পলাশ পরব
শুভজিৎ দত্ত, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##
প্রকৃতির অন্যতম উৎকৃষ্ট উপহার হল মোহময়ী বসন্ত। প্রখর গ্রীষ্মে চাতক যেমন একবিন্দু জলের জন্য অপেক্ষা করে থাকে,তেমনই আমরাও অপেক্ষা করে থাকি ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের। সারাবছরের ব্যর্থতা, গ্লানি, ক্লেশের অবসান ঘটিয়ে আমাদের সামনে বসন্ত উপস্থিত হয় তার রঙের ডালি নিয়ে, নবপল্লবের মতই উন্মোচন করে নবদিগন্তের আশা, আগামীর স্বপ্ন। বসন্তের আগমনের সাথে সাথেই কোথাও শুরু হয়ে যায় রডোডেনড্রনের উৎসব, আবার কোথাও চেরিব্লসম ফেস্টিভ্যাল, আবার এই দক্ষিণবঙ্গের শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, অমলতাসের প্রস্ফুটিত শাখা-প্রশাখাও জানান দেয় তার আগমনের। ‘রাঢ়’বাংলায় শুরু পলাশ উৎসব। ‘রাঢ়’ বাংলা এমনিতেই আমার খুব প্রিয় জায়গা। সময় সুযোগ পেলেই ছুটে চলে যাই পুরুলিয়া-বাঁকুড়া। আর বসন্তে “লালপাহাড়ীর দেশে যা, রাঙ্গামাটির দেশে যা” এই গানের মতই এই এলাকার রূপের বাহারের টানে বহু পর্যটক ভিড় জমান, আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তাই প্রতি বছরই নারীরূপী প্রকৃতির এই লাস্যময়ী, মোহময়ী রূপ প্রত্যক্ষ করতে কাটিয়ে আসি নির্জনে, নিভৃতে। কিন্তু এবার যখন জনার্দন মাহাতো দাদার থেকে আমন্ত্রণ এল দোল পূর্ণিমায় অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে ‘পলাশ পরবের’, রোজকার দশটা-সাতটার কংক্রিটের জঙ্গলের জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে এক অকৃত্রিম গ্রাম্য পরিবেশ বারবার হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছিল আমায়। না এই হাতছানিকে উপেক্ষা করতে আমি পারিনি।
কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়, যাওয়ার আগের দিন মনস্থির করায় ট্রেন বা বাসে কোথাও টিকিট নেই, তাই ভেবেছিলাম আগে ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড-এ গিয়ে যদি কিছু ব্যবস্থা হয়। পুরুলিয়া এমনই একটা জায়গা কখনই ফেরায় না আমায়, এবারেও ব্যবস্থা হয়ে গেল, পুরুলিয়া নিবাসী বন্ধু চড়িদার ছৌ মুখোশ শিল্পী ধর্মেন্দ্র সূত্রধর দাদার বদান্যতায় ড্রাইভারের কেবিনে জায়গা ঠিক হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে পিচ ঢালা রাস্তায় বাস আমি সহ সবাইকেই নিয়ে এগিয়ে চলল মহুয়ার দেশে। সারারাত ড্রাইভারের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে কখন যে সকাল হয়ে গেল টেরই পেলাম না। দীর্ঘ বাসজার্নির পর অবশেষে পৌঁছে গেলাম নিজের গন্তব্যস্থল ‘আরণ্যক লজে’। দোলের এই তিনদিন এটাই আমার আস্তানা। বিকেল হতেই ছৌ শিল্পী ‘গম্ভীর সিং মুড়া’ মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমেই শুরু হল ‘পলাশ পরবে’র পঞ্চম বর্ষের অনুষ্ঠানের সূচনা। এরপর দর্শকাসনে বসে একে একে আস্বাদন করলাম রাঢ় বাংলার ঝুমুর ও টুসু গান যার জন্য বারবার ছুটে আসা। লালমোহন মাহাতো ও সম্প্রদায়ের ঝুমুর গান, এবং দিলীপ মাহাতো ও সম্প্রদায়ের করম নাচ ও টুসু গানের সময় মনে হচ্ছিল আমিও পা মেলাই এই গানের ছন্দে।
রাত নামতেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঠান্ডা হিমেল বাতাসে একটু কাঁপুনি ধরলেও বাড়ুয়াজারা ও ভুঁইঘোরা আদিবাসী নৃত্য দলের সাঁওতালি নৃত্যের ছন্দময়তা মনের উষ্ণতা কে জাগিয়ে রাখল। ধামসা-মাদল-কেন্দরী সহযোগে ন্যাড়া পোড়াকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের এই নাচ সম্পূর্ণ অন্য জগতে নিয়ে গেছিল আমায়। বসন্তের এই সময়েই হয় আদিবাসীদের বাহা পরব। ‘বাহা’ শব্দের অর্থ ‘ফুল’। বসন্তঋতুর আগমনে শীতের রুক্ষতা পেরিয়ে প্রকৃতি যখন রূপলাবণ্যে ভরে ওঠে, যখন সে সেজে ওঠে ফুলে ফুলে, যখন হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় মনমাতানো গন্ধ, আকাশে উড়ে বেড়ায় রঙবেরঙের পাখি তখনই ফাগুন হাওয়াই মেতে ওঠে এদেশের ভূমিপুত্র আদিবাসী সাঁওতালগণ। অনেকদিনের ইচ্ছে কোনও এক পূর্ণিমা রাতে কোনো আদিবাসী গ্রামে বসে এই পরব স্বচক্ষে দেখার। কেন্দরীর সুরের মূর্ছনায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার। আজ যেন সেই ইচ্ছে কিছুটা হলেও পূরণ হল।
আজ দোল পূর্ণিমার দিন। আজ রাঙিয়ে দেওয়ার দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি কেউ হলুদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কেউ হলুদ শাড়িতে সেজে উঠেছে। আবার কারও গলায়, কারও বা খোঁপায় পলাশফুলের মালা। যেন ভিনসারে উঠেই সবাই আব্দার করেছে –
“হলুদ গাঁদার ফুল
রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে এনে দে
নইলে বাঁধবোনা বাঁধবোনা চুল”।
পুরো পরিবেশটাই এক অন্যরূপ নিয়েছে। সবাই যেন আজকের এই দিবসের প্রতীক্ষাতেই ছিল। আবারও ‘গম্ভীর সিং মুড়া’ মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমেই শুরু আমাদের দোল উৎসব। একদিকে বসন্তের রঙে যেমন প্রকৃতি রঙিন হয়ে উঠেছে তেমনি আমরাও চেনা-অচেনার গন্ডির বাইরে আবিরের রঙে একে অপরকে রাঙিয়ে দিতে লাগলাম। অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকদের নিজস্ব নাচ, গান, আবৃত্তির সাথে সাথেই এই উন্মুক্ত প্রকৃতির আকাশ বাতাস যেন ভরে উঠছিল রঙ-বেরঙের আবিরে। এরপরেও উপস্থাপিত হতে লাগল আড়ষা-কদমপুরের শিশু শিল্পীদের এবং কলকাতার ললিত কলা একাডেমির ছাত্র ছাত্রীদের এক অসাধারণ রবীন্দ্রনৃত্য। ঘন্টাখানেক ধরে চলা এই শিল্পীদের নৃত্যানুষ্ঠান সবাইকে তাদের নাচের ছন্দে এতটাই মোহিত করে দিয়েছিল যে বোঝা যাচ্ছিল না আমরা শান্তিনিকেতন থেকে এতদূরে পুরুলিয়ার নিজস্ব বসন্ত উৎসবে উপস্থিত আছি। আর সবশেষে ছিল শ্রদ্ধেয় কিরিটি মাহাতো এবং সম্প্রদায়ের ঝুমুর গান। যে মানুষটার গান পুরুলিয়ার প্রতিটা মানুষের হৃদয় জয় করেছে, আজ সামনাসামনি ওঁকে শোনার সৌভাগ্য হল। আবিরের রঙিন বাতাসের স্পর্শে ঝুমুরের বোলে স্থানীয় মানুষগুলোর সাথে আমিও পায়ে পা মেলালাম।
দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে এবার স্থানীয় ধর্মেন্দ্র দাদার বাইক নিয়ে আমরা তিন বন্ধু পলাশের অভিযানে বেরোলাম। আরণ্যক লজে আসার পথের চারপাশটাই ছিল ছায়া সুবিনীড় পলাশের সারি। ইচ্ছে ছিল কোনও এক পাহাড়চূড়ায় বসে আজকের সূর্যাস্তটা উপভোগ করব। যখন অস্তগামী সূর্যের রাঙা আলোয় লাল পাহাড়ির উপত্যকাগুলো আরও রহস্যময়ী হয়ে উঠবে। আর আমি মনে মনে গেয়ে উঠব-
“রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও
যাও গো এবার যাবার আগে–
তোমার আপন রাগে,
তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে,
আমার সকল কর্মে লাগে।”
তবে অযোধ্যা পাহাড়ে পর্যটকদের অতিরিক্ত ভিড় থাকার দরুন একটু নির্জন এলাকাই বেছে নিলাম যেখানে নির্জনে বসে আমার আমিত্বকে উপভোগ করা যাবে। বিকেল হতেই পলাশ রঙা রঙীন সূর্যটা পাহাড়ের বুকে অস্ত যেতে শুরু করলো, কিন্তু জেগে উঠতে শুরু করলো দোল পূর্নিমার চাঁদ।
যখন লজের দিকে ফিরতে লাগলাম বসন্তের সন্ধ্যের সেই রূপবতী চাঁদ তার ভরা নরম জ্যোৎস্নায় সমগ্র পরিবেশকে প্লাবিত করে দিলো। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মনে মনে গেয়ে উঠলাম
‘আজ ফাগুনী পূর্ণিমা রাতে চল পলাইয়া যাই’।
এদিকে পলাশ পরবের সন্ধ্যানুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। দিনের বেলার রঙীন রেশ নরম আলোয় স্নিগ্ধ হয়ে মনে হলো আবারও কোনো লোক সংস্কৃতির কল্পনাময় রাজ্যে প্রবেশ করতে চলেছি। আজ শুরুতেই ছিল ওস্তাদ দুর্যোধন মাহাতো এবং ওনার টিমের ছৌ নাচ। পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়ার দেশের এই নাচ এর আগে মাত্র একবারই চড়িদা উৎসবেই দেখার সুযোগ হয়েছিল। জোৎস্নালোকিত এই পূর্ণিমার সন্ধ্যায় পলাশ পরবের মুখ্য আকর্ষণই ছিল এই ছৌ-নাচ। সমগ্র গ্রামবাসীদের সাথে একসাথে এই উৎসব দেখার অনুভুতিটাই অন্যরকম ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বৃন্দাবনে বৃষাসুর বধ এবং ভীম হস্তে কীচক বধ এই দুই ছৌ নাচের এই পালার পর এবার ছিল পুতুল নাচের পালা। পরিবেশনায় ছিল স্থানীয় যুবক উত্তম মাহাতো। সবশেষে ছিল এই এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘নাচনী নাচ’। পরিবেশনায় কেশবতী মুন্ডা এবং বাসুদেব মুন্ডা। এই এলাকায় এই নাচ জনপ্রিয় হলেও তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত সমাজ এখনও নাচনী শিল্পীদের যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি।
সত্যি বলতে ‘পলাশ পরব’ অনুষ্ঠানটি এত অভূতপূর্ব, মনোগ্রাহী হয়েছিল যে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা জনার্দন মাহাতোকে ধন্যবাদ না জানিয়ে থাকতে পারিনি। পলাশ পরবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন -আয়োজনের আড়ম্বরহীন প্রকৃতির কোলে বসন্তকে উপভোগ করতে, তার আসল রসাস্বাদন করার জন্যই এই উৎসবের আয়োজন। সাহিত্য-সংস্কৃতি-প্রকৃতিকে একসুতোয় গাঁথতে চেয়েছিলেন ওরা। এছাড়াও পুরুলিয়ার প্রকৃত সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সাথে সাথে পরিবেশ সচেতনতাও এই অনুষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। অবশ্যই এদিক থেকে ওনাদের উদ্দেশ্য সর্বতোভাবেই স্বার্থক, যেখানে এলে মনে বেঁজে ওঠে অনুপম নাথের সেই সুর:
“পলাশ রঙে ভেজাবি তুই ঠোঁট
আকাশ অরণ্যে একটাই ঝোঁক
অযোধ্যা পাহাড়ে পলাশ পরব।”
Darun darun.
খুব সুন্দর লেখা ও পরিবেশনা… স্মৃতি গুলো আবার উস্কে উঠলো..