পরিবর্তন

সুদীপ ঘোষাল, খাজুরডিহি, পূর্ব বর্ধমান

##

লতিকা স্বামীকে ডেকে বললো, শোনো আমি বাজারে যাচ্ছি। তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে।
স্বামী জয় বলে, ঠিক আছে। যাও।

জয় চাকরী করে একটা বেসরকারি কারখানায়। লোহার রড তৈরি হয়। ছুটি বুধবার। আর এই একটা ছুটির দিনে জয় আর বাইরে বেরোতে চায় না। নিজের পছন্দ গাছ লাগানো।  তাছাড়া বাড়ির উঠোনে ঘাস, জঙ্গল পরিষ্কার করতেই তার দিন কেটে যায়। আর লতিকা এই সুযোগে বাজার করা, বিল দেওয়া সব বাইরের কাজ সেরে নেয়।

যখন জয় চাকরী পায় নি,  তখন ছাত্র পড়িয়ে তার রোজগার হতো মোটা টাকা। সবটা খরচ না করে সে জমিয়ে রাখতো নিজের অ্যাকাউন্টে। বরাবর স্বাধীনচেতা ছেলে। কাউকে  নিষেধের বেড়ায় রাখতে তার মন সায় দিতো না। গ্র্যাজুয়েট হবার আগে অবধি মেয়েদের সাথে কথা বলতে তার শরীর ভয়ে কাঁপতো। তার কারণ আছে।

তখন কলেজর পড়ে। হিরু বলে একটা ছেলে ভালোবাসতো অনিতাকে। অনিতা আল্ট্রামডার্ণ মেয়ে। স্কুটি চালিয়ে কলেজে আসতো। আর পোশাকে ছিলো খোলামেলা মেজাজের পরিচয়। হিরু কালো সাদাসিধা একজন শহরের ছেলে। আমাদের বন্ধু বান্ধব অনেকে আড়াল থেকে অনিতাকে দেখতো কিন্তু সামনে গিয়ে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু হিরু পারতো। ওদের দুজনের কলেজে নাম হয়েছিলো, ওথেলো, দেসদিমোনা। জয়ের মনে পড়ছে, কলেজে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে…

একদিন হিরু বললো, অনিতা, চলো সিনেমা দেখতে যাই।  অনিতা রাজি হলো। হিরু আমাদের সকলকে যেতে বললো। আমরা সবাই অবাক। মলয় বলছে, কার মুখ দেখে উঠেছিলা। অসীম বললো, অনিতার সাথে সিনেমা। এই সুযোগ মিস করা যাবে না। ওদের পাল্লায় পড়ে জয়  গিয়েছিলাো। হাওড়ার পুস্পশ্রী হলে। ভিতরে অন্ধকার,  হিরু আর অনিতা সামনে এগিয়ে বসলো। জয়রা পিছনে।ওরা দেখলো ওরা সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে বসে। আলো আঁধারিতে এর বেশি কিছু দেখতে পায়নি জয়।

তারপর একমাস  হিরু ও অনিতাকে দেখতে পায়নি জয়।

লতিকা বাজারে গেছে। জয় বাড়িতে একা। মেয়ে স্কুলে গেছে। জয় বিছানায় গা এলিয়ে কলেজ জীবনের কথা ভাবছে। ঘন্টা খানেক হয়ে গেলো। লতিকা বাজারে গেছে।
জয় ভাবছে,আমার
নিজের মনের আয়নায় হিরুর ছবি।
অসীম একদিন আমাকে নিয়ে সুরে্ন্দ্রনাথ কলেজে গেছে। হিরুর সঙ্গে দেখা। অসীম বললো, কি ব্যাপার হিরু তোরা আর কলেজে যাস না। কেমন আছিস। এখানেই বা কি করছিস। হিরু নোংরা জামা প্যান্ট পরে কলেজের সামনে ফুটপাতে বসে আছে। আমরা তো নরসিংহ কলেজে পড়ি। আজকে কাজ আছে বলে এই কলেজে আসা।

আমি হিরুকে জিজ্ঞাসা করলাম, বল কিছু বল।
হিরু অন্ধকার মুখ তুলে বললো, জীবন শেষ। অনিতা বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেছে।

হাতে হিরুর সাদা কাগজে মশলা পুড়ছে। ধোঁয়াটা নাক দিয়ে টেনে নিচ্ছে।

তুই হেরোইনের নেশায় জীবন শেষ করিস না হিরু। বললো, অসীম। আমি বললাম কি করে জানলি তুই, যে ওটা নেশার জিনিস।
—- আমি আমাদের পাড়ায় একজনকে ওই নেশায় মরতে দেখেছি। তখন সকলের আলোচনায় বুঝেছি নেশার মারাত্মক প্রভাব
হিরুকে নিষেধ করতে হবে।

মুখ ঘুরিয়ে দেখা গেলো হিরু পাগলের মতো ছুটছে। একটা দোতলা বাসে চেপে পড়লো হিরু।  তারপর ওর দেখা আর কোনোদিন পাইনি। নাটক শুরুতেই শেষের বাজনা বাজিয়ে অনিতা মহাসুখে ঘর করছে বিদেশে।
জয় ভাবছে, আর নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে চলেছে।
পরে শুনেছিলো জয় চিরকালের মতো হিরু তাদের  ছেড়ে চলে গেছে অচিন দেশে। সেই থেকে জয় মেয়েদের একটু এড়িয়ে চলতো ভয়ে। ভালোবাসার ভয়ে…।

আবার জয়, যার পাল্লায় পরেছে তার কবে যে পরিবর্তন হবে কে জানে।  মনে মনে ভাবে অসীমের কথা, জানিস শতকরা আশি ভাগ মানুষ ভালো। তা না হলে পৃথিবী অচল হয়ে পড়বে। সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে।  আশি শতাংশ মানুষ সৎ মানুষ।

লতিকা বাজারে গেছে দুঘন্টা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মেয়ে রুমা চলে এসেছে। মেয়ে  বলছে, বাবা, আমি আজ স্কুলে যাবো না।
— ঠিক আছে, তোর মা আসুক বলবি।
—- তুমি একটু বলে দিও
—-বেশ বলে দেবো।

সংসারে কে যে কখন কোন রোলে অভিনয় শুরু করে দেয় বোঝা মুস্কিল।  লতিকা সব ব্যাপারে স্বাধীন। তবু সবাইকে বলে বেড়ায়, জয় স্বামী হয়েও তাকে  সন্দেহ করে।

জয় সব জানে, শোনে। কিন্তু ঝগড়া এড়িয়ে যায়। সংসারে যার সাথে সব সময় থাকতে হবে তার সাথে ঝগড়া করতে ভালো লাগতো না। তারপর মেয়ে বড়ো হয়েছে।

জয়ের মনে পড়ছে, তখন বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয়নি। লতিকা বাপের বাড়িতে গেছে।
জয় দেখা করতে গিয়ে দেখে, লতিকা ঘরে কার  সঙ্গে কথা বলছে। অন্ধকার ঘর। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি অন্য ঘরে। জয় আর শ্বশুর বাড়িতে ঢোকে নি। লোকজন ডেকে এনে দেখে, দুজনে বিছানায় শুয়ে গল্প করছে। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে কিন্তু লতিকার স্বভাবের পরিবর্তন হয় নি। পরপুরুষের সঙ্গে বিছানায় গল্প করার অনুমোদন সেদিন গ্রামের লোকে দেয়নি। তার বেশি অসভ্য কথা ভাবতে জয়ের রুচিতে বাধে।

লতিকা এখনও মেয়েকে বাড়িতে রেখে প্রতিবেশিদের বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে। পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তার বেশি ভালোলাগে। জয় বাধা দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু ও কাজে ব্যস্ত থাকে।  বেশি কিছু বলতে পারে না।

মেয়ে বড়ো হয়েছে। এবার তারও শখ আছে, আহ্লাদ আছে। মেয়ে বলে, বাবা আমি কার্তিক লড়াই দেখতে কাটোয়া যাবো। জয় বলেছিলো, নিশ্চয় যাবে। কার্তিক লড়াই দেখতে মেয়েটা কাটোয়া মামার বাড়ি চলে গেলো।

জয় বলছে, মেয়েটা নেই বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। লতিকা বলে, বড়ো হয়েছে। পঁচিশ বছরের হলো। এবার বিয়ে দিয়ে দাও।
জয় বললো, তোমার তো অনেক জানা শোনা। সবাইকে বলে দেখতে পারো।

জয়ের মেয়ে রুমা বাবার মতো হয়েছে। সে সাদা সিধা। কোনোরকম চালাকি তার মধ্যে নেই। কার্তিক লড়াই দেখতে গিয়ে অনির সঙ্গে তার প্রেম হয়েছে। অনিকে তার খুব ভালো লেগেছে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়। রুমা বাড়ি এসেই বাবাকে বলছে, বাবা কাটোয়ার অনি বলে একটি ছেলেকে আমার ভালো লেগেছে। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।
—- ঠিক আছে তোর মাকে বলবো।

জয় রাজি। ছেলে স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু লতিকা বলছে, আমি যেখানে ছেলে দেখেছি তাদের বড়ো ব্যাবসা। অল্টো গাড়ি আছে। ওখানেই বিয়ে হবে। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসেছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে মেয়ের বিয়ে নিয়ে অশান্তি হচ্ছে জয়ের বাড়িতে।

জয় বললো, খুব স্পর্শকাতর ব্যাপার, একটু সাবধানে ম্যানেজ করবে, যদি কিছু করে বসে।
লতিকা বললো, যা করে করবে। আমি ওই ছেলের সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করবো।

যে ছেলেটিকে রুমা ভালোবাসে সে একটা বেসরকারি ফার্মের মালিক। তার নাম হারু। অপরের বিপদে আপদে এক ডাকে সকলে হারুর হেল্প পেয়ে থাকে। বন্ধুরা সকলেই হারুর বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। অনির বন্ধুর লিষ্টে পুলিশ অফিসার থেকে আরম্ভ করে অল্টো গাড়ির মালিক লতিকার পছন্দ করা জামাই অবধি আছে। অনি এখনও রুমার মায়ের অপছন্দের কথা জানে না। সমাজসেবার জন্য অনেক বড়ো বড়ো পুরস্কার অনি পেয়েছে। পুরস্কারের টাকাও সমাজসেবার কাজে লাগায়। কত বেকার ছেলে তার দয়ায় কাজ করে খায় তার হিসাব রাখে না অনি। মায়ের হারাধন ওরফে অনি রত্নধন হয়ে সমাজের ভালো কাজ করে।

রুমার মন খুব খারাপ। সাত আটদিন অনির সাথে দেখা হয় নি। কিছুতেই মা রাজী হচ্ছে না। সে ভাবছে, বেঁচে থেকে লাভ নেই। কিন্তু বাবা আছে। তাকে কেন দুঃখ দেবো, এই কথা ভেবে সবকিছু ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলো নিজের  ভবিষ্যৎ ।

এদিকে অনি ভাবছে, রুমা কেন দেখা করছে না। মোবাইলে অন্য কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। বিয়ের দিন ঠিক হবে তাই। লাজুক হয় ভদ্র স্বভাবের মেয়েরা।

বন্ধুরা বলছে, হয়, হয় এরকম হয়। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ ওরা খবর পেলো অল্টো গাড়ির মালিকটি রোড অ্যাক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে  অনি বন্ধু বান্ধব ডেকে চলে গেলো স্পটে। এখন রাত সাতটা বাজে। মহুকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সে যাত্রা বেঁচে গেলো সে।

রুমার মা লতিকা এসেছে রুমাকে সঙ্গে করে, আহতকে দেখতে। তারা ফলমূল নিয়ে এসেছে। মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই দেখে অনি তার বন্ধুদের নিয়ে বসে আছে। পুলিশ এসেছে। লতিকা শুনছে, পুলিশ জিজ্ঞাসা করছে, গাড়ির মালিক কে?  শুয়ে শুয়ে আহত ছেলেটি বলছে, অনি সরকার। পুলিশ বলছে, তিনি কোথায়?

অনি হাত তুলে বললো,এই যে স্যার আমি।
পুলিশটি বললেন, ও আপনি। সমাজসেবক নামেই আপনাকে চিনি। নমস্কার নেবেন। আজকে আপনার নাম জেনে খুশি হলাম। নো প্রবলেম।
—-কি যে বলেন। মানুষ হয়ে মানুষের একটু সেবা করার চেষ্টা করি বন্ধুদের নিয়ে। এরাই আমার সব।
পুলিশ তাদের কাজ করে চলে গেলো।

লতিকা সব শুনেছে। অনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তোমার মা রত্নগর্ভা। তোমার জন্যই অনেকে প্রাণ ফিরে পায়। রুমা দেখলো ওর মায়ের চোখটা জলে চিক চিক করছে। তারপর লতিকা ফলমূল অনির হাতে দিয়ে বললো,বাবা তোমার মা বাবাকে ব’লো আমরা দেখা করবো। অনি ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। রুমার হাল্কা হাসিতে অনি নিশ্চিন্ত হলো।

সারা রাস্তা লতিকা মেয়ের সাথে কথা বলতে পারেনি লজ্জায়। বাড়িতে আসার পথে পরশমণির স্পর্শে রঙ পালটানোর খেলা দেখছিলো শরতের আকাশে, লতিকা। আলোর লিপি আজ থেকে তার আকাশে রঙের আলপনা, সত্য, সুন্দরের ছবি এঁকে দিলো।

ঘরে ঢুকেই লতিকা এই প্রথম স্বামীকে একটা প্রণাম করে ফেললো প্রসন্নমনে…

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × three =