চাকরী বাঁচাতে জরায়ু বাদ!
গ্রামের পর গ্রাম জরায়ু বিহীন নারী। বয়স ধরুন ২০ থেকে ৩০, দুই বা তিন সন্তানের মা। সবাই নিম্ন আয়ের শ্রমিক। পিরিয়ড হলে মালিকের নানা গঞ্জনা শুনতে হয়, বেতন কাটা যায়। জরিমানা হয়। তাই পেটের তাগিদে, অভাবের তাড়নায় অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেন এই দরিদ্র নারী শ্রমিকরা। কিন্তু এই অসভ্যতা, পাশবিকতা কেন ঘটছে?
কর্মজীবী নারীদের একটা বড় সমস্যা, পিরিয়ড। এই কর্মজীবীদের মধ্যে তারাই পিরিয়ড নিয়ে বিব্রত, যারা মূলত শ্রমিক। কোন চিনিকলের অফিসার পদে থাকা নারীর মাসিক ঋতুচক্র কর্মস্থলে তাকে সামান্য হলেও বিব্রত করে। কারণ সেই সভ্যতার শুরু থেকেই পিরিয়ডের সময়টাতে নারীকে অস্পৃশ্য অশুচি বলে গণ্য করে। তাকে হয় ঘরের কোণে আবদ্ধ থাকতে হয়, অথবা একা থাকতে হয় সবাইকে এড়িয়ে। সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ঋতুমতী নারীদের যাওয়া একদম নিষেধ। বহু বছর ধরে এটাই চলে আসছে।
সম্প্রতি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসভ্যতার প্রাচীর ভাঙতে শুরু করেছেন শহরের শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা। এর ফলে চিত্রটা একটু একটু করে পালটাচ্ছে। কিন্তু শহরের শিক্ষিত মানুষের মাঝে সামান্য পরিবর্তন আনা সম্ভব হলেও গ্রামের চিত্রটা এখনও করুণ। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের একটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছে। সেখানে হাজার হাজার তরুণী স্বেচ্ছায় জরায়ু কেটে বাদ দিয়েছেন হাসপাতালে গিয়ে। যারা এই অপারেশন করিয়েছেন, তারা মূলত কৃষি শ্রমিক। ক্ষেত থেকে আখ কাটেন। মহারাষ্ট্র আখের উর্বর ক্ষেত্র। বছরে ৬ মাস এসব আখ ক্ষেতে কাজ করতে আসেন হাজার হাজার শ্রমিক। এই নারীপুরুষরা একটানা ছয় মাস আখ কাটার কাজ করেন। আখ কাটা অনেক পরিশ্রমসাধ্য, তাই নারীরা পিরিয়ডের তিন বা পাঁচ দিন কাজে আসতে পারেন না, যেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অনুপস্থিত থাকলেই মজুরি কাটা যাবে। একটা দিনের মজুরি কম মানে ওদের কাছে অনেকটা হারানো। এসব জায়গায় থাকার পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। ক্ষেতের পাশেই কুঁড়ে ঘর বা তাবুতে থাকে শ্রমিকরা। মাঝে মাঝে রাতেও কাজ করতে হয়, কাজের সীমা পরিসীমা নেই, অনেক কাজ। এই অবস্থায় পিরিয়ড হলে একজন নারী শ্রমিক কঠিন সমস্যায় পড়ে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পিরিয়ডের সময়টা পার করতে করতে তারা ইনফেকশনের শিকার হন। নানা রকম মহিলা সংক্রান্ত রোগের সমস্যাও দেখা দেয়। তখন চিকিৎসার নামে অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তার একের পর এক নারীর সার্জারি করে জরায়ু ফেলে দেন। এমনকি সামান্য সমস্যা, যা ওষুধ খেলেই সেরে যাবে, সেসব ক্ষেত্রেও নির্বিচারে জরায়ু অপসারণের অপারেশন করে দেয়া হয়। এর ফলে কিছু গ্রাম এখন জরায়ুহীন নারীদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছে।
সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের বিধানসভায় নারীদের এই অবমাননাসূচক শারীরিক ক্ষতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন বিধায়ক নীলম ঘোরে। তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একনাথ সিন্ধে। মন্ত্রী জানান, ৩ বছরে বীদ জেলায় ৪ হাজার ৬শ ৫ টি হিসটেরেকটমি সার্জারি হয়েছে। এই সার্জারিতে অনেক সময় নারীর প্রজননতন্ত্রের প্রায় সব কিছুই কেটে ফেলা হয়। তবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি তদন্ত কমিটি করার ঘোষণা করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
পাশবিক্ এই আচরণের আরেক উদহারন দেখা গেছে তামিলনাড়ুতেও। সেখানে কাহিনী আরও ভয়াবহ। কোটি ডলারের গার্মেন্টস বানিজ্য, বিশাল বিশাল কারখানা। অনেক মেয়ে কাজ করে। পিরিয়ডের সময় অসুস্থ হন অনেকে, অনেকের যন্ত্রণা হয়, সেক্ষেত্রে তাদের যেখানে এক বা দুদিন ছুটি দেয়া উচিত। কিন্তু ছুটি তো দূরে থাক, উল্টে ব্যথা কমানোর জন্য নাম না জানা কোনও ওষুধ খেতে দেওয়া হয়। নাম না জানা ওষুধ সেবনের পর সবারই কমবেশি শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই বিষয় নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে সরকারও।
জাতীয় মহিলা কমিশনের মতে, মহারাষ্ট্রের অবস্থা বেদনাদায়ক। এই সব নৃশংসতা বন্ধ করতে বলেছে কমিশন। এই প্রেক্ষিতে তামিলনাড়ু সরকার পোশাক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে নজর রাখার কথা বলেছে। নারী শ্রমিকদের এইসব কষ্ট অপমানের কথা প্রকাশ হল এমন সময়, যখন সারাবিশ্বে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জোর প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু লক্ষণীয়, ভারতে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা কমে আসছে। ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ, সেটি ২০১৫-১৬ বছরে কমে হয়েছে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশে নারী কর্মজীবীদের হার কমে আসার কারণ সহজেই অনুমেয়।
খুবই মর্মস্পর্শী খবর।নারীর মুক্তি আসলে শিক্ষাগ্রহণ। শিক্ষাই পারে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে।
কবিগুরুর ভাষায়- এই আকাশে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…
খুব অপমানকর ও দুঃখ জনক ঘটনা।অবিলম্বে এসব বন্ধ হওয়া উচিত।
খুব অপমানকর ও দুঃখ জনক ঘটনা।অবিলম্বে এসব বন্ধ হওয়া উচিত।