শান্তির ঠিকানা
পলাশ মুখোপাধ্যায়
কারও জন্য কিছু করতে চাইলে অর্থের চাইতেও বোধহয় মনটাই বেশি করে থাকা দরকার। বেলমুড়ির বিশ্বাস দম্পতিকে দেখে এই বিশ্বাসটাই আরও জোরদার হয়। বিশ্বজিৎ বিশ্বাস এবং পূর্ণিমা বিশ্বাস, পেশায় দুজনেই ট্রেনের হকার। ইমিটেশনের গয়না বেচেন রেল কামরায়। এক সঙ্গে নয়, আলাদা আলাদা। পূর্ণিমা যখন হাওড়া বর্ধমান মেইন লাইনে, তখন বিশ্বজিতের কর্মক্ষেত্র কর্ড লাইনের রেল কামরা। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিক্রিবাটার পর ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরেন ওরা। বাড়িতে অপেক্ষায় থাকে ২১ টি কচি মুখ। অবাক হলেন বুঝি? ২১ টি সন্তানের বাবা মা! সকলকে জন্ম না দিলেও ওরা এখন ওদের বাবা মা-ই। তাই তো ওরা যখন ফিরে আসেন তখন ওই বাড়িটাই হয়ে ওঠে শান্তির ঠিকানা। শান্তিধাম।
বিশ্বজিতের জন্ম বাংলাদেশের যশোরে। কৈশোরে চলে আসেন নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জে। সেখান থেকে পরে হুগলির বেলমুড়ি। শুরু করেন ইমিটেশনের গয়না বিক্রির কাজ। রেলের কামরা, নানা অফিস ঘুরে ঘুরে গয়না বিক্রি করতেন। করতে করতেই আলাপ হয় পূর্ণিমার সঙ্গে। কলকাতার মেয়ে পূর্ণিমাও নিজে কিছু একটা করবার চেষ্টা করছিলেন তখন। ২০০২ সালে দুজনের আলাপের পর কেটে যায় কয়েকটা বছর। নানা মতের মিল থাকাতে দুজনের মনের মিল হতেও সময় লাগে নি। ২০০৮ সালে বেলমুড়ি স্টেশনের কাছে মাকালপুরে ১৬ কাটা জায়গা কেনেন দুজনে মিলে। ছোট্ট ঘর বাঁধেন দুজনে। কিন্তু গ্রামের কিছু মানুষ ব্যাপারটা ভাল চোখে নেননি। পূর্ণিমাকে বিয়ে করেন বিশ্বজিৎ।
অন্য কিছু করবার ভাবনাটা ছিলই দুজনের ভিতরে, তারই তাগিদে দুটি দুঃস্থ শিশুকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসে তাদের ভরনে পোষণের দায়িত্ব নেন ওরা। সালটা ২০০৯। সেই শুরু, তার পর ক্রমশ বাড়তে থাকে তাদের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা। বাড়তে বাড়তে যা এখন ২১ জনে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন মেয়ে এবং বাকি ষোল জন ছেলে। শুধু থাকা খাওয়া নয়, তাদের লেখাপড়া, গান বাজনা, ছবি আঁকা সব কিছুই শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন বিশ্বাস দম্পতি। ছোট্ট এই আশ্রমের নাম দিয়েছেন শান্তিধাম। ছোটদের নিয়ে একটা যাত্রা বা পালাগানের দলও করেছেন। নানা জায়গাতে সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠান করেছে সেই দল।
বিশ্বজিতের আগের একজন স্ত্রী আছেন, আছে সেই পক্ষের একটি মেয়েও। সেও কিন্তু এখন শান্তিধামেই থাকে। থাকে বিশ্বজিৎ এবং পূর্ণিমার মেয়েও। শুধু এই শিশুরাই নয়, থাকেন এক বৃদ্ধও। ছেলে মেয়েদের সময় নেই, বাবাকে তারা রেখে গিয়েছিল এখানে। কয়েক মাস পর আর কারও খোঁজ নেই। বিশ্বজিৎ পুর্নিমার কাছে রয়ে গিয়েছেন তিনিও। আশ্রম চালাতে গেলে দরকার অর্থের, দুজনে অমানুষিক পরিশ্রম করেন। আশ্রমের জন্য অর্থের যোগাড়ে কীর্তন গান করেন দুজনেই। এখন কিছুটা প্রচার হওয়াতে মাঝে সাঝে আশ্রমে আসেন কেউ কেউ। জন্মদিন বা অন্যান্য অনুষ্ঠান করেন এখানে। ছেলেমেয়েদেরও কিছু সাহায্য করা হয়। তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনাই সামান্যই।
অর্থ সেভাবে নেই, কিন্তু কিছু করবার ইচ্ছেটা আছে। সামর্থ হয় তো নেই, কিন্তু মূল্যবোধ আছে, আছে সম্মান। তাই কারও কাছেই সেভাবে সাহায্য চান না, নিজেরা যতটুকু পারেন করবার চেষ্টা করেন। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন আশ্রমের পরিবেশ – পরিকাঠামো। এখানেও এসেছে নানা বাধা বিপত্তি। অসম্মান অসন্তোষের কাছে মাথা নোয়াননি দুজনেই। তাদের দৃঢ়তা, সংকল্প থেকেই জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছে আবাসিক শিশু কিশোরের দলও। শত অসুবিধা, হাজার প্রতিবন্ধকতা, লক্ষ নেই এর পরেও তাই শান্তিধাম জুড়ে শুধু থাকে শুধুই শান্তির আবহ।