একজন সন্ধানহীন নৃতত্ত্ববিদ
শীলভদ্র
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃ বাসুদেব দাস, অসম
রামানন্দ চাংকাকতির প্রস্তাব শুনে অধ্যাপক বিশ্বম্ভরণ লাফিয়ে উঠলেন।
-আর ইউ ম্যাড?
-আমার একটি ধারণা যে সেখানে হয় তো কিছু আদিম আদিবাসী থাকতে পারে।
-কিসের ভিত্তিতে তোমার ধারণা?মানুষ জলচর জীব নয়। এই অবস্থায় সেখানে কীভাবে কোথায় মানুষ থাকবে? তুমি একজন বিজ্ঞানের ছাত্র। একটা ধারণার ওপর নির্ভর করে অভিযান চালাতে পার না।
-তবু একবার চাক্ষুস অনুসন্ধান করে দেখলে কেমন হয়?
-একটি অবাস্তব প্রস্তাব। যতই আদিম অবস্থাতে থাকুক না কেন, কোনো মানুষের পক্ষে সেখানে বসবাস করা সম্ভব নয়। এটা জীববিজ্ঞানের বিপরীত কথা। আজ পর্যন্ত এই পূর্বাঞ্চলে জরীপ কার্য ভালোভাবে করতে পারা যায় নি। এরোপ্লেন ও এই অঞ্চলের উপর দিয়ে পার হয়ে যেতে সঙ্কোচ বোধ করে। জল আর জল, তার মধ্যে উত্তাল ফেনিল জলস্রোত। এটা হবে একটা অতি বিপদ সঙ্কু্ল অভিযান, তাছাড়া খরচের কথাও চিন্তা করতে হবে। একটা উদ্ভট কল্পনা নিয়ে তো আর এগোনো যায় না।
অধ্যাপক বিশ্বম্ভরণের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাঁর প্রিয় ছাত্র ডঃ রামানন্দ চাংকাকতির প্রতি তাঁর একটু বিশেষ স্নেহ রয়েছে। এভাবে কথা বলতে তাঁর ভালো লাগেনি। ছেলেটির সম্প্রতি কিছু একটা হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। সব সময়ই কী এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে। ছেলেটির মধ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ইতিমধ্যে রামানন্দের কাজকর্মে পৃ্থিবীর বিজ্ঞানী সমাজ আকৃ্ষ্ট হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই জন্য তাঁর কিছু শত্রুসংখ্যা ইদানিং বৃ্দ্ধি পেয়েছে। ঈর্ষার ভাব দমন করা খুব সহজ নয়। একজন সহকারী অধ্যাপক বিশ্বম্ভরণের সামনে কৃ্ত্রিম দুঃখ প্রকাশ করল।
-আমি ওর পরিবারটিকে জানি। সমগ্র পরিবারেই কিছুটা পাগলামির ধাঁচ রয়েছে। তিনি অধ্যাপক বিশ্বম্ভরণকে রামানন্দের ঠাকুরদার কথা বললেন।
দেশের পূর্বপ্রান্তে এই অঞ্চল। অগম্য। জল আর জল, দিগন্ত বিস্তৃত জলের আবরণ। মাঝে মধ্যে এক একটি টিলা। টিলাগুলিতে ঘন গাছপালা। মানুষ বসবাসের অযোগ্য। আগেও দেশের অন্যান্য অংশ এই অঞ্চল সম্বন্ধে বিশেষ কোনো খবরা খবর রাখত না। এখন তো পুরোপুরি ভুলে গেছে। আজকাল মানুষ অতীতের কথা বড় দ্রুত ভুলে যায়। কোনো কথাই মনে থাকে না।
আগে দেশের অন্যান্য অংশে এরকম কিছু মানুষ ছিল যাদের উচ্চারণ স্থানীয় মানুষের উচ্চারণের চেয়ে আলাদা। স্থানীয় মানুষ এটা নিয়ে কৌতুক করতেন। আগন্তুক মানুষেরাও এই বিষয়ে সচেতন ছিলেন, এ নিয়েও লজ্জাও পেত। এই দুর্বলতা দূর করার জন্য বাড়িতেও তারা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিজেদের ভাষায় কথা বলত না। প্রথম অবস্থায় তাদের একমাত্র চেষ্টা ছিল যাতে তাদের ছেলেমেয়েরা অতীতের কথা ভুলে যায়। দুই পুরুষেই তারা এই বিষয়ে সফলতা লাভ করেছে। নিজেদের পদবীগুলিও বদলে নিয়েছে। বরুয়া হয়েছে বহুগুণা, কাকতি হয়েছে কেলেংকার।
নিচের শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা ভূগোলের পাঠ নেবার সময় শেখে তাদের দেশের পূবদিকে এক বিস্তীর্ণ জলমগ্ন অঞ্চল রয়েছে। মানুষ বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। বড় হতে হতে সেটাও ভুলে যায়। ভৌগোলিক এবং রাজনৈ্তিক ভাবেই শুধু এই পূর্বাঞ্চল দেশের একটা অংশ।
রামানন্দদের পরিবারটি পদবী পরিবর্তন করে নি। এখনও চাংকাকতি পদবীই ব্যবহার করে। এই অদ্ভুত পদবী নিয়ে লোকেরা হাসি ঠাট্টা করে। তবে এই পরিবারের প্রতিটি লোকের মধ্যেই কিছু না কিছু পাগলামির লক্ষণ রয়েছে। তাদের বাড়িতে এখনও কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস রাখা আছে। কিছু রেশমি কাপড়, দেশের অন্য কোনো সিল্কের কাপড়ের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। কিছু সোনার অলঙ্কা্র, এই ধরনের অলঙ্কা্র দেশের অন্য কোনো প্রান্তে দেখা যায় না। রামানন্দের ঠাকুরদা বলেছিলেন যে তাদের পূর্বপুরুষরা পূর্বদেশ থেকে এসেছিলেন। তবে বুড়ো হয়ে তাঁর মতিভ্রম হয়েছিল। প্রায়ই তিনি অসংলগ্ন কথা-বার্তা বলতেন। মানুষটা বড় ভালো ছিলেন। লোকেরা প্রতিবাদ করত না। প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে কথাগুলি শুনে যেত। মানুষের কত রকমের উদ্ভট কল্পনা থাকতে পারে। এই তো প্রতিবেশী মহাবীর সিঙ দাবী করেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষরা পশুরাজ সিংহ ছিল। করুক। তাতে কারই বা ক্ষতি? রামানন্দের ঠাকুরদা তাঁরা পূর্বদেশ থেকে এসেছে বলে, বলতে দাও। মানুষ জলচর জীব নাকি? এক হিসেবে অবশ্য কথাটা মিথ্যা নয়। জীবগুলি নাকি প্রথমে জলচর ছিল। তারপরে উভয়চর এবং শেষে স্থলচর। হয়তো রামানন্দের মনে এই আদিম সংস্কারের স্মৃতি এখনও লোপ পায়নি।
এই পরিবারটিতে সত্যিই পাগলামির ছাপ রয়েছে। পাগলামি নাকি পুরুষানুক্রমিক। এতদিন রামানন্দের মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দেখা যায় নি। কী হল? এত নাম করা বৈজ্ঞানিক, দেশ বিদেশের বৈজ্ঞানিক মহলে সুপরিচিত। ইতিমধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে সু-প্রতিষ্ঠিত।
রামানন্দ তার ঠাকুরদার কাগজপত্রের মধ্যে কিছু পুরোনো খবরের কাগজ পেল। কাগজগুলি প্রায় ধূলিতে পরিণত হতে চলেছে। নিচের অংশটুকু কোনোভাবে পড়া যায়। একজন মন্ত্রী বন্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটা পরিকল্পনা বানিয়েছে। প্রতিটি গ্রামে আশ্রয় নেবার জন্য এক একটি উঁচু আশ্রয় মঞ্চ তৈ্রি করতে হবে। এটাই খবর।
রামানন্দ উত্তেজিত হয়ে উঠল। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, মাঝে মধ্যে এক একটি টিলা। এগুলিই কি তাহলে সরকার গড়ে দেওয়া মঞ্চ? অতীত ইতিহাসের সাক্ষী?
হঠাৎ রামানন্দ নাই হয়ে গেল। শিক্ষিত মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হল। মানুষগুলির কি হল? কোনো খোঁজ খবর নেই।অদৃশ্য।
দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। কেবল জল আর জল। এমনিতে শান্ত জলরাশি। তারই মধ্যে জায়গায় জায়গায় জলে প্রচণ্ড স্রোত। রামানন্দ দক্ষ মাঝি নন। যুক্তি বুদ্ধিহীন আবেগের তাড়নায় সে এভাবেই বেরিয়ে এসেছে। সে যা দেখছে তাতেই তার মনে যথেষ্ট উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। তার চোখে যা পড়ছে তার মাধ্যমেই ফিরে গিয়ে সে একটা সুপরিকল্পিত অভিযানের ব্যবস্থা করতে পারবে। জলের নিচে কিছু জিনিস দেখে তার ধারণা হয়েছে যে এইসব মানুষ সৃষ্টি করা গঠনের ধ্বংসাবশেষ। যতই সে এগিয়ে গেল ততই সে এক আধি-ভৌতিক পরিবেশে প্রবেশ করেছে বলে মনে হল। জায়গায় জায়গায় প্রকাণ্ড এক একটি মাটির টিলা। এগুলি স্বাভাবিক ভাবে সৃষ্টি হয় নি। মানুষ যেন এসব তৈ্রি করেছে। অনন্ত জলরাশির মধ্যে গাছপালা ঘিরে রাখা এক একটি প্ল্যাটফর্ম।
এক একটি সভ্যতার বিলুপ্তির কারণ অনেক হতে পারে। বন্যা, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, মহামারী, জ্ঞাত-অজ্ঞাত অসংখ্য কারণ। লুপ্ত সভ্যতার অনেক নিদর্শন আছে। এটা হল তারই অন্য একটা নিদর্শন।
লুপ্ত সভ্যতার নিদর্শনের প্রমাণ পেয়ে রামানন্দ ফিরে যেতে প্রস্তুত হল। তার নৌকায় থাকা খাওয়ার জিনিসপত্র ও কমে এসেছে।
রামানন্দ খুব বেশি অবাক হল না। স্বপ্নে কোনোরকমের আশ্চর্য দৃশ্য দেখে মানুষ অবাক হয় না। কেবল মাত্র কৌতূহল। এরা কোথা থেকে এল? তার নৌকার চারপাশে একদল সুন্দরী যুবতি মেয়ে। মৎস্যকন্যা? রামানন্দের ঠাকুরদা বলা কথাগুলি মনে পড়ে গেল। পূর্বদেশের মেয়েদের মতো সুন্দরী মেয়ে নাকি পৃথিবীর কোথাও নেই। স্বপ্ন না বাস্তব?
কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?-ওদের ভাষা বুঝতে তার কোনোরকম অসুবিধে হল না। এই ভাষাজ্ঞান তাঁর মগজের কোষে সুপ্ত হয়ে ছিল।
তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় রামানন্দ জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা কে? চারপাশে সীমাহীন জল? কোথা থেকে এলে?
-কেন? জলের নিচ থেকে।
-জলের নিচ থেকে? জলের নিচে থাকা যায় নাকি?
রামানন্দের কথায় সামান্য সন্দেহ।
-যায়। শিখলেই পারা যায়। জলের মধ্যে কীভাবে থাকতে হয় একজন মুখ্যমন্ত্রী আমাদের শিখিয়ে রেখে গেছেন।
যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে সবাই একসঙ্গে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রণাম জানাল।
-এসো।
-কোথায়?
-আমাদের সঙ্গে জলের নিচে।
-অনন্ত বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে খালি ডিঙি নৌকা ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে দোল খেতে থাকল।