‘অবেক্ষণ’ শিশুমেলা-২০১৯
বিজয় মুখোপাধ্যায়, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
এ মেলার মূল মন্ত্র বাই দ্য শিশু, অফ দ্য শিশু, ফর দ্য শিশু। গত ১৪ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার ‘অবেক্ষণ’ এর ব্যবস্থাপনায় গোবরডাঙার বাবুপাড়া সন্মিলনী ক্লাবের মাঠে অনুষ্ঠিত হল শিশুমেলা – ২০১৯। সুদীর্ঘ ২৭ বছরের এই মেলার মাঝের কয়েক বছর ছেদ পড়লেও নতুন রূপে তা আবার ফিরে এসেছে বছর তিনেক হল। বর্তমান সমাজে শিশুদের নিত্য নৈমির্তিক বাঁধা ধরা জীবনে এ যেন এক বুক তাজা বাতাস, একরাশ অনাবিল হাসিখুশি’র মূহুর্ত।
অন্য মেলার সঙ্গে এই মেলার মূল পার্থক্য এখানে শিশুরা হল বিক্রেতা, আর যীশুরা অর্থাৎ বড়রা হল ক্রেতা। শিশুদের বাড়ি থেকে তৈরি করে আনা নানান রকম সুস্বাদু খাবারের পসরা এবং তাদের তৈরি হাতের কাজের ডালিতে ভরে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। কি ছিল না এই মেলায় ? আলু কাবলি, ঘুঘনি, ঝালমুড়ি, ফুচকা, কেক, পিঠে, চিড়ের পোলাও এর মত সনাতনী বাঙালি খাবার থেকে শুরু করে হাল আমলের বার্গার, পকোড়া এমনকি বিরিয়ানি পর্যন্ত। ১০ টাকা দাম এক প্লেট বিরিয়ানির। তাই তো বিরিয়ানির গামলাটা তো শুধু আসতেই দেখতে পেলাম, সে স্বাদ অনুভব করার সৌভাগ্য আর হল না, মুহুর্তেই ভ্যানিশ। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ শুরু হওয়া মেলার সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই খাবারের দোকানগুলোয় শুধু ফেলে আসা সুঘ্রান আর বিক্রি-বাটার হিসাব নিকাশ।
কঁচি-কাঁচার দল যে এমন হস্তশিল্পে পটু তা এ মেলায় না আসলে হয়ত অজানা থেকে যেত। অপ্রয়োজনীয় বা ফেলে দেওয়া নানান সামগ্রী দিয়ে তৈরি অসাধারণ সব হাতের কাজ ঠাঁই পেয়েছে এই শিশুমেলায়।
সাথে মেলার উপরি পাওনা বিনোদন। নৃত্য, আবৃত্তি, সঙ্গীতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল মেলা প্রাঙ্গন। বিক্রি-বাটা সামলাতে সামলাতে এক ছুটে গিয়ে আবৃত্তি, গান বা একটু কোমর দুলিয়ে আসা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিচালনায় ছিলেন সৌমী মুখোপাধ্যায় এবং দেবদীপ বণিক।
আধুনিক সমাজে যেখানে শৈশব বলে শিশুদের প্রায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, যেখানে তারা মন খুলে হাসতে শেখার আগে স্কুলে গিয়ে নিলডাউন হয়ে দাঁড়াতে শেখে, যেখানে সমবয়সী খেলার সাথী পাওয়ার আগে সর্বত্র নিজের প্রতিযোগীকে দেখে, সেখানে অবেক্ষণ শিশুমেলা একলহমায় তাদের শৈশবটাকেই যেন নতুন রূপে দেখতে শেখায়, মা-বাবা’কে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
সংগঠনের পক্ষে সম্পাদক পলাশ মুখোপাধ্যায়ের গলায় ধরা পড়ল খানিকটা আক্ষেপের সুর, – “এখনকার মা-বাবা’রা বাচ্চাদের খেলতে পাঠায় না, খেলা শিখতে পাঠায়। প্রতিদিন একটু একটু করে তাদের শৈশব চুরি করা হচ্ছে। এই শিশুমেলা সেই শিশুদেরকে একটা দিন নিপাট আন্নদে রাখার একটা প্রয়াস। পাশাপাশি এই মেলা শিশুদের স্বনির্ভরতা এবং সামাজিক চেতনার পাঠও দেবে”। মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা বিজয় মুখোপাধ্যায়, রাজিত কর্মকার বা বিশ্বনাথ দাস, সকলের গলাতেই একই সুর, ছোটদের মুখের নির্মল হাসিই এই উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে। ছোটদের উৎসাহ দিতে সমান তালে হাজির ছিলেন বড়রাও। কাঁচা হাতে তৈরি চা অথবা কচি হাতে তৈরি ঝালমুড়ি, ঘুগনি, বড়রা কিন্তু ছাড়েননি কোনওটাই। সকলেই জানিয়েছেন এমন মেলার ক্রেতা হিসেবে যথেষ্ট খুশি তারা।
সঙ্গীত শিল্পি নচিকেতার ভাষায় বলতে গেলে “ ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ।” এ মেলা শুধুমাত্র সেই শৈশব চুরি যাওয়া শিশুদের জন্য শিশুদিবসের উপহার। পরিশেষে কবির ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে –
“ আবার আসিব ফিরে
এই শিশুমেলার ভিড়ে……’’
এই বছর অবেক্ষন শিশু মেলায় গিয়েছিলাম, সত্যি অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো।