ভালবাসার মরণ
সোমা মজুমদার, হাইলাকান্দি, অসম ##
নীলা একটি অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে। একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। আপন বলতে ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। নীলার বেতনের টাকায় তাদের সংসার চলতো। একদিন পথ চলতে সৌরভর সাথে দেখা।
বন্ধু, প্রেম,ভালবাসা মন দেওয়া নেওয়া সবই হয়ে গেছে। সৌরভ একটা ধনী পরিবারের ছেলে। অফিসে ভাল চাকরি করে। মা, ভাই আর সে এই তাদের সুখের সংসার।
ছোট ভাই সোহম সিঙ্গাপুর থাকে, পেশায় একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার।
নীলা সৌরভকে পাগলের মতো ভালবাসতো। সৌরভও নীলাকে। নীলা সৌরভের হাত ধরে সারা জীবন একসাথে চলার স্বপ্ন দেখতো। সৌরভ ছাড়া তার যে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই বার বার নীলা সৌরভকে এই কথাটি বার বার বলতো। সৌরভ ও জীবন দিয়ে হলেও নিজের ভালবাসার কসম খেতো।
একদিন সৌরভ অফিসে মাথা ঘুরিয়ে নীচে পড়ে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর স্বাভাবিক হলেও, ডাক্তার তাকে সিটি স্ক্যান করাতে বলল। ইতিমধ্যে সৌরভের মা জয়া দেবীও হাসপাতালে পৌঁছে গেছেন। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট আসবে আগামী কাল।
সৌরভ আর তার মা বাড়ি চলে গেল।
পরদিন রিপোর্ট হাতে আসার পর সৌরভের মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। একি হলো? তার সব শেষ হয়ে গেল যে….. কি করবে সে, নীলাকে কি জবাব দেবে..? সে ছাড়া নীলার যে আর কেউ নেই। এসব ভাবতে ভাবতে সৌরভ অস্থির হয়ে গেল।
বাড়িতে এসে সে মাকে বলল, ডাক্তার বলেছে ব্রেন টিউমার। সৌরভের মা জয়া চৌধুরী নিজেও একজন ডাক্তার। কত মানুষ তার মুখ থেকে নিজেদের জটিল অসুখের কথা প্রথম শুনেছে। কিন্তু আজ নিজের ছেলের এমন পরিণতি কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না।
সৌরভ ভাবছে নীলার কথা। কি করে বলবে নীলাকে এই নিষ্ঠুর কথাগুলি। নীলা কি মেনে নিতে পারবে? নিলা যে তার হাত ধরে সারাজীবন একসাথে চলার স্বপ্ন দেখতো। কি করে তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিবে। এমন সময় নীলার ফোন।
কি হলো? আজ আমাদের বেরোবার কথা ছিল যে? নীলার ফোনে সৌরভর মনে পড়ে গেল হ্যাঁ, আজ একান্তে কিছুটা সময় কাটানোর কথা ছিল। তাড়াতাড়ি সৌরভ ড্রেস চেঞ্জ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
নীলা আর সৌরভ পাশাপাশি বসে। অথচ কিছুদিন পর সৌরভ হয়তো এতো দূরে চলে যাবে যে নীলা চাইলে ও হয়তো তার মুখখানা আর মনে করতে পারবে না। নীলা সৌরভকে দেখছে, এ কোন সৌরভকে দেখছে সে। এ তো সেই সৌরভ নয়। হাসিখুশি থাকা প্রানবন্ত সৌরভকে এতো মনমরা লাগছে কেন? নীলা সৌরভের কাঁদে হাত রেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে? সৌরভ এড়িয়ে গেল। নীলাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সেও বাড়ি চলে গেল।
এদিকে দাদার অসুখের খবর শুনে সিঙ্গাপুর থেকে ছোট ভাই সোহমও চলে এলো। জয়া দেবী ছোট ছেলে সোহমকে নিয়ে সহকর্মী ডাক্তারদের সাথে আলোচনায় বসলেন। কি করা যায়। কিন্তু রিপোর্ট বলছে অপারেশন করালে বাঁচার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। অপারেশন না করালেও যখন দাদা বাঁচবে না আমরা বরং শেষ চেষ্টাটা করে দেখি। সোহম মাকে বলল। ডাক্তাররাও সায় দিলেন সোহমের কথায়।
অপারেশনর তারিখ ঠিক করা হলো। এবার আর নীলাকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। সব বলতে হবে। কারণ তার হাতে যে আর সময় নেই।
সোহমকে সে আগেই বলে দিয়েছিল নীলার কথা। এবার সৌরভ সোহম ও মাকে ডেকে বলতে লাগলো তার শেষ ইচ্ছের কথা-
ভাই সোহম আমার একটা অনুরোধ রাখবি ভাই? যদি আমার শেষইচ্ছাটা পূরণ করিস তো আমি শান্তিতে মরতে পারবো।
সোহম বলল, বল দাদা তোমার সব কথা আমি রাখবো।
সৌরভ – বল ভাই তুই নীলাকে বিয়ে করবি ?
আমি ছাড়া নীলার যে আর কেউ নাই। আমি ওকে একটা আশ্রয়ে রেখে যেতে চাই। সোহম নীলাকে না দেখেই, ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে গেল।
এবার নীলাকে সব জানানোর পালা। নীলাকে ফোন করলো সৌরভ। তাড়াতাড়ি রেডি হও।
নীলা – বলল, কোথায় যাবো ?
সৌরভ – আমাদের বাড়ি।
কিন্তু সৌরভদের বাড়ি নীলা আগে কোনদিন যায়নি। নীলা কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু সৌরভ ফোন কেটে দিল। কিছুক্ষণ পর সৌরভ হাজির নীলাদের বাড়িতে। নীলার মারও সৌরভকে খুব পছন্দ। সৌরভ ও নিজের মায়ের মতো দেখতো তাকে। সৌরভ নীলার হত ধরে গাড়িতে নিয়ে এলো। এ কোন সৌরভ কে দেখছে নীলা, এতো বেজার কেন তার মুখ? এতো মনখারাপ কেন তার? সে তো এমন নয়? কি হয়েছে, নীলা মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলো?
চালকের আসনে বসা সৌরভ কোন উত্তর দিল না। সৌরভ আর নীলা পাশাপাশি বসে, অথচ কোন কথা নেই। এমনটা হবে নীলা স্বপ্নও ভাবে নি।
বাড়ি পৌঁছে গেল সৌরভ নীলাকে নিয়ে। সুশ্রী নীলাকে প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে গেল সোহমের। সৌরভর মাকে প্রণাম করে নীলা বসলো। ভাবছিল সৌরভ হয়তো তার মা’র সাথে পরিচয় করানো জন্য বাড়ি নিয়ে এসেছে। কিন্তু এযে তা নয়। নীলা ভাবতেও পারিনি।
সৌরভ নীলাকে বলতে লাগলো তার শেষ কথাগুলো। নীলা আমি আর বাঁচব না। আমার হাতে সময় আর নেই। সবকিছু শুনে নীলা যেন পাথর হয়ে গেল। না কিছু বলতে পারছে, না কাঁদতে পারছে। হঠাৎ নীলা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে কোনরকম থাকে ঠিক করা হলো। এবার এগিয়ে এলেন সৌরভের মা। মারে আমি মা হয়ে মেনে নিয়েছি। তোমাকেও মেনে নিতে হবে। বিধাতার ইচ্ছে আমাদের মেনে নিতেই যে হবে মা। আমরা সৌরভকে বাঁচানার সব চেষ্টা করবো। কিন্তু তারপরও যদি কিছু হয়ে যায়। তুমি তার শেষ কথাগুলো শোনো, না হলে পরে যে পস্তাতে হবে।
বুকে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে নীলা শুনতে লাগল সৌরভর কথাগুলো।
সৌরভ বলছে – নীলা আমি তোমাকে এই বিশাল পৃথিবীতে একা রেখে চলে যেতে পারবো না। আমার সাথে যা হয়েছে তা যদি তোমার হতো, তাহলে আমি তোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তুমি যে মেয়ে, তোমার চাই একটা আশ্রয়, একটা নিরাপত্তা। আর তোমার সেই আশ্রয় হলো সোহম। আমি সোহমের হাতে তোমাকে তুলে দিয়ে মরতে চাই। না হলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না।
নীলা সৌরভর বুকে মুখ লুকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদে। একি হয়ে গেল সৌরভ, এসব তো হওয়ার কথা ছিল না। নীলার চোখের জলে যেন সাগর ভেসে যায়।
সৌরভর ইচ্ছা অনুযায়ী নীলা সোহমের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো। সৌরভ নিজ হাতেই বিয়ের সব কাজ করলো।
নিজের প্রেমিকাকে অন্যর হাতে তুলে দেওয়া, মৃত্যুর আগেই যেন মরণ যন্ত্রনা পেয়ে গেল সৌরভ।
বিয়ের দুদিন পর অপারেশনর জন্যে তারা চারজন হাসপাতালের জন্যে রওয়ানা দিল। চালকের আসনে বসা সোহমের পাশেই বসে আছে নীলা। পিছনের সিটে সৌরভ ও তাঁর মা।
নিলার হাতে এখনও বিয়ের মেহেন্দি লেগে আছে। মেহেন্দি পরা হাতে নীলা বার বার তার চুলগুলো সামলাচ্ছিল। সৌরভ আড়চোখে দেখছে নীলাকে। নীলা তার খুব কাছেই বসে আছে, অথচ এখন সে তার কতো দূরে। দুদিন আগেও নিলা তার ছিল। আর আজ নীলার চোখে চোখ রেখে তাকানাটাও যেন পাপ। এসব ভাবতে ভাবতে সৌরভ হাসপাতাল পৌঁছাল।
জয়া দেবী ডাক্তার হলেও আগে তিনি একজন মা। তাই মায়ের দায়িত্বটাই আগে সেরে নিতে চাইলেন। ছেলের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। সৌরভ মাকে প্রণাম করলো। মায়ের বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষণ স্থির থাকলো। কতো পরম শান্তি। এযেন মায়ের সেই ছোট্ট সৌরভ।
সৌরভ নীলার কাছে এলো, বিদায় নিতে। হয়তো শেষ বিদায়। সৌরভ নীলার হাত সোহমের হাতের উপর রেখে, একটা কথাই শুধু বলল। ভাল থেকো। মাকে দেখো। সৌরভ চলে যাচ্ছে, যেতে যেতে একবার পিছনে ফিরে নীলাকে দেখলো। এই দেখা যেন শেষ হয় না। আরও দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আর যে সময় নেই।
অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের সাথে জয়া দেবী নিজেও আছেন। বাইরে চরম উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে নীলা আর সোহম। পাঁচ ঘন্টা অপারেশনের পর হঠাৎ চোখে মুখে আনন্দের হাসি নিয়ে জয়া দেবী দৌড়ে এসে, নীলাকে জড়িয়ে ধরে বললেন অপারেশন সফল। সৌরভ এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে।
নীলা দৌড়ে সৌরভর কাছে গেল। সৌরভ আস্তে আস্তে চোখ মেললো। চোখ মেলেই প্রথমে নীলাকে দেখলো। এ কোন নীলাকে দেখছে সে এযে আর তার নীলা নয়।
সৌরভ বুঝতে পারলো, সে এখন বিপদ মুক্ত। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। আবার আগের মতো সবকিছু করতে পারবে। অফিস যেতেও পারবে। মরেনি সে। হয়তো আরও অনেক দিন বাঁচবে। কিন্তু মরণ হয়েছে তার ভালবাসার।
নীলা সোহমের হাত ধরে চলে গেল সিঙ্গাপুর। সৌরভ বেঁচে রইলো নীলার সাথে কটানো সুখস্মৃতিগুলো নিয়ে।।