পা বাড়ালেই পায়রাডাঙ্গা
পলাশ মুখোপাধ্যায়
##
একটা দিন নদীর সঙ্গে, একটা দিন নদীর মাঝে। হ্যাঁ, এবারের ঘুরণচণ্ডীর ডায়েরিতে আমরা একটু নদীর সঙ্গে কথা বলব। তাও আবার একটা নয়, দু দুটো নদী দিনভর থাকবে আপনার জন্যে, আপনার সঙ্গে। তাদের ছলাৎ ছল আওয়াজ ঢেউ তুলবে আপনার বুকেও। একাকী হোক বা দুজনে, নদীর বুকে ছোট্ট তরীটি নিয়ে যাবে অচিন সুখের দেশে।
শিয়ালদা থেকে রাণাঘাটগামী একটি লোকাল ট্রেনে চড়ে বসেছিলাম সকাল সকাল। গন্তব্য পায়রাডাঙ্গা। নদীয়ার ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট্ট এই জনপদটির নাম একটু আধটু শুনে থাকলেও তা নিশ্চয় আপনার ভ্রমণ মানচিত্রে জায়গা পায়নি। এবার তাই আমাদের পায়রাডাঙ্গা অভিযান। কল্যানী পার হতেই বদলে গেল আশপাশের দৃশ্যপট। ঘন সবুজ আবহের মাঝেই ছুটে চলল ট্রেন। ও হ্যা, একটা কথা বলে রাখি এই লাইনে কিন্তু খুব ফাঁকা, নিরিবিলি ট্রেনযাত্রার আশা না করাই ভাল। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর অবশেষে ট্রেন পৌঁছল পায়রাডাঙ্গা।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য গ্রামের মতই রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে দোকানপাট ব্যাঙ্ক-এটিএমের দৌলতে গঞ্জের চেহারা পেয়েছে এই এলাকা। ষ্টেশন ছেড়ে একটু এগোলেই ফের পাওয়া যাবে পাড়া বা গ্রামের চেনা ছবি। ছোট ছোট বাড়ি, উঠোন, গাছগাছালি, শান্ত সবুজ মন ভালো করা একটা পরিবেশ। এখানে আমাদের গন্তব্য অবশ্য নদীর ধার। সে অনেকটা দূর। তা প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার তো হবেই। ছায়া ঘেরা পথে যদি হেঁটে যেতে পারেন আপত্তি নেই, কিন্তু অভ্যাস না থকলে সে চেষ্টা না করাই ভাল। কারণ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নদীর পাড়ে পৌঁছে সৌন্দর্যের রসাস্বাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ভ্যান রিকশা আছে বটে তবে আমার কিন্তু টোটো গাড়ি দেখে বেশ পছন্দ হল। দরদাম করে উঠে বসলাম একটা টোটোতে। শব্দহীন টোটো গ্রামের পথ বেয়ে এগিয়ে চলল তরতরিয়ে।
ভাগীরথী বাজারে পৌঁছে টোটোকে রেহাই দিয়ে দিলাম। এর পরের আধ কিলোমিটার পথটুকু হেঁটেই যাব। এই বেলা বলে রাখা ভালো এখান থেকে ফেরার ব্যবস্থা মোটেই ভালো নয়। দিনে কয়েকটা ট্রেকার চলে, বিকেলের পরে ভ্যানরিকশা মেলা ভার। তাই আগে ভাগেই ফেরার ব্যাবস্থা করে রাখা সমীচীন। আমিও আমাদের টোটো গাড়ির চালককেই বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে রাখলাম।
এবারের পথটুকু ভারি চমৎকার। আম, কাঁঠাল, আতা গাছের ছায়া ঘেরা পথের দুধারে নানা রঙের ফুলের বাহার। পাশেই সবজি ক্ষেত। দূরে সরষে ক্ষেতের হলুদ আভায় চোখে লাগে মায়াবী পরশ। হাঁটতে হাঁটতে কেমন যেন নেশা ধরে গিয়েছিল। সম্বিত ফিরল জলের আওয়াজে। সামনেই বিশালকায় গঙ্গা। গঙ্গার পাড় বরাবর এই জায়গাটিও বেশ সুন্দর। চারদিকে আমবাগান, তাই গোটা এলাকাটাই বেশ ছায়া শীতল। গরম কাল হলে তো আরও মজা, আমবাগানে বসে থাকলে নদীর দিক থেকে ধেয়ে আসা বাতাস যেন মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। খানিক বসে এগনো গেল নদীর ধার দিয়ে সামনের দিকে। এগোতেই মিলল চমক, চূর্ণী নদী এখানেই এসে মিলেছে গঙ্গার সঙ্গে। চূর্ণীর কাজল কালো জল মিশেছে গঙ্গার ফ্যাকাসে ঘোলা জলের সঙ্গে। মন ভালো করে দেবে দুই নদীর সঙ্গম।
নদীর ঘাটে সার দিকে বাঁধা নৌকা। কষ্ট করতে হল না, নিজে থেকেই এগিয়ে এলেন হারান মাঝি। দিলেন লোভনীয় প্রস্তাব। নদীর বুকে খানিক ঘুরে ফিরে নাকি যাওয়া যাবে দূরে গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা মঙ্গল দ্বীপে। শুনেই নেচে উঠল মন, তাঁর উপরে যখন শুনলাম মঙ্গলদ্বীপে কোন জনবসতি নেই তখন তো ভালো লাগার মাত্রাটা বেড়ে গেল। উঠে বসলাম নৌকায়। ভাসল আমাদের ছোট্ট সে তরী। হারান মাঝির সঙ্গেই গল্প-গুজবের মাঝে চলতে লাগল গঙ্গা বক্ষে নৌবিহার।
কাছে গিয়ে দেখা গেল মঙ্গল দ্বীপকে যতটা নির্জন বলে মনে করা গিয়েছিল ততটা নয়, কারণ নদী পেরিয়ে দূর গাঁয়ের অনেকেই এই দ্বীপে এসে কৃষিকাজ শুরু করে দিয়েছেন। তাদের সৌজন্যেই বড়, বড় কলাবাগান, নানা সবজির ক্ষেতে মঙ্গল দ্বীপে এখন সবুজের যৌবন। এখানে কয়েকজন কৃষিকাজে এলেও কেউ রাত্রিবাস করেননা। তাই দ্বীপটি এখনও কুমারী মেয়ের মতই সুন্দর। ভালো লাগে নির্জন সবুজের মাঝে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে।
আরও ভালো লাগে দ্বীপের শেষ প্রান্তে পৌঁছে জলের সামনে দাঁড়াতে। দুপারে ভাগ হয়ে গিয়েছে নদী। মাঝে জলে শীতল পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। এবার ফিরতে হবে হারান মাঝি তাগাদা দিচ্ছে। নৌকায় আরও কিছুক্ষণ নদীর বুকে ঘুরে ফিরে, ফিরলাম এপারে। এখানে কোন দোকানপাটের বালাই নেই, তাই সঙ্গে থাকা কিছু শুকনো খাবার দিয়েই আপাতত পেটপুজোর আয়োজন। খাওয়া দাওয়া সেরে যেতে পারেন চূর্ণী পেরিয়ে ওপাশে। দূরে গ্রাম, নদীর পাড় বরাবর মেঠো পথ, এপাশে গঙ্গা ওপাশে ধুধু মাঠ। পড়ন্ত আলোয় মন্দ লাগবে না।
আলো কমতেই এবার ফেরার পালা, ভাগীরথী বাজারে পৌঁছে দেখি টোটো চালক হাজির। ব্যাস চড়ে বসলাম তাতে। টোটোচালকই বললেন ফেরার পথে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ দেখে যেতে। সেই মতো যাওয়া হল ভারত সেবাশ্রম সংঘ বা হিন্দু মিলন মন্দিরে। গাছপালা ছাওয়া বেশ সুন্দর ছোট মন্দিরটি। না, ভগবানে তেমন ভক্তি না থাকলেও শান্ত এলাকায় পরিচ্ছন্ন এই মন্দিরটি বেশ ভালো লাগল।
এখান থেকে ষ্টেশন বেশি দূরে নয়, মিনিট খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। এবার একটু ভরপেট খাওয়ার পালা। ষ্টেশন চত্বরে নানা ধরনের খাবারের দোকান। রোল চাউমিন, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে পুরি, কচুরি, শরবত কি নেই? খাওয়া দাওয়া সেরে এবার ট্রেনের অপেক্ষা। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না, খানিক বাদেই চলে এল শান্তিপুর লোকাল। সন্ধের দিকে তেমন ভীড় নেই, মিলে গেল একটা বসার জায়গাও। বসে একটু হেলান দিতেই ব্যাস, কখন যে বুজে এল চোখ কে জানে? ঘুম যখন ভাঙল তখন দমদমে ঢুকছে ট্রেন…