ক্ষুদে গোয়েন্দা
রাণা চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান
বাবা মায়ের সাথে চার বছরের মেয়ে তিন্নি বেরিয়ে পড়লো বম্বে বেড়াতে ।এই সবে মহালয়া পেরিয়েছে । পুজোর সময় বেড়াতে যাবার ভিড় বাড়বে , সঙ্গে ছোট্ট তিন্নি আছে এটা ভেবেই একটু এগিয়ে বেরুনো । আগে থেকেই বুক করা হোটেল রুম ।ওদের তিন তলার জানালা থেকে নিচের রাস্তা টা খুব সুন্দর দেখা যায় । তিন্নির তো খুব পছন্দ ,ওখান থেকে নামতেই চায়না । বক্স চওড়া জানালার পাল্লা গুলো ভেতর থেকে ভেজিয়ে সে তো ঘর ঘর খেলতেই ব্যস্ত ।
“ওরে তিন্নি আয় মা আয় , একটু ফল গুলো খেয়ে যা “রমা হাঁক দিলে কি হবে, সেতো খেলতেই ব্যস্ত ,কিছুতেই নড়বে না । অগত্যা ওর নতুন ঘরে সব কিছু পৌঁছে দেওয়া । কিন্তু হঠাৎ যেনো কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো ! তিন্নি কাল রাতে খুব ভয় পেয়ে যাচ্ছিল ঘুমের ঘোরে ! “মা তো চিপে ওকে নিয়ে শুয়ে রইলো । হাসি খুশি মেয়েটা তো এমন কোনদিন করেনা !”কি হয়েছে মা ,এই তো আমরা ,ভয়ের কোনো স্বপ্ন দেখেছিস নাকি ? ” বলতেই হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে সে ! বাবা কে চিপ্পে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আবার ভোর বেলা কি যেনো বলছে মনে হতেই রমা তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলো ।”আরে ভয়ের কি আছে ,বাচ্ছা মেয়ে হয়তো স্বপ্ন দেখেছে কোনো ,দেখো উঠলে ঠিক হযে যাবে ” বলে ভরসা দেয় তিন্নির বাবা সুষ্মিত ।
সকাল প্রায় আটটা পর্যন্ত প্রায় ঘুমালো তিন্নি । কাল সেই বেলায় এসে ,যেখানে খেলার জন্য গোঁ ধরতো ,একদম সেদিকে গেলোই না আজ । জানালার পাল্লা বন্ধ দেখে ওর বাবা খুলতে যেতেই “না একদম খুলবে না বাবা ,ওটা পচা জানালা “বলে খাটের ওপর বসে রইল মুখ কালো করে ।
কি যে হলো আবার ,মেয়ের হটাত এমন পরিবর্তন দেখে রমা ,সুষ্মিত তো অবাক ! এর পর তিন্নি বায়না শুরু করলো ,”বাবা অন্য হোটেলে চলো ,এটা পচা ,এট্টুও ভালো নয় “।
বলে কি তিন্নি ! এই শহরে আর মাত্র দুটো রাত থেকেই ঔরঙ্গাবাদ হয়ে পুণে চলে যাবে ওরা ,এখন আবার অন্য রুম ! “আরে কি হলো তোর ,এমন বলছিস ?” রমা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলে ডুকরে কেঁদে ওঠে আদরের তিন্নি । দুজনেই জানে ,তাদের মেয়ে অযথা বায়না কোনদিন করে না ,তবে কিছু কি হলো নতুন জায়গায় !
একটু পরেই ড্রাইভার দরজায় টোকা দিতে বেরিয়ে পড়লো ওরা । এই রেডি হবার ফাঁকে ,তিন্নির দৃষ্টি এড়িয়ে ওরা দুজনই এক ফাঁকে জানালার পাল্লা খুলে ,তেমন কিছু দেখতেও পেলো না। ওরা আশঙ্কা করছিল হয়তো বাইরে ভয়ের কিছু দেখে ঘাবড়ে গেছে তিন্নি !
যাক বাইরে বেরিয়ে ঘন্টা খানেক ঘুরে ওরা হোটেলে ফিরতেই আবার তিন্নি কেমন যেনো চুপ আর মন মরা হয়ে রইল ।রমা আদর করে পাশে শুইয়ে গল্প বলতে বলতে ঘুম পাড়িয়ে দিলে , স্বামী স্ত্রী অবাক হয়ে উভয়ের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ঠিক কি হতে পারে ভাবতে লাগলো ! জাস্ট কিছুক্ষণ হয়েছে ,ওরাও একটূ গা এলিয়েছে । ঠিক সেই মুহূর্তে ,ধরফর করে কেঁদে বসে পড়ে তিন্নি । “না ওকে ওভাবে মেরো না ,মরে যাবে “বলে ঘুমের মধ্যে একদম আঁতকে ওঠে ।
আবার পাশ ফিরে তিন্নি ঘুমিয়ে পড়তেই নেট অন করে সুষ্মিত।রমার অনুরোধ আর মেয়ের আবদার এই তল্লাটে হোটেল রুম খুঁজতেই একটা রুম পেয়ে গেলো । আজই শিফট করার পরিকল্পনা নিয়ে রুম ছেড়েও দিলো মেয়ের কথা ভেবে । আবার এক বিভ্রাট ! নতুন হোটেলে লাগেজ নিয়ে যাবার সময় ,মাথায় ফেটি বাঁধা এক যুবক কে দেখেই তিন্নি একদম গুটিয়ে যায়৷ অথচ একটু আগেই কত্ত হাসি খুশি হয়ে হাঁটছিল মায়ের হাত ধরে ।সুষ্মিত ইশারায় রমা কে এখুনি কিছু না জিজ্ঞেস করে চুপ থাকতে বললো । আগে নতুন রুমে ওর মন ভালো হওয়া দরকার তবে না শান্তিতে ঘুরবে ওরা ।
পর দিন সকালে পুলিশের গাড়ির সাইরেনে ঘুম ভাঙলো ওদের ।উঁকি মেরে দেখলো পুলিশে ছয়লাপ চারিদিক ।ততক্ষনে রুম বয় এসে জানিয়ে দিয়ে গেলো ,”পুলিশের চেকিং চলছে ,কেউ হোটেল ছাড়বেন না এখন “।রমা ততক্ষণে টিভি চালিয়ে বুঝতে পারলো ,এই হোটেল প্যারাডাইস এর দু’তলার এক রুম থেকে ডেড বডি উদ্ধার হয়েছে !গত পরশু ওই রুমে এক দম্পতি আর তাদের ব্ন্ধু উঠেছিল।ব্ন্ধুটি রাতে ফিরে গেলেও স্বামী নাকি রাতের খাবার আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখে ওয়াইফ মেঝেতে মৃত অবস্থায় পড়ে ।”
সুষ্মিত,ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে গেলো বিষয় টা বুঝতে ।নিচে ততক্ষণে ডেড বডি নামিয়ে আনা হয়েছে ।ওই দম্পতির স্থানীয় বন্ধু ,স্বামী আরো দু একজন আত্মীয় সবাই হাজির হয়েছে । রিপোর্টারের জেরার মুখে স্বামী স্বীকার করেছে যে ,”মৃত্যুর খবর তিনি ভয়ে কাউকে বলতে পারেন নি “।
ততক্ষণে ঘরে তিন্নি ঘুম ভেঙ্গে উঠে মায়ের মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখা দেখে আর ভিড়ের মাঝে সেই ফেটি বাঁধা লোকটা কে দেখেই চিত্কার করে বলতে থাকে ,”মা এই লোকটাই পচা ,আন্টি টাকে মেরেছে ভারী একটা জিনিস দিয়ে ,আমি সব দেখেছি পরশু জানালা দিয়ে !” তিন্নির এইভাবে উত্তেজিত হয়ে এক নাগাড়ে বলে যাওয়া শুনেই রমা, সুষ্মিতকে ওপরে ডেকে সব খুলে বলে ।
কি করবে ভেবে পায় না সুষ্মিত!একবার ভাবে এসবে জড়িয়ে দরকার নেই তাদের ! আর দুদিন পর তো চলেই যাবে ফিরে ! কিন্তু পরক্ষনেই তার পিতৃহৃদয় মেয়ের এমন মন মরা হয়ে থাকা দেখে সিধান্ত নেয় “পুলিশ কে গিয়ে সব বলবে । সামনে ঘুরতে থাকা অপরাধী ,হাতে নাতে ধরা পড়ুক ,যা তিন্নি কে পরোক্ষ ভাবে মানসিক শান্তি দেবে ।” রমাও বোঝালো পুলিশ কে বলেই দাও ,কিন্তু ওরা নিজেরা যদি জড়িয়ে পরে উটকো ঝামেলায় ,এই চিন্তা থেকেও মুক্ত হতে পারছে না !
এই দো টানার মধ্যে সুস্মিত ,তার পরিচিত এক মনস্তাত্বিক কে ফোন করে পরামর্শ নেয় ।উনি সব শুনে বললেন ,”যেহেতু তিন্নি নিজে চোখে খুন টা হতে দেখেছে ,ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধে বোধে ভুগছে ,ভুলতে পারছে না সেই দৃশ্য । তাই অপরাধী ধরা পড়লেই তিন্নি আবার স্বাভাবিক আচরণ করবে ।”
নিচে নেমে দায়িত্ব প্রাপ্ত পুলিশকে রুমে ডেকে বিস্তারিত জানিয়ে দিলো ওরা ।পুলিশ কাকু তিন্নি কে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরোনো হোটেলের জানালা থেকে কি দেখেছে সব শুনেই ডেড বডির সামনে দাঁড়ানো ওই মাথায় ফেটি বাঁধা লোক টা কে অ্যারেস্ট করলো সকলকে চমকে দিয়ে ।
আজ তিন্নি দের ফেরার ট্রেন ।খবরের কাগজ পরে রমা ,সুস্মিত জানতে পারলো জেরাতে ওই অ্যারেস্ট হওয়া ব্ন্ধু লোক টা স্বীকার করেছে যে রাতে হোটেলের রূম থেকে বেরিয়ে গিয়েও সে লুকিয়ে ছিলো আড়ালে ,মহিলার স্বামী কখন রুম থেকে বেরিয়ে খাবার আনতে যাবে ,সেই অপেক্ষায় । ওদের ট্রেন হাওড়া পৌঁছাতেই রেল পুলিশ আর স্থানীয় কিছু উত্সাহী মানুষ খুনের কিনারা করে দেওয়ায় তিন্নি কে পুষ্পস্তবক আর চকলেট দিয়ে বরণ করতে আসে । ট্রেনে সারাক্ষণ হই হই করে খেলে আসা তিন্নিকে একদম ঝর ঝরে দেখে রমা,সুষ্মিত দুজনেই খুব খুশি আর গর্বিত যে তাদের মেয়ের জন্য পুলিশকে আর তদন্তই করতে হলো না ,অপরাধী যোগ্য শাস্তি পেলো ।