এ জীবন লইয়া কি করিব?

রবীন বসু, কসবা, কলকাতা

##

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

     নিয়ে গেছে তারে ;

     কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

     যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

     মরিবার হ’লো তার সাধ ;

                                —জীবনানন্দ দাশ

আত্ম হননের এই সাধ সম্প্রতি আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।  সকালে সংবাদপত্রে পাতা ওলটালে বা টিভিতে নিউজ চ্যানেল খুললে দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন কোথাও না কোথা কেউ না কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে । আজ শিলিগুড়িতে এক শিক্ষিকা কুপ্রস্তাবে অতিষ্ট হয়ে আত্মহত্যা করেন তো গতকাল রাতে বেহালার এক ভদ্রমহিলা সন্তানসহ মেট্রোর সামনে ঝাঁপ দিলেন, মা মারা গেল, শিশু সন্তান হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে l আজ আবার গিরিশপার্ক স্টেশনে এক যুবক মেট্রোতে ঝাঁপ দিলেন । একদিন আগে সল্টলেকে  বেসরকারি হাসপাতালের উঁচু বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে এক ক্যানসারগ্রস্ত বৃদ্ধ আত্মহত্যা করলেন। তার এক দিন আগে যাদবপুরে আর এক অসহায় বৃদ্ধা প্রকাশ্য দিবালোকে পার্কের মধ্যে গায়ে আগুন দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিলেন। আর এই আত্মহনন শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতবর্ষ নয়—সমস্ত পৃথিবীর বাস্তব সত্য ।

২০১২ সালের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে দেশের মোট জনসংখ্যার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৪৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে । অর্থাৎ গড়ে দৈনিক ৩৭১টি আত্মহননের ঘটনা ঘটছে । এদের মধ্যে ২৪২ জন পুরুষ, ১২৯ জন মহিলা । প্রতি ১ লাখে গড়ে ১২ জন । কী ভয়ানক ব্যাপার ।

ভারতে আত্মহত্যার মত চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ু, বছরে প্রায় ১৭ হাজার। দ্বিতীয় মহারাষ্ট্র, ১৬ হাজার। তৃতীয় পশ্চিমবঙ্গ, ১৫ হাজার। পন্থা হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে গলায় দড়ি ৩৩ %, বিষ খাওয়া ২৯%, গায়ে আগুন ৮.৫ %, এছাড়া আছে হাতের শিরা কাটা বা ট্রেন লাইনে ঝাঁপ ।

কিন্তু কেন? কেন এই নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, নিজেকে শেষ করার প্রবণতা? এর মূল গভীরে, শিকড় ছড়িয়ে আছে বহুধা প্রান্তে।  মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রধান কারণ আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক হিংসা, দাম্পত্য কলহ, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, নিঃসঙ্গতা, মাদকাসক্ততা, দুরারোগ্য রোগে অসুস্থতা আর প্রেমে ব্যর্থতার মত আবেগজনিত কারণে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন। ইদানীং কৃষিতে ফসল না হওয়া বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সরলমনা কৃষকরা কৃষিঋণ পরিশোধ করতে না পারায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এটা দিন দিন ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।

সাধারণত আমরা ভাবি মেয়েরাই বেশি আবেগপ্রবণ, কিন্তু না আগুপিছু ভাবনা, সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মহিলারা অনেক সময় চরম সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে। তাই আত্মহত্যায় পুরুষরাই এগিয়ে ৭২ %, সেখানে মেয়েরা ৬৮ %।

সমাজ পরিমণ্ডল, তার উদাসীনতা, অনুশাসন থেকে ব্যক্তির নিজস্ব বোধ, তার অসহায়তা আর অদ্ভুত মনোলোক, এ সব কিছুই জড়িয়ে আছে আত্মহত্যার পরতে পরতে। ফ্রয়েডিয় মনোবিজ্ঞান বলে, ব্যক্তি যখন পরিবেশ ও পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে খুব নিরালম্ব ও অসহায় ভাবে, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হয়, তখন সেই অবসাদ আর একাকিত্ব থেকে ব্যক্তির মনে জন্ম নেয় এক ধরণের অভিমান, যা তাকে আত্নহত্যায় প্ররোচিত করে। আর এ ব্যাপারে গরীব-বড়লোক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সেলিব্রিটি বা অখ্যাত সবই সমান। অখ্যাতজনদের কথা না হয় ছেড়েই দি, কিন্তু বিখ্যাতদের মধ্যে দেখুন, বিশ্ব কাঁপানো এডলফ্ হিটলার, চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, হলিউড কাঁপানো সুন্দরী অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো, সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো—এঁরা সবাই কোন না কোন সময়ে মানসিক অবসাদ আর নিঃসঙ্গতার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। আমাদের দেশেও এর নজির আছে। বিখ্যাত জুটি গুরু দত্ত-গীতা দত্ত,  ঠাকুরবাড়ির ফেমাস বৌঠান কাদম্বরী দেবী, গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মোটের উপর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্খার হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। ইদানিং বোধহয় সংখ্যাটা বাড়ছে ক্রমাগত। এটা চিন্তার বিষয়। সময় দ্রুত গড়াচ্ছে, মানুষ আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক হচ্ছে, তারই সাথে সে হারাচ্ছে তার আবেগ আর বিবেক।  শামুকের মত নিজের খোলশে যত সে নিজেকে ঢাকছে ততই বেশি করে সে একা হয়ে পড়ছে। গতিশীল আর স্বার্থপর এই সময়ের থেকে যখন সে পিছিয়ে পড়ছে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত নিজের অবসাদ নিয়ে ভাসতে ভাসতে এক সময় তরঙ্গের আঘাতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পরাজিত মানুষ নিজের থেকে মুক্তি খোঁজে, তাই আত্মবিনাশের এই সিদ্ধান্ত।

ভোগবাদী জীবন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে লোভে। আর সেই লোভ মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে সীমাহীন অসম এক প্রতিযোগিতার দিকে। আর যেহেতু প্রতিযোগিতা তাই আসছে শঠতা, বিবেকহীনতা, হিংসা। যেন তেন প্রকারে জয়লাভ—তাকে আরও এক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই পরাজয়কে সে স্বাভাবিক বলে মানতে নারাজ। মনোক্ষুন্নতা, অবসাদ থেকে তখন সে চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে, এ জীবন রাখিয়া কি করিব?

আমরা জটিল থেকে আরও জটিল এক সময়ের গর্ভে ঢুকে যাচ্ছি, ব্যক্তিমানুষ ক্রমশ তার পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, এমন কি নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কিংবা বলা যায় স্ব-ইচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এক না-বোঝানো অভিমান থেকে। আর এই অচেনা অভিমান থেকে তাকে বের করে আনতে হবে, তবেই ব্যক্তির মুক্তি।

কিন্তু কি ভাবে? কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, “কোথাও অন্য কোন প্রীতি নেই”—এখন এই অন্য প্রীতির খোঁজ করতে হবে l যন্ত্রণাক্লিষ্ট আহত জর্জরিত মানবাত্মাকে শান্ত সুবাতাস দিতে হবে l বাড়াতে হবে সম্পর্কের হাত, বন্ধুত্বের হাত, বিশ্বাস ও আস্থার হাত l দূরত্ব নয় নৈকট্যই আজ প্রয়োজন l

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন তুলে বলি :

মানুষ বড় কাঁদছে,

         তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও…

————

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 4 =