আমাকে বেশ হতাশই করল।

দেউলপাড়া তারকেশ্বর থেকে খুব দূরে নয়। তাই যারা দেউলপাড়ায় সরাসরি আসতে চান তারা সরাসরি বাসে চলে আসতে পারেন। এখানেও দামোদরের ধারে বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আমিও একটা বাস ধরেই তারকেশ্বরে চলে এলাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি হয়েছে। সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার দিয়েই মাঝে মধ্যে পেটপুজো সেরেছি। এবার ভাল কিছু না খেলেই নয়। তারকেশ্বরে অবশ্য প্রচুর ভাল হোটেল এবং রেস্টুর্যা ন্ট রয়েছে। খাওয়া দাওয়া সেরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে নিশ্চিন্তে উঠে বসা গেল। দিনভর প্রচুর হাঁটাহাঁটি পরিশ্রম হয়েছে। ঘোরাঘুরির ফলে মনও তৃপ্ত। তাই ট্রেন চলতেই বুজে এল চোখ। স্বপ্নে আবার ফিরে এল মুন্ডেশ্বরী, দামোদর আর সেই নির্জন দুই স্টেশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + one =