চিত্র-কল্প

রাজর্ষি বর্ধন, আগড়পাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##

শিককুতে আয়োজিত এবছরের আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীর দারুন পরিসমাপ্তি ঘটল।

গতবারের চেয়ে এবারের অনুষ্ঠানের জৌলুস বরং বেশীই ছিল। তাবড় তাবড় সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে শুধু প্রশংসাই শোনা গেছিল। তারিফ  করেছিল বিবিসি এবং মার্কিন মিডিয়াও, যা শুনে সবাই এমন ধারনাও করতে লেগেছিল, দুই গোলার্ধের সম্পর্কের যে শীতলতা তার বুঝি অবসান ঘটল! অনেকে এমন মন্তব্যও ছুড়লেন, শুধু প্রযুক্তিবিজ্ঞানই নয়, জাপান শিল্পের দিক দিয়েও যে চমক দিতে জানে, এই প্রদর্শনীই তা প্রমান করল!

অনুষ্ঠানের যাবতীয় আয়োজন এবং শৃঙ্খলা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, আয়োজকেরা এবার ঢাল-তলোয়ার নিয়েই নেমেছেন। এতটুকুও  ফাঁক  তাঁরা  রাখতে চাইছিলেন না, বিশেষ করে গতবারের শত প্রশংসার মধ্যেও যারা নাক সিটকেছিলেন, তাঁরাও  চুপ রইলেন ! তবে অনুষ্ঠানের মূলে ছিলো সেইসব চিত্রকল্পগুলো,  যা চিত্ররসিকদের তো বটেই, এমনকি উন্নাসিক  সমালোচকদের কাছ থেকে বাহব আদায় করে চেড়েছিল! অনেকে এমন মন্তব্যও করেছিলেন, এইসব অনামী, অখ্যাত আঁকিয়েদের অনেক ছবিই কিংবদন্তি হওয়ার দাবী রাখে। সেইসব ছবি  মোটা টাকাতেও বিক্রি হতে লাগল দেখতে দেখতে, শিল্পের যথার্থ মূল্য দিতে কোটিপতিরা কোন কার্পণ্য করলেন না !

মন্দভালো মিশিয়ে প্রদর্শনীর সমস্ত ছবিই ছিল অনবদ্য, তবে একটা ছবি সবার নজর কাড়ল – সেটি হল দক্ষিন জাপানের তাতেয়ামা পর্বতমালার নিসর্গের ছবি। এই বিষয়ের ওপর শিল্পী যে ছ’খানা ছবি এঁকেছেন তার প্রত্যেকটাতেই শিল্পনিপুণতার চেয়েও ফুটে উঠেছিল শিল্পীর সারল্য এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা! চারপাশে গুরুগম্ভীর তৈলচিত্রের বিমূর্ত শিল্পকর্মের পাশাপাশি সামান্য জলরঙে ফুটিয়ে তোলা চিরাচরিত ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিং যে সবার নজর কেড়েছে এ ভারী আশ্চর্যের বিষয়! তাতেয়ামার প্রতিটি ঘাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ছবিগুলিতে! বিশেষ করে যেটাতে হায়াতসুকি নদীর উৎসমুখ আঁকা হয়েছে, সেটা দূর থেকে দেখলে কোন আসাধারন ফটোগ্রাফি বলে ভুল হবে! সামান্য জলরঙের একি কেরামতি! সবার মধ্যে একটাই গুঞ্জন, কে এই শিল্পী ?

সে নামও অজ্ঞাত থাকল না, ক্রমে প্রকাশ পেলো – ইয়াসু নিশিন্দা। উত্তর জাপানের আওমেরির বাসিন্দা। পেশায় গৃহশিক্ষক, শখ ছবি আঁকার। এর আগে কোন চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেননি বটে, তবে প্রথম অংশগ্রহণেই যে বাজিমাত করেছেন তাতে সন্দেহ নেই, এমনকি জাপানের সম্রাটেরও তা নজর এড়ায়নি! তিনি অবিলম্বে এই ছবির নিলাম ডাকা বন্ধ করে দিলেন – নিসিন্দার হাতে আঁকা ছবি তাঁর চাই!  এমন অভূতপূর্ব চিত্রকল্প কি রাজপ্রাসাদ ছাড়া আর কোথাও মানায় !  তিনি নিশিন্দাকে যথার্থ মূল্য দিতেও প্রস্তুত হলেন!

শুনে সবাই খুশি হল, আবার অবাকও হল – যে নিশিন্দা তার চল্লিশ বছরের জীবনে একবারেও তাতেয়ামায় যাননি, তিনি কি করে ফুটিয়ে তুলতে পারলেন এমন অসাধারন চিত্রকল্প ?

লাজুক নিশিন্দা জনসমক্ষে যেতে পছন্দ করেন না, তার হয়ে তার ভাই নশিরো রাজদরবারে হাজির হলেন। তাঁকে  একই প্রশ্ন করা হলে সে জবাব দেয়  তাঁর ভাই তাতেয়ামার বাতাস ঘ্রান না নিলেও তাঁদের ঠাকুরদা সেই অঞ্চলেরই লোক ছিলেন, এবং ছোটবেলা থেকে তারা ঠাকুমার কাছ থেকে সেই পাহাড়-উপত্যকার বর্ণনা  বহুবার শুনেছে, সেই সবই নিশিন্দাকে আঁকতে সাহায্য করেছে!

সবাই শুনে হতবাক হয়ে গেলো! এমনটাও আবার হয়! নিশিন্দা তো আশ্চর্য মানুষ!

তবে তাদের হতবাক হওয়া এখানেই শেষ নয়!

সম্রাট ঠিক করলেন, এমন প্রতিভাশালী শিল্পীর সঙ্গে করমর্দন না করে ছাড়বেন না! তিনি যখন নিশিন্দাকে আমন্ত্রণপত্র লিখতে বসলেন, তখন নশিরোর তরফ থেকে অনুরোধ এলো – সেই আমন্ত্রণপত্র যেন ব্রেইল-এ ছাপা হয়!

সম্রাট বিস্মিত হলেন – হঠাৎ ব্রেইল-এ কেন ?

নশিরো অমায়িক হেসে জবাব দিলো, তাঁর দাদা জন্মান্ধ, ব্রেল ছাড়া মহামান্যের আমন্ত্রণপত্র পড়বার গতি নেই !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − 4 =