রসকদম্ব-কানসাট
পলাশ মুখোপাধ্যায়
যাওয়া মানে খাওয়ায় এবার আমরা একটু উত্তরমুখী। পুজোর মরসুমে ঘরের কাছে নয় আমরা যাব মিষ্টি মুখ করতে একটু দূরে মালদহ বা মালদায়। মালদা মানেই আম বাঙালির মাথায় আসে সুমিষ্ট নানা আমের নাম। কিন্তু জেনে রাখা ভাল মালদহে গেলে অবশ্যই আমের সঙ্গে সঙ্গে চেখে দেখতেই হবে দুই ডাকসাইটে মিষ্টি কানসাট এবং পোস্ত জড়ানো রসকদম্ব।
হাতে একদিন সময় থাকলেই চলবে। ছোট্ট সফরের জন্য মালদা শহর অনবদ্য। ভ্রমন পিপাসু বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা ইতিহাস ভালবাসেন মালদা তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা। তবে মালদা যে শুধু মসজিদের তা নয় মোটেও। এখানকার আম, পাটের কাজ আর সিল্ক তিনটিই জগত বিখ্যাত। রয়েছে বিখ্যাত সব মন্দিরও। তবে আমাদের এই যাওয়া এবং খাওয়ার সফর এবার শুধু মালদা শহরকেন্দ্রিক। কলকাতা থেকে ট্রেনে মালদা যেতে মোটামুটি ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে। রাতের ট্রেন ধরাই ভাল। আমিও রাতের বেলা গৌড় এক্সপ্রেসে চেপে পড়লাম। রাতে টানা ঘুম দিয়ে সকাল সকাল পৌঁছলাম মালদা টাউন স্টেশনে। স্টেশনেই আমার অপেক্ষায় ছিল ভাতৃপ্রতিম সাংবাদিক করুনাময় সিংহ। করুনাময়ের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম আমার ঝটিকা মালদা সফরে।
ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে সকালের জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য, শহর থেকে সামান্য দূরে জহরা কালীবাড়ি। প্রায় চারশো বছরের পুরনো এই কালীবাড়ি জগদ্বিখ্যাত। এখানকার কালীমূর্তিটি গতানুগতিক কোনও কালী মন্দিরের মত নয়। সিঁদুর লেপে তৈরি মুখোশের মতো।
স্থানীয়দের মুখেই শুনলাম আগে এই অঞ্চল জঙ্গলে ঢাকা ছিল। মূলত এই অঞ্চলের ডাকাত বা লুটেরাগণই এই মন্দিরে পুজো করত। অবিভক্ত ভারতে দুই বাংলা থেকেই নানা মানুষ আসতেন এখানে পুজো দিতে। এখনও দেশের নানা প্রান্ত এবং বাংলাদেশ থেকেও মানুষ আসেন এখানে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে শনি এবং মঙ্গল বার পুজোয় ভিড় হয়। মেলা বসে।
জহরা কালীবাড়িতে যাওয়ার আরও একটি মজা আছে। এখানে ঘোড়ার গাড়ি চেপে যাওয়া যায়। বহু মানুষ এখনও ঘোড়ার গাড়ি চেপেই এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।
মালদার আমবাগানের কথা না বললে মালদার রূপবর্ননা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মালদায় এসে আমবাগান দেখব না তা কি হয়? করুনাকে বলতেই সে একপায়ে খাড়া। বেশি দূর যেতে হল না, সামান্য এগিয়েই পথের দুধারে চোখে পড়ল বিরাট বিরাট আমবাগান। ছায়া সুনিবিড় শান্ত সেই সবুজের দেশে দু দণ্ড না জিরোলে জীবনের কোন দাম আছে কি? না, এ সময় গাছে আম নেই, তাই বাগান এখন চুপচাপ, নির্জন।
এবার বাগান থেকে ফের লোকালয়ের পথে। এবার যাব কানির মোড় এলাকায় মনস্কামনা কালী মন্দিরে। এই মন্দিরও প্রাচীন এবং জাগ্রত মন্দিরগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য। ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠা মনস্কামনা কালী মন্দিরের। শোনা যায় এই কালী মন্দিরের নিচ দিয়ে ছিল গোপন রাস্তা যেটা নাকি সরাসরি গৌড়ে গিয়ে উঠত।প্রচুর মানুষ আসেন এখানে পুজো দিতে।
ঘোরাঘুরি তো অনেক হল এবার খাওয়া দাওয়ার পালা। দুপুরের ভাতের কথা বলছি না মশাই। সে কাজ তো আমবাগান থেকে বেরিয়েই সারা হয়ে গিয়েছে। এবার আমাদের গন্তব্য মালদার দুই অতি জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত মিষ্টি কানসাট আর রসকদম্ব-র সন্ধানে।
স্বাদ এবং গন্ধে পাগল করে দেয় নাকি কানসাট। এমন সুন্দর একটা মিষ্টির এমন অদ্ভুত নাম কেন? জিজ্ঞাসা করতেই মিলল উত্তর। আসলে সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে কানসাট বলে একটি জায়গা রয়েছে। সেখানেই নাকি এই মিষ্টি তৈরি হয়।তারপর কোন এক সময়সেখান থেকে এই মিষ্টি এপারে চলে আসে। ছানা দিয়ে তৈরি হয়, তার ওপরে থাকে ক্ষীরের প্রলেপ। সদ্য তৈরি কানসাটের স্বাদ-ই আলাদা। পুরনো হলে এর আসল স্বাদ বুঝতে পারবেন না।
রসকদম্বের উৎস পাওয়া যায় না। তৈরি হয় ক্ষীর এবং ছানা দিয়ে। ওপরে পোস্ত ছড়ানো থাকে। তবে অনেক মিষ্টি প্রস্তুতকারক এখন পোস্তর জায়গায় ক্ষীরের গুড়োও ছড়িয়ে দেন। এই মিষ্টিটিও কিন্তু খেতে অসাধারণ। তবে মালদা শহরের যে কোন জায়গা থেকেএই দুটি মিষ্টি খেলে কিন্তু ঠিকঠাক স্বাদ নাও মিলতে পারে। নেতাজি মোড়ের রতন সুটইস, সুকান্ত মোড়ের রাধারানী মিষ্টান্ন ভান্ডার অথবা রাজ হোটেল মোড়ের পাবনা সুইটস-এর সুনাম রয়েছে মিষ্টি তৈরির ক্ষেত্রে।
আরও একটা খাবারের নাম শুনলাম বটে তবে সেটা খাওয়া হল না। এভাবে খাওয়া সম্ভবও ছিল না অবশ্য। সেটি হল নবাবগঞ্জের বেগুন। লাউ-এর মতো দেখতে এই বেগুন নাকি ভারি মিষ্টি। শুধু ভেজে খেলেই ভাল লাগবে। দিনভর বেড়ানো শেষে এবার আমাদের ফেরার পালা। সেই গৌড় এক্সপ্রেসই ভরসা। করুনাময়কে বিদায় জানিয়ে নটা নাগাদ গৌড়ে চেপে বসলাম। রাতের খাওয়া ষ্টেশনের বাইরেই সেরে নিয়েছিলাম। তাই ট্রেন ছাড়তেই ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে। পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল ট্রেন তখন শিয়ালদা ঢুকছে।