গুপ্তিপাড়ার গুপ্ত কথা

পলাশ মুখোপাধ্যায়

 

ছোট্ট জনপদ, অথচ তার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের ছোঁয়া। আমার এবারের সফরে তাই খাওয়ার পাশাপাশি যাওয়াতেও বেশ জোর। কলকাতা থেকে খুব বেশি দূর নয়, ট্রেন বা সড়ক যোগাযোগও বেশ ভালই। কলকাতা থেকে যে পথেই যান কমবেশি ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেই পড়বে গুপ্তিপাড়া। হুগলি জেলার প্রাচীন এই জনপদটি আসলে হুগলি বর্ধমান এবং নদিয়া সীমানা ঘেঁষা। গুপ্তিপাড়ায় যাওয়া যায় বিভিন্ন ভাবে। মূলত ব্যাণ্ডেল হয়ে আসা যায়, তাই শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে ব্যান্ডেলে এসে কাটোয়ার দিকে যাওয়ার ট্রেন ধরতে হয়। সরাসরি গুপ্তিপাড়া যাওয়ার জন্য মেলে কাটোয়া লোকাল। আমি অবশ্য শিয়ালদহ থেকেই শান্তিপুর লোকালে শান্তিপুর নেমে তারপরে নদী পার হয়ে গুপ্তিপাড়ায় এসেছি। আমার সফরে এবারেও তাই সঙ্গী সাংবাদিক মহাদেব কুণ্ডু। মহাদেব থাকাতে সুবিধাই হয়েছে, বাইকে চড়েই দিব্যি নৌকায় গঙ্গা পার করে সহজেই চলে আসতে পেরেছি গুপ্তিপাড়ায়।

একসময় সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান চর্চা ও তন্ত্র সাধনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল গুপ্তিপাড়া। অবিভক্ত বঙ্গের বিভিন্ন এলাকা হয়ে উঠেছিল সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চার অন্যতম পীঠস্থান। হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়াতেও অসংখ্য টোল বা সংস্কৃত চতুষ্পাঠী স্থাপিত হয় এবং উন্নততর জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র রূপে খ্যাতি লাভ করে। এখনও বেশ কিছু টোল বা সংস্কৃত চতুষ্পাঠী, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চার জন্য বিখ্যাত। তালপাতায় লেখা বহু প্রাচীন পুঁথি এই অঞ্চলের “শিশির বাণী মন্দির” নামক সরকারী পাঠাগারে ও কিছু পুঁথি ব্যক্তিগত সংগ্রহে, সযত্নে রক্ষিত।

গোটা গুপ্তিপাড়া গ্রাম জুড়েই প্রাচীন বহু দেবদেবীর থান, মন্দির প্রভৃতি বর্তমান। প্রাচীন এইসব দেবদেবীর সন্মিলিত সহাবস্থান ও ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আবহ রচনার জন্য এই অঞ্চলকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ও বলা হয়। গুপ্তিপাড়ার নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত প্রচলিত থাকলেও ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ থেকেই ‘গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী’, ‘গুপ্তপল্লী’ ও পরিশেষে ‘গুপ্তিপাড়া’ নামকরণ হয়েছে এই মতটাই প্রতিষ্ঠিত। আমাদের প্রথম গন্তব্য গুপ্তিপাড়া মঠ। এই অঞ্চল প্রধানত চৈতন্যদেব, কৃষ্ণচন্দ্র, বৃন্দাবনচন্দ্র এবং রামচন্দ্রের নামে উৎস্বর্গীকৃত ৪ টি ইটের তৈরি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। এই চারটি মন্দির একই প্রাঙ্গণের মধ্যে অবস্থিত ও এই মন্দিরগুলির সমষ্টিকে বলা হয় ‘গুপ্তিপাড়ার মঠ’। বাংলার নিজস্ব মন্দির স্থাপত্যের ছাঁদে অর্থাৎ চালাঘরের আদর্শে নির্মাণ, এই মন্দিরগুলির বিশেষত্ব।

 

চারটি মন্দিরের মধ্যে চৈতন্যদেবের মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন; ‘জোড় বাংলা’ রীতিতে আনুমানিক সপ্তদশ দশকের মধ্য ভাগে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। ‘জোড় বাংলা’ রীতি অর্থাৎ অপূর্ব কারুকার্য খচিত চৈতন্যদেবের এই মন্দিরের স্থাপত্য বা নির্মাণ শৈলী দেখলে মনে হয় যেন দুটি দোচালা কুটির পরস্পর সংলগ্ন অবস্থায় রয়েছে। চৈতন্যদেবের এই মন্দিরে বাংলার অপূর্ব ‘টেরাকোটা’ স্থাপত্যের প্রথম দিকের নিদর্শন ছিল বলেই অনুমান করা হয়। ‘টেরাকোটা’র এইসকল অপূর্ব নিদর্শনগুলি কালের গহ্বরে সবই প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে বর্তমানে,এই মন্দিরের অধিকাংশ কারুকার্যই পলেস্তরায় ঢাকা। রাখা আছে রথ ও রাসের সময়কার পুতুল।

নবাব আলিবর্দি খাঁ-র শাসনকালে (রাজত্বকাল ১৭৪০ – ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ) ও নবমদন্ডী পীতাম্বরানন্দের মঠাধিকার কালে (আনুমানিক ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দে) শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়; যদিও কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দিরটি ১০ বছর পর অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে (আনুমানিক ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে) স্থাপিত হয়।

মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে পরিব্রাজক ও সন্ন্যাসী সত্যদেব সরস্বতী বা প্রথম দন্ডিস্বামী ছিলেন জগৎগুরু শঙ্করাচার্য্যের অন্যতম শিষ্য। সত্যদেব সরস্বতী স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে নদীয়া জেলার শান্তিপুরের এক বিধবার  কুটীর থেকে শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের অর্থাৎ ‘বিষ্ণু’দেবের বিগ্রহ সংগ্রহ করেন। সত্যদেব সরস্বতী’র প্রধান ভক্তশিষ্য জমিদার বিশ্বেশ্বর রায় শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রকে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করলে, সত্যদেব গুপ্তিপাড়াকে তাঁর সাধনা স্থল রূপে নির্বাচন করেন ও বিশ্বেশ্বর রায়ের দান করা জমিতে ‘মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন ও বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটি (আনুমানিক ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে) নির্মিত হয়। বর্তমান বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটি বাগবাজারের জমিদার গঙ্গানারায়ণ সরকার কর্তৃক উনবিংশ শতকের প্রারম্ভে (আনুমানিক ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে) শাস্ত্র মতানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটির উচ্চতা ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট।

উঁচু বেদীর উপর কৃষ্ণচন্দ্র ও বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির দুটি প্রতিষ্ঠিত ও বাংলার ‘আটচালা’ রীতিতে নির্মিত। কৃষ্ণচন্দ্র, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের অনন্য বৈশিষ্ট্য–এই মন্দির দুটির উপরের তলে অন্য একটি ‘চারচালা’ মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে ৩ টি প্রবেশ পথ যুক্ত একটি বারান্দা। ৩ টি প্রবেশ পথেই ‘খিলান’ বা ‘আর্চ’ বর্তমান। খিলানগুলি কারুকার্য খচিত। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা সাত দিন মাসির বাড়ি থাকার পর উল্টোরথের প্রাক্কালে অর্থাৎ বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে ফেরার ঠিক আগের দিন মাসীর বাড়িতে ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব খুব ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতর ও বারান্দার পশ্চাৎ অংশ  অলংকরণে সমৃদ্ধ। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের গায়ের নকশা জীর্ণ, এই মন্দিরগুলি বর্তমানে ভারতের ‘পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’এর নজরদারির আওতাধীন।

                                        

এই চারটি মন্দিরের মধ্যে রামচন্দ্রের মন্দির শিল্প-সুষমা সমৃদ্ধ কারুকার্য্যের জন্য সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। প্রচলিত আছে যে, শেওড়াফুলির রাজা হরিশচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রামচন্দ্রের মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের গড়ন ও অঙ্গসৌষ্ঠব ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে বাঁশবেড়িয়ায় প্রতিষ্ঠিত বাসুদেবের মন্দিরের সমগোত্রীয়। রামচন্দ্রের মন্দির ‘চারচালা’ রীতিতে নির্মিত হলেও এই মন্দিরের ছাদের মধ্যে ভাগে আটকোণা মন্দিরের একটি আদল দেখা যায়। মন্দিরের দক্ষিণ ও পশ্চিম দেওয়াল পোড়ামাটির– রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী, কৃষ্ণলীলা, বানিজ্যের জন্য সমুদ্র যাত্রা প্রভৃতির দৃশ্যাবলী পোড়ামাটির অসাধারণ ভাস্কর্য্যে রূপায়িত হয়েছে। পোড়ামাটির তৈরি এই সব অপূর্ব ‘টেরাকোটা’ বা মৃৎফলকগুলি তৎকালীন বাংলায় শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শনের সাক্ষ্য বহন করে।

মঠ চত্বর থেকে বেরিয়েই নজরে পড়ল টিন দিয়ে ঘেরা ফানেলের মত একটি বস্তু। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এটাই গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত রথ। রোদ ঝোড় জলের থেকে বাঁচাতে টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বাংলার ঐতিহ্যশালী ও বড় রথগুলির মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ অন্যতম। শোনা যায় কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময়াকালে প্রতিষ্ঠিত ও ভারতবর্ষে কয়েকশো বছরের প্রাচীন রথগুলোর মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ ভারতবর্ষে চতুর্থ প্রাচীন রথ। ওড়িশার পুরী, শ্রীরামপুরের মাহেশ ও মেদিনীপুরের মহিষাদলের পর গুপ্তিপাড়ার রথ আনুমানিক ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দে শুরু হয়।

গুপ্তিপাড়ার রথ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘতম বা সর্বাপেক্ষা উচ্চতা বিশিষ্ট। ওড়িশার পুরীর মন্দিরের রথ গোটা  ভারতবর্ষে অন্যান্য রথের তুলনায় সর্বাধিক দূরত্ব অতিক্রম করে। দ্বিতীয় দীর্ঘতম দূরত্ব (প্রায় ২ কিলোমিটার) অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের গুপ্তিপাড়ার রথ। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির থেকে গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারে শ্রী গোপাল মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা করে রথ। এই রথের চারটি রশি বা দড়ি’র একটি পিছনে থাকে যা রথ এর ব্রেক এর কাজ করে।  একটি রশি কেবলমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। বাকি দুটি রশির সাহায্যে রথ টানা হয়। রথযাত্রা উপলক্ষে গুপ্তিপাড়ায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়, বসে বিরাট মেলা। টিনের ভিতরে ঢুকে কোনও মতে রথের কিয়দংশের ছবি পাওয়া গেল।

                               

প্রধানত বৈষ্ণব সংস্কৃতি দ্বারা গুপ্তিপাড়া প্রভাবিত হলেও গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য শুধু বৈষ্ণব সংস্কৃতি ও মন্দিরেই সীমাবদ্ধ নয়। তন্ত্র সাধনার অন্যতম সাধনপীঠ রূপে পাঁচশো বছরের প্রাচীন ‘দেশকালী মন্দির’ বা ‘দেশকালিকা মাতা’র পঞ্চমুণ্ডির আসন রয়েছে খানিকটা দূরেই। রথ দেখে এলাম দেশকালী মন্দির চত্বরে। কিন্তু দুপুর হয়ে যাওয়ায় মন্দির বন্ধ। বট গাছের ছাওয়ায় খানিক জিরিয়ে নিয়ে এবার এগোলাম মন্দিরেরই পিছনের দিকে।

                                     

দেশকালী মন্দিরের পাশ দিয়ে যে রাস্তা পিছনের দিকে গিয়েছে সেই পথ ধরে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই মিলবে বারোয়ারি সৃষ্টি স্থান। গুপ্তিপাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি স্থানীয় সেন রাজাদের বাড়ির দুর্গাপুজো বা মতান্তরে জগদ্ধাত্রী পুজোয় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও এদের মধ্যে ১২ জন একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন তৈরি করে ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দ (মতান্তরে ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দ) থেকে বাংলা দেশের মধ্যে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপূজো শুরু করেন। বারো জন বন্ধু বা ইয়ারের সংগঠন বলে ‘বারোয়ারি’ পুজো। এ প্রসঙ্গেই বলি অনেকের মতে কিন্তু ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে বলরাম বসু ঘাট রোডের ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র উদ্যোগে আয়োজিত পুজোই কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো। যাই হোক প্রথম বারোয়ারি পুজোস্থলের চত্বরে আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বেশ অন্য রকম অনুভুতি কিন্তু জাগছিল মনে। মহাদেবের ডাকে সম্বিৎ ফিরল।

                                   

আগেই শুনেছিলাম বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার আদি বাড়ী এই গুপ্তিপাড়াতেই, তাই খুব ইচ্ছে এই মহান কবিয়ালের জন্মভিটে দেখে আসব। কোন ভোলানাথ? মনে পড়ছে না? একটু স্মৃতি উসকে দিলেই মনে পড়বে। উত্তম কুমারের বিখ্যাত ছবি এন্টনি ফিরিঙ্গিতে ভোলা ময়রার সঙ্গে এন্টনির গানের লড়াই মনে পড়ছে কি?

‘আমি সে ভোলানাথ নইরে আমি সে ভোলানাথ নই,

আমি ময়রা ভোলা ভিঁয়াই খোলা

বাগবাজারে রই।’

এবারে নিশ্চয় মনে পড়েছে? একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল পুলিস ফাঁড়ির ঠিক সামনেই ভোলা ময়রার বাড়ি। আমরা সেই মত খুঁজে খুঁজে গিয়ে হাজির। ফাঁড়ির সামানে থাকা একটি বাড়িতে এক মহিলা সদস্যকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। ভোলা ময়রার নামই শোনেননি। খুব হপ্তাশ হলাম, তবে কি এখানে নয়? ওই মহিলাই বাড়ির এক বয়োজ্যেষ্ঠকে ডেকে নিয়ে এলেন। তার কাছ থেকেই জানা গেল ওইটিই ভোলা ময়রা বাড়ি। তার ছেলে, ছেলের বৌ সকলেই আছেন সেই বাড়িতে। তবে ছেলের বয়স যখন তিন বছর তখন মারা যান ভোলা। তাই তেমন স্মৃতি নেই তাদের মনে। তবুও একটা ব্যাপার ঠিক মেনে নিতে পারলাম না ওই পরিবারের এক সদস্য এমন একজন গুণি মানুষ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যে মহিলাকে আমরা প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিলাম পরে জানলাম ভোলা ময়রা সম্পর্কে তার খুড়শ্বশুর হন। বাড়িটির আশেপাশে কোথাও একটা স্মৃতি ফলকও নেই।

ঘোরাঘুরি তো অনেক হল, এবার খাওয়ার পালা। আমরা এসেছি গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত গুঁফো সন্দেশ খাব বলে। কোথায় মিলবে, জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সকলে এক বাক্যে দেখিয়ে দিলেন সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দোকানে ছিলেন বর্তমান প্রজন্মের দুই ভাই রাম নাগ এবং নিমাই নাগ। যেতেই আগে এগিয়ে দিলেন গুঁফো সন্দেশ, ‘আগে খান তার পরে কথা’। মুখে পুরলাম সন্দেশ, আহঃ মুখের ভিতর দিয়া একেবারে মরমে পশিল।

গুঁফোর আবিস্কর্তা বা বয়সের ঠিকঠাক হদিস দিতে পারলেন না নাগ পরিবারের বর্তমান সদস্যরা। তবে তাদের মতে কমপক্ষে ২০০ বছর তো হবেই। মূল উপাদান ছানা চিনি এবং খেজুর গুঁড়। বারো মাসই খেজুর গুঁড় না হলে কিন্তু গুঁফো সন্দেশ হবে না। তাই শীত কালে প্রচুর পরিমানে গুঁড় মজুত করে রাখেন ওরা। মাখা সন্দেশের থেকে গুঁফোর পাকও অনেকটা আলাদা। তাই করবার সময় বেশ মনোযোগ দিয়ে তা খেয়াল রাখতে হয়।

গুপ্তিপাড়ার গুপ্তি থেকে গুপো সন্দেশ, যা এখন লোক মুখে গুঁফো হয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়। গুঁফো সন্দেশকে এখানে জোড়া সন্দেশও বলা হয়। অন্যান্য দোকানেও মেলে এই সন্দেশ তবে সীতারামের নাম বেশি। দাম মোটামুটি ১০ থেকে ১২ টাকা প্রতিটি সন্দেশ। এই এলাকা আন্দাজে দামটা একটু বেশিই মনে হল। তবুও নিয়ে নিলাম বাড়ির জন্য কয়েকটা।

বিকেল হয়ে এসেছে এবার ফিরতে হয়, কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আরও বেশ কয়েকটা জায়গায়। শিশির বাণী মন্দিরে গিয়ে পুঁথি দেখার লোভ ছিল শুনলাম তা নাকি দুপুরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। শুনেছিলাম এখানেই বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম প্রধান সেনাপতি প্রখ্যাত মোহনলালের জন্মস্থান। এছাড়া রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু কালী মির্জা ওরফে কালীদাস মুখোপাধ্যায় গুপ্তিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।  সংস্কৃত ছাড়াও ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শিতা, ইসলাম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ও ইসলাম ধর্মাবিলম্বীদের মত পোষাকের কারনে তিনি ‘মির্জা’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। মোহনলালের একটি স্মৃতি স্তম্ভ নজরে পড়ল রথের সামনে, আর খুব বেশি কিছু জানা গেল না। এদিকে বিকেল হয়ে আসছে। ফিরতে হবে। চলে এলাম গঙ্গার ঘাটে। ফেরিতে করে পার হচ্ছি গঙ্গা, ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে এতক্ষণের ইতিহাস – সংস্কৃতি – সাহিত্য পটভূমি। আবার আসিব ফিরে, একটা সুর যেন গুনগুনিয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতরে, বুকের মাঝে।

পরিশেষে বলি – আমি ইতিহাসে অত্যন্ত কাঁচা। তাই যা কুড়িয়ে বাড়িয়ে পেয়েছি তাই জানানোর চেষ্টা করেছি মাত্র। কোথাও সংশোধনের সুযোগ থাকলে নিজগুণে তা করে নেবেন। মূল লক্ষ্য ছিল বেড়ানো তাই আমার মত ভ্রমণ পাগলের পড়াশোনায় খুব বেশি মন থাকে না। এখানে থাকার জায়গা সে ভাবে নেই। পাশেই কালনা বা গঙ্গার ওপারে শান্তিপুরে থাকার জায়গা আছে। সেখানে রাত্রিবাস করা যেতে পারে। খাওয়া দাওয়ার জন্য অবশ্য হোটেল পাবেন। দুপুরে কিন্তু প্রায় সব মন্দির বন্ধ থাকে। বিগ্রহ দর্শন করা যায় না।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − 7 =