রাজকন্যে শান্তা
অচেনা অথচ গুরুত্বপূর্ণ, পুরাণে রয়েছে এমন অসংখ্য নারী চরিত্র। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখা থাকছে অবেক্ষণ-এ। শারদ সংখ্যায় প্রথম পর্বে থাকছে রাজকুমারী শান্তার কাহিনী। লিখছেন ময়ুমী সেনগুপ্ত।
রাজকুমারী শান্তা — রামায়ণের এক উপেক্ষিতা চরিত্র। অথচ এই রাজকুমারী না থাকলে হয়তো রাম অবতারের জন্মই হতো না। কারণ রাজকুমারী শান্তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির দ্বারাই হয়েছিল দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ।
রাজকুমারী শান্তার নাম প্রায় শোনাই যায় না। এমনকি এই নারীর পিতৃপরিচয় সম্পর্কেও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন রাজা দশরথের তিন পুত্র জন্মানোর আগে এক কন্যে হয়েছিল। সেই মেয়েই শান্তা। পরমাসুন্দরী সেই কন্যে রাজা দশরথের প্রথম জীবনের সন্তান। এই পরমাসুন্দরী কন্যার বিবাহ হয়েছিল মহামুনি ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে।
আবার কেউ কেউ বলে থাকেন যে এই রাজকুমারী রাজা দশরথের নয় তাঁর পরম মিত্র লোমপাদ রাজার কন্যে। এই কন্যাকে রাজা দশরথ আপন কন্যার ন্যায় স্নেহ করতেন। তাই লোমপাদ রাজার জামাতা মানে একরকম তাঁর নিজের জামাতা। তাই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে তিনি অনুরোধ করলে মুনি সম্মত হন অতি সহজেই।
আশ্চর্য ভাবে মহর্ষি বাল্মীকি রাজকন্যে শান্তা সম্পর্কে একেবারেই নীরব। আদিকাব্য ব্যতীত আর বড় একটা রাজকুমারী শান্তার কথা শোনা যায় না। আর তিনি অযোধ্যার রাজকন্যে হলেও কোন রানীর গর্ভে তাঁর জন্ম সে বিষয়েও কিছু জানা যায় না। কারণ মহারাজ দশরথের তিন রানী ছিল — কৌশল্যা , কৈকেয়ী এবং সুমিত্রা। এ ছাড়া তাঁর অপর কোনো রানীর কথা শোনা যায় না। তাই ঔরস দশরথের হলেও শান্তার জননী কে সে বিষয়ে কোনো তথ্য সেভাবে পাওয়া যায় না।
রামচন্দ্রের জীবনেও বড় দিদি শান্তার কোনো প্রভাব নেই। দুই ভাই বোনের সম্পর্কের কোনো মিষ্টি দিক-ও মহাকবি উল্লেখ করবারও প্রয়োজন বোধ করেনি। আরো আর একটি প্রশ্ন। শান্তার সঙ্গে কোনো ঋষির বিয়ে কেন ? যদিও তখন এ দৃষ্টান্ত দেখা যেত। তবুও পুণ্য অর্জনের নামে এ কি রাজকুমারীর প্রতি অবিচার নয়! আজন্ম রাজসুখে লালিত পালিত এক কন্যে কি ভাবে তপোবনের জীবনে মানিয়ে নিতে পারবেন! সে কথা ভেবে দেখবার প্রয়োজনীয়তা কি শান্তার মা-বাবা (তাঁরা যেই হন না কেন ) অনুভব করেনি ? এখানে রাজকন্যে সুকন্যার কথাও মনে পড়ে, যিনি বিয়ের পর সনাতন ভারতীয় নারীর সংস্কারে মহর্ষি চ্যবনকে ভালোবাসলেও মূলত নিজের পরিবার তথা রাজ্যকে বাঁচাতে এক বৃদ্ধ মুনিকে বিবাহ করেন।
রাজা দশরথের চার পুত্রের থেকে রাজকুমারী শান্তা বয়সেও বড়। অন্তত আট বছরের ব্যবধান। কারণ সে কালে তো অষ্টম বর্ষে ভবেদ গৌরী দানের প্রথা ছিলই। যদিও রাজকন্যেরদের কখনও একটু বেশি বয়সেও বিবাহ হতো।কাজেই রামচন্দ্রের জন্মের আগেই শান্তার বিবাহ সম্পন্ন। কে জানে একমাত্র কন্যার বিবাহ হয়ে যাওয়াতে রাজা দশরথ হয়তো বংশরক্ষার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। তাই ঋষ্যশৃঙ্গকে দিয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করেন। সরযূ নদীর তীরে সেই পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আহুতি দিতেই আবির্ভূত হন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। হাতে তাঁর পায়সের পাত্র। প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজে সেই পায়স রান্না করে পাঠিয়েছেন। আর তারপর ? এহ বাহ্য। আগে কহ আর।
তবে রাজকুমারী শান্তার মতো উপেক্ষিত চরিত্র রামায়ণে বড় কম নেই। রাজকন্যে হয়েও মহাকাব্যে ঠাঁই মেলেনি তাঁর। তিনি শুধুই কার্য প্রস্তুতের মাধ্যম যাকে বলে নিমিত্ত মাত্র।