মুনিচুনি
নুরুল সুলতান
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস ##
নয়নতারা জানে না।
জানাবে বলেছিল। আমার মনে আছে। রেলগাড়ি স্টেশন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বলেছিল –‘জোনাক, তোমাকে জানাব। তুমি জানতে চাওয়া প্রতিটি কথার উত্তর আমার মনের মধ্যে রয়েছে।এখন ‘সময়’ নয়-আমার মনের দুয়ার খোলার।একদিন সময় আসবে।তখন জানাব…।’
নয়নতারা আরও কিছু বলেছিল। রেল চলছিল। রেল চলছিল বলেই আমি বুঝতে পারিনি। রেলগাড়ির ঝিক ঝিক শব্দে নয়নতারার কথাগুলি চাপা পড়ে গিয়েছিল।
একদিন নয়নতারা এসেছিল।
নয়নতারা যখন বাড়ির সামনে পৌছেছিল,তখন অন্ধকার নেমে এসেছিল। আমি তাকে অস্পষ্ট দেখেছিলাম।
‘আমি নয়নতারা। তুমি,তুমি জোনাক…’
‘হ্যাঁ,আমি জোনাক। এত দেরি করলে যে…’
‘তার মানে,তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?’
‘আপনি আসবেন বলে জানা ছিল যে…’
নয়নতারা আরও কিছু বলতে চেয়েছিল।মা বেরিয়ে এসেছিল-‘তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে বোধহয় রেলগাড়িটা সময় মতো ছাড়েনি।’
‘সময়েই ছেড়েছিল মা…আমি আপনাকে মা বলেই ডাকব।হবে তো…খারাপ পাবেন নাকি?’
‘ডেক,ডেক।ভালো লাগবে। আই,মানে মা।…আমার তো মেয়ে নেই…এসো,এখন ভেতরে এসো।হাত-পা ধুয়ে চা খাও। তারপর আমরা রাতের রান্নার কথা চিন্তা করব। তোমার ক্ষুধা পেয়েছে নাকি?’
‘না। রেলে কিছু খেয়েছিলাম না।’
‘ঠিক আছে।আমাদের এখানে রাত আটটার সময়ই মধ্যরাত হয়।রাতের খাবার নয়টার আগে খাওয়া হয়।’
‘মা,আমাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে এত ব্যস্ত হবেন না।ভালো লাগবে না।আপনাদের অসুবিধা করছি বলে মনে হবে।’বলে নয়নতারা ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।কিচ্ছুক্ষণ পরেই হয়তো বাগানের পেছনে পৌছে গিয়েছিল,পেছনের দরজা দিয়ে।চাপা কলের কাছে গায়ে জল ঢালার শব্দ হচ্ছিল।–সেদিন সকালেই চাপাকলের চারপাশটা যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায় সেভাবে ঢেকে দিয়েছিলাম।
গায়ে বিলেতি সাবানের গব্ধ নিয়ে নয়নতারা আমার পাশে বসেছিল।নয়নতারার শরীর থেকে গন্ধ এসে আমার নাকে লাগছিল।ভালো গন্ধ।সেই গন্ধ জনতা সাবানে নেই।মার দেওয়া চায়ের কাপটা মুখে নিয়ে নয়নতারা বলেছিল –‘অনেক বছর পরে মুক্ত আকাশ,আকাশের চাঁদ দেখছি।জ্যোৎস্না আমার ভালো লাগে।ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে ।’
‘আমার নাম জোনাক।ছূঁয়ে দেখলেই হল।’-আপনা থেকে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।নয়নতারা হাসল।খিলখিল করে।হাসিটা বোধহয় আমার হৃদয়ে বেজেছিল।হয়তো আমার চেহারায় প্রতিফলিত হয়েছিল ,এবং হয়তো সেজন্যই দেহে ,আমার দেহে বিশেষ উত্তাপ অনুভব করছিলাম।এই বিশেষ উত্তাপের নাম দিয়েছিল নয়নতারা।এর পরে।
নয়নতারা দশ সপ্তাহ আমাদের বাড়িতে ছিল।সেই দিনগুলি আমার কাছে সুন্দর হয়ে উঠেছিল।আমার প্রিয় লেখিকাকে বারবার কাছ থেকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম । একদিন স্পর্শ করেছিলাম।
স্পর্শ –আমি করেছিলাম না আমাকে স্পর্শ করেছিল নয়নতারা
সেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিলাম ,অন্যান্য দিনের মতো । নয়নতারাও উঠে পড়েছিল । আমার সঙ্গে ফসলের মাঠে যাবে । সকালের সবুজ অনুভব করবে,পাখির কাকলি শুনবে।
আমরা মাঠে পৌছে গিয়েছিলাম।সবুজের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা বিলের কাছে পৌছে গিয়েছিলাম।দেশি পাখি,পরিভ্রমী পাখির সমাবেশ বসছিল।ব্যাপারটা আমার কাছে পাখি,কেবল দেশি বিদেশি পাখির সমাবেশ ছিল।
আর নয়নতারার জন্য –সৌন্দর্য।
‘জোনাক…এত সুন্দরের মধ্যে তুমি থাক,তুমি সুন্দর হবে না কেন… তোমার মন সুন্দর হবে না কেন…’
হাত দুটো মেলে ছোট মেয়ের দৌড়েছিল-নয়নতারা।নয়নতারার দেহে লেগে থাকা আঁচল উড়ছিল।সবুজের মধ্যে নয়নতারা গড়াগড়ি দিচ্ছিল।সুন্দর বুকের দিকে আমার চোখ পড়ছিল।আমার চোখ পালাতে চেষ্টা করছিল।
‘জোনাক তুমি ওখানে কেন?…এদিকে এসো,আমার কাছে।’
আমি কাছে গিয়েছিলাম।
‘আমার পাশে,এখানটাতে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়তো।…নিজেকে পাখি পাখি বলে মনে হবে।’
আমি শুয়ে পড়েছলাম।
‘এসো…এখন আমরা উড়তে চেষ্টা করি।
নয়নতারার দুই হাত নাচ্ছিল।নাচতে নাচতে হঠাৎ আমার দেহে উবুড় হয়ে পড়ছিল।
পাখি হয়ে আমার দেহে খুঁটছিল- নয়নতারা।
‘জোনাক,খারাপ পেয়েছ?’
আমার মন-মগজে কোনো উত্তর ছিল না।
‘জানি,তুমি খারাপ পেতে পার না । তোমার দেহে ‘বিশেষ উত্তাপ’আমি অনুভব করছি।পুরুষের দেহে ‘বিশেষ উত্তাপ’আমি অনুভব করছি।পুরুষের দেহে বিশেষ উত্তাপ কখন বিরক্ত করে তুমি জান না জান না।‘
না,তখন ও আমার মন-মগজে কোনো উত্তর ছিল না।বহু নীরবতার পরে,অনেক ভালো লাগায় মন ভরে পড়ার পরে আমার দুই ঠোঁটের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল কয়েকটি শব্দ-‘আমি আপনাকে ভালোবাসি ,সেদিন থেকে-আপনার ‘বাসবী’পড়ার পর থেকে।আমার কাছে আপনি বাসবী।জোনাকের বাসবী।জোনাক বাসবীকে যেভাবে অনুভব করেছিল,স্পর্শ করেছিল-আমিও করতে চাই।আমার জন্য আপনি বাসবী হতে পারেন না কি?’
নয়নতারা… বাসবী হয়েছিল । জোনাক, জোনাক হয়ে বাসবীকে অনুভব করেছিল।
বাসবী! …আমার বাসবী!!
বাসবী কাঁদছিল।চোখের জল ঝর্ণা হয়ে উঠেছিল।–জোনাক আসেনি।জোনাক হারিয়ে গিয়েছিল।দেশকে স্বাধীন করার জন্য জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল জোনাক।
‘জোনাক নামটা কেন রেখেছিলে?’
‘আমার ভালো লাগে।জোনাক ভালো লাগে বলে…।’
‘বাসবী’র নায়ক জোনাক।নয়নতারার উপন্যাস বাসবী।এই যে উপন্যাসটার নায়কের নাম জোনাক,আমার নাম ও জোনাক,সেইজন্যই নয়নতারার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।‘ফোনিক সম্পর্ক’।সময় এগিয়ে চলছিল।‘ফোনিক আড্ডা’ বাড়ছিল।নয়নতারা আমাকে জাঞ্ছিল।আমি বুঝেছিলাম-নয়নতারাকে।আর একদিন হঠাৎ ব্লেছিল-‘আমি তোমাকে দেখব।কাছ থেকে।যাচ্ছি।…আর তিন ঘন্টার মধ্যে তোমার বাড়ি পৌছে যাব।’
ভিজে চুল রোদ লাগানোর মতো করে বসেছিল নয়নতারা।চুল খুলে বসেছিল।চুলে ‘জলের কণা’।পাশে বসে মা শাক বাছছিল।আমাদের খেতের শাক।
‘আচ্ছা মা,জোনাক কে এত পড়াশোনা ক্রালেন।এম এ পাশ ক্রালেন।অন্য কিছু ভাবলেন না কেন?’
‘সে নাকি মাঠ থেকে দূরে থাকতে পারে না…আসলে কথাটা কী জান-সে আমার থেকে দূরে থাকতে পারে না।‘বলেই মা চলে গিয়েছিলেন।শাক ধোয়ার জন্য চাপাকলের কাছে পৌছে জ্ঞিয়েছিলেন।বাগান থেকে এসে আমি নয়নতারার কাছে বসেছিলাম।
‘জোনাক মায়ের কথাগুলি সত্যি কি?’
হ্যাঁ,মা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না।মাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা বলেই তো চাকরির সন্ধান ক্রিনি-সেটা সত্যি নয়।আমি বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছি শিক্ষার প্রয়োজনে।মাটির গন্ধের মধ্যে আমার মন সুখ অনুভব করে।মাঠের সবুজ,পাখির কোলাহল আমার মনে শান্তি আনে।এই সুখ এই শান্তি কীভাবে ছেড়ে যাই?
‘সত্যিই জোনাক তুমি,তোমরা সুখ সাগরে আছ।…আর আমরা কংক্রিট হয়ে গেছি।কংক্রিটের মধ্যে সুখের সন্ধান ক্রছি।সুখের সন্ধান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।ক্লান্ত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করার সময় একদিন তোমাকে ফোন করেছিলাম । …তারপরে –প্রতিদিন।তোমাকে না দেখেই তোমাকে বুঝতে পেরেছিলাম।…আর একদিন অনুভব ক্রেছিলাম-আমি যে সুখের সন্ধানে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি,সেই সুখ তোমার মধ্যে ,কেবল তোমার মধ্যে রয়েছে।তাই চলে আসলাম…।’
‘কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন,নতুন উপন্যাসের খোঁজে এসেছেন বলে।’
সেটা অজুহাত।…তুমি বলনি কি,আমার উপন্যাসে তোমার নামটা থাকার জন্য আমার প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অনুভব ক্রেছিলে,আর ফোন করেছিলে।ফোন করার জন্য তোমার মনটা তাগিদা দিয়েছিল…।’
‘হ্যাঁ,বলেছিলাম।কেবল নামটা ব্যবহার করার জন্যই নয়।‘বাসবী’র জোনাক চরিত্রটাতে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম।’
‘…আমিও জোনাক,তোমার মধ্যে আমার উপন্যাসের জোনাক কে অনুভব ক্রেছিলাম।সেই অনুভব মিথ্যা নয়।তোমার মধ্যে আমার উপন্যাসের জোনাক।…এখন তুমি আমার জোনাক।‘
তখন মা রান্নাঘ্রে।শাকের গন্ধ নাকে এসে লাগছিল।নিজেকে বাধা দিতে পারিনি।নয়নতারার আরও কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলাম । নয়নার দেহে বিলেতি সাবানের গন্ধ।…নয়নতারার স্বর কাঁপছিল-‘যদি মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে…’
গুয়াহাটি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে স্বপ্ন পাম।আমাদের গ্রাম স্বপ্ন পাম।আমাদের গ্রামে এখনও কৃ্ত্রিমতার আঁচর লাগে নি।পাহাড় প্রকৃ্তির দান ঝর্ণা,বিল,বিলের পার ভরে থাকা পাখি,রঙ বদলে যাওয়া মাঠঘাট…।…আর কী চাই আমাদের-দিসপুরে আমাদেরও একজন প্রতিনিধি রয়েছে।প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নির্বাচনের সময়ে।বিদ্যুতের আলো,বিশুদ্ধ জল দেবার প্রতিশ্রুতি । আমরা বলেছিলাম –চাইনা।এই যে বিদ্যুতের আলো চাইনা ব্লেছিলাম,সেইজন্যই বোধহয় আমাদের গ্রামের মানুষগুলির মন সব সময় আলোতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে।–এই যে বিশুদ্ধ জল চাইনা বলেছিলাম ,সেইজন্যই বোধহয় আমাদের গ্রামের প্রত্যেকের মন বিশুদ্ধ।
‘তোমার গ্রামের মানুষগুলির মন এত বিশুদ্ধ,সেইজন্য এখানে থেকে যেতে ইচ্ছা করে।’নয়নতারা বলেছিল।
তখন বিকেল হয়ে আসছিল।মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বিলের পারে পৌছে গিয়েছিলাম।বিলের পারে বসেছিলাম।গায়ে গা লাগিয়ে।এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয়ে ঝরণা বয়ে যাবার মতো করে।
‘জোনাক তুমি যখন আমাকে দেখনি,তখন আমাকে দেখার কৌ্তূহল ছিল কি?’
‘ছিল।’
‘…আর এখন?’
‘আপনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।বেড়ে চলেছে।প্রথম দিন,প্রথমবার দেখার সময় আপনাকে অপরিচিত বলে মনে হয়নি।আমার অতি কাছের বলে মনে হচ্ছিল।এত কাছের,আপনি আমার চেয়ে বয়সে সম্মানে বড় বলে জেনেও দিদি বলে ডাকতে পারিনি।নয়নতারা বলতাম।…আপনি একদিন আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাবেন তা আমি ভাবতেই পারিনা।…কিন্তু যাবেন না বলে তো কোনো কথা নেই…।’
হ্যাঁ,না যাবার কোনো যুক্তি নেই।অজুহাত নেই।…একদিন নয়,আমি আগামীকাল যাব।অনেকদিন হল।আমাকে নিয়ে যাবার জন্য কাল অচ্যুত আসবে…।’
‘কোন অচ্যুত?’
আমি গুরুত্ব দেওয়া একজন মানুষ।মানুষটার ওপরে আমার অধিকার আছে।‘
‘সামাজিক অধিকার…মানুষটার সঙ্গে আপনার বিয়ে হবে।’
নয়নতারা হাসছিল।কিছুই বলছিল না।আমার কপালে দুই ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলেছিল-‘একদিন সময় আসবে।তখন জানাব।’
পরের দিন অচ্যুত নামের মানুষটা এসেছিল।…রেল চলেছিল।নয়নতারা বলেছিল-‘জোনাক,তোমাকে জানাব…।’