প্রকৃতি পাঠ
বিজয় কুমার মুখোপাধ্যায়, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##
আজ যে আমরা বিজ্ঞানের এত সব নিত্য নতুন আবিস্কার দেখছি তা সব হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া নয়। হতে পারে আবিস্কারগুলি আকস্মিক – কিন্তু তার পিছনে দীর্ঘদীনের প্রচেষ্টার ছাপ রয়েছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এই আবিস্কারগুলোর অনেক কিছুই যেন প্রকৃতি থেকে বেমালুম নকল করা। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় ! তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। জর্জ ডি. মেস্ত্রাল, বাড়ি সুইজারল্যান্ড – পেশায় এঞ্জিনিয়ার। শখ বলতে কুকুর পোষা। তুলতুলে পশম ভর্তি কুকুর – গায়ে হাত বোলানোর অনুভূতিই আলাদা। কিন্তু সমস্যা একটাই কুকুর বাঁধন ছাড়া হলেই ঝোপ-ঝাড়ে ঢুকে অবস্থা একাকার করে আনে। সারা গায়ে কাঁটাফল মেখে হাজির। তারপর একটা একটা করে সেই কাঁটা ছাড়াতে গিয়ে প্রাণন্তকর অবস্থা। হঠাৎ মেস্ত্রালের মাথায় এক বুদ্ধি এল। তিনি ভাবলেন দুটো ফিতে জোড়ার কাজে যদি এই কাঁটা আর লোমের ঝামেলাটাকে কাজে লাগানো হয় তবে কেমন হয়! আটবছর দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সফল হলেন মেস্ত্রাল, – আবিস্কৃত হল ‘ভেলক্রো স্ট্র্যাপ’। এখন তো এই ভেলক্রো স্ট্র্যাপ এর ব্যবহার জুতোর ফিতেয়, ঘড়ির বেল্টে, মানিব্যাগে কিংবা ব্লাডপ্রেসার মাপার স্ট্র্যাপ সহ বিভিন্ন জায়গায়। কুকুর আর কাঁটার এমন বিপজ্জনক সংযোগ না ঘটলে কি জানি কবে পেতাম আমাদের এই ভেলক্রো স্ট্র্যাপ।
৩১শে মার্চ, ১৮৮৯ সালে সম্পুর্ণ হয়েছিল প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। কাজটা সেই সময় যথেষ্ট কষ্ট সাধ্য ছিল। মূলত সমস্যা টাওয়ারটিকে ঠিকঠাক মাটির উপর দাড় করান যাতে প্রচণ্ড প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও সেটি মুখ থুবড়ে না পড়ে। মানুষের ঊরু আর কোমরের হাড়ের সংযোগের কাঠামো দেখেই ইঞ্জিনিয়ার ‘গুস্তাভ আইফেল’ বানালেন টাওয়ারের নক্সা। এও-তো রীতিমত প্রকৃতির কাছ থেকে কপি করা।
এমন আরও কত সব বিষ্ময়কর তথ্য আছে। শোনা যায় বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন নাকি গাছ থেকে আপেল পড়া দেখে মহাকর্ষের সূত্র আবিস্কার করেছিলেন। জানি না! হতে পারে কাকতালীয়। তবে তারও পশ্চাতে সেই প্রকৃতিরই অদৃশ্য ছায়া। আজ এই যে গতির দিনে দূরকে কাছে করার অন্যতম মাধ্যম ‘বিমান’ সেও তো নাকি পাখির ডানা নাড়িয়ে ওড়ার ভাবনা থেকেই তৈরি। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এমন আজগুবি চিন্তা করেছিলেন তাই আজ আমরা ………
১৯ বছর আগের (১১.০৯.২০০১) সেই দিনটার কথা বিশ্ববাসীর নিশ্চয় আজও স্মরণে আছে। বিমান হানায় গুড়িয়ে গেল আমেরিকার গগন চুম্বী দুই অট্রালিকা – ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’। কিন্তু আমরা জানলে অবাক হয়ে যাব যে ‘ কয়েক সেন্টিমিটার পুরু নিরেট মাকড়শার জালের কাঠিন্য’ আস্ত একটা বোয়িং বিমানের গতিকেও থামিয়ে দিতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা এখন মাকড়শার জালের উপাদান, হরিণের শিং এর কাঠিন্যতার রহস্য, শামুকের খোলার গঠন বৈচিত্র কে কাজে লাগিয়ে – মজবুত হেলমেট থেকে শুরু করে বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাঠামো পর্যন্ত তৈরি করছে।
আমাদের হাল আমলের সেন্সর প্রযুক্তি – তার তো প্রতিটি ছত্রে ছত্রেই ‘প্রকৃতি পাঠ’। বাদুর নাকি ‘কান’ দিয়ে দেখে। বোঝ অবস্থা! প্রতিফলিত শব্দোত্তর শব্দের কম্পনের ধরণ বুঝে সে গতিপথ ঠিক করে নেয়। আর সেই পদ্ধতির অনুকরনেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসেছে ‘আলট্রা সনোগ্রাফি’। আবার কীটপতঙ্গের পুঞ্জাক্ষি একটি প্রতিবিম্বকে অসংখ্য ‘অণু-প্রতিবিম্বে’ ভেঙে ফেলে। রোবটের চোখ হিসাবে যে অপটিক্যাল সেন্সর ব্যাবহার করা হয়, তা মূলত ইলেক্ট্রনিক মাল্টিডিটেক্টর এর উপর নির্ভরশীল। এই মাল্টিডিটেক্টরে কীটপতঙ্গের পুঞ্জাক্ষির নীতিই অনুসরণ করা হয়।
যাই হোক প্রকৃতি পাঠ, অনুসন্ধানী চোখে প্রকৃতিকে দেখা – এই একবিংশ শতকে বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। পিঁপড়ে তার ওজনের চেয়ে ১০ গুন বেশী ওজন বইতে পারে, জলের তলায় ডলফিন প্রায় ঘণ্টায় ১০০ মাইল বেগে ছুটে চলে। পশুপাখিদের ভাব বিনিময়ের ভাষা অর্থাৎ ‘সিগন্যালিং’ আবার ডিমের খোলার ‘প্যাকিং’, আপেলের পাতলা খোসা, ডাবের পুরু আস্তরণ যে ভাবে নতুন প্রাণের সম্ভবনাকে আগলে রাখে – তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তার অন্ত নেই। কি ভাবে এই কৌশল করায়ত্ত করে মনুষ্য জাতির উন্নতি সাধনে কাজে লাগানো যায়, তার চিন্তাতেই তাঁরা মগ্ন। সবশেষে বলতে হয় প্রকৃতির কাছ থেকে নকল নয় বা টোকাটুকি নয় – প্রকৃতি যেমন মা, তেমনি প্রেরণাও। মায়ের কাছ থেকে শিখলে তাতে দোষ কোথায় ?