ডাকঘরের ডাকে…
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
গল্পের শুরুটা প্রায় এক যুগ আগে। ২০০৮ সাল, আগের বছরই নন্দীগ্রাম কাণ্ডের ভয়াবহ স্মৃতি বুকে নিয়ে নন্দীগ্রাম খেজুরি সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ধিকিধিকি জ্বলছে বিক্ষোভের আগুন। আমি তখন একটি খবরের চ্যানেলে রাজ্যের দায়িত্বে। একটি মানবাধিকার সংগঠনের ডাকে খেজুরিতে একটি সভায় আমন্ত্রিত হিসেবে গিয়েছি। খেজুরির বিদ্যাপীঠ এলাকায় একটি স্কুলে হচ্ছে সেই সভা। সেখানেই আলাপ স্থানীয় বিদ্বজনেদের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে তাদের কাছেই শুনলাম ভারতের প্রথম ডাক ও তার ঘর নাকি খেজুরিতেই। যদিও তার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছু দেখার নেই। আমি তো চিরকেলে হিউ এন সাং। শুনেই নেচে উঠল মন। গাড়ি তো সঙ্গে ছিলই, সঙ্গী আরও দুজনকে রাজি করাতে সেকেন্ড আটেক সময় লাগল। সভা শেষে ওদের একজনকে নিয়ে আমরা চললাম সেই ডাক ও তার ঘরের দর্শনে।
গিয়ে তো হতবাক, যাওয়ার রাস্তা প্রায় নেই। ঝোপঝাড় পেরিয়ে প্রায় কিছুই না থাকা একটা ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে নিয়ে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন এটাই আমাদের গন্তব্য। প্রাথমিক ভাবে একটু হতাশই হয়েছিলাম। এতটা দুরবস্থা বোধ হয় আশা করিনি। হতোদ্যম হয়ে একটা ইটের পরে কিছুক্ষণ বসে থাকতেই কানে এল বিভিন্ন পাখির ডাক। হতাশা কাটিয়ে দুপাশে চোখ রাখতেই ক্রমশ দানা বাঁধতে লাগল ভাল লাগা। গোটাটাই সবুজে মোড়া, ঘন জঙ্গল, পাখপাখালির কুজন, তার মাঝে দাঁড়িয়ে এক ইতিহাস। বুঝলাম ক্রমশ বাড়ছে ভাললাগা, জায়গাটার গুনেই অন্যদেরও চোখেও মুগ্ধতা। ভাল লেগেছিল। তখন আমার স্মার্ট ফোন হয়নি, সাধারণ ফোনে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম বটে তবে তা আজ আর নেই। রয়ে গিয়েছিল ভাললাগাটা। আর ছিল কাছেই থাকা নদীর ধারে যাওয়ার অপূর্ন ইচ্ছেটা। যে কোনও নদীই আমার প্রেমিকা, তার ডাক উপেক্ষা করা আমার কাছে অসম্ভব। কিন্তু সেবার চলে আসতে হয়েছিল আলো কমে যাওয়ায়, কলকাতা ফেরার তাড়াতে।
এবার চলে আসি কাছাকাছি সময়ে। ঠিক গত বছরের ১লা বৈশাখ। গিন্নী এবং ছেলের আবদার কোথাও একটা যাবই… আমিও রাজি। গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছিলাম মূলত হিজলি যাব বলে। দীঘা যাওয়ার পথে হেড়িয়া থেকে বাঁ দিকে বেঁকে বিদ্যাপীঠ মোড়ে আসতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই স্মৃতি। ঠিক করলাম এবারে আবার যাব ওদিকে, ইতিহাসের পাশাপাশি দেখা করে আসব আমার না দেখা প্রেমিকা নদীর সঙ্গেও। হিজলির গল্প তো আগেই বলেছি, এবারে বলি খেজুরি অভিযানের কথা। হিজলি থেকে পরদিন ফেরার পথে বিদ্যাপীঠ থেকে সোজা এগোলাম গাড়ি নিয়ে। আগে এলেও অনেকদিন হয়ে গিয়েছে, ভাবলাম কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। ও মা, প্রথম তিনজনকে ডাকঘরের কথা জিজ্ঞাসা করতে তার হদিশ দিতেই পারলেন না। শেষে এক বৃদ্ধ আমায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। বুঝলাম নতুন প্রজন্ম স্থানীয় ইতিহাস, গর্ব নিয়ে কতটা উদাসীন। বটতলা মোড় পেরিয়ে সোজা এগোতেই খানিক পরে লোকালয় শেষ।
সামনেই দেখি বাঁদিকে একটা বড় ফ্লাড শেল্টার তৈরি হয়েছে। সামনেই দুটি বড় মূর্তি, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায়ের। এদের মূর্তি হঠাৎ এই নির্জনে কেন? সেটা জানতে গেলে খেজুরির সামান্য ইতিহাস না জানলেই নয়। ভয় পাবেন না বেড়ানোর লেখায় বেশি ইতিহাস বা সাহিত্য আমারও খুব পছন্দ নয়। ১৬৭২ সালের পর থেকে অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি পর্তুগিজদের ব্যবসার বড় ঘাঁটি হিসাবে গড়ে ওঠে। ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় এই খেজুরি বন্দর হয়েই সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। পরে ১৮৪২ ও ১৮৪৫ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুরও এই বন্দর দিয়েই বিদেশযাত্রা করেছিলেন। তাই খেজুরিতে রয়েছে তাদের স্মৃতি ফলক।
এখান থেকে একটু এগোলেই সেই ডাকঘর থাকার কথা, কিন্তু আমার দেখা আগের ছবির সঙ্গে মিলছে না কিছুই। খানিকটা এগোতেই দেখি একটা পার্ক, তার পরে বন দফতরের অফিস। সেখানেই হানা দিলাম, ডাকঘরে যেতে চাই শুনে বললেন এখন বন্ধ পরে আসুন। কি মুশকিল… পরে আবার কখন যাব? সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কলকাতা থেকে এসেছি বলতেই বরফ গলল। একজন বললেন আমাদের অফিসের মধ্যে দিয়ে আসুন। সেখান দিয়ে খানিটা এগোতেই আমার সামনে পুরানো সেই দিনের কথা। তবে এবারে অনেক পরিচ্ছন্ন চেহারায়। সেই ঝোপঝাড় নেই, সাফ সুতরো করে রেলিং দেওয়া হয়েছে ডাকঘরটির ধ্বংসাবশেষের।
আমার ছেলের কৌতুহলের খাতিরেই খুলে বসতে হল ইতিহাস। কি কেন কিভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে সে কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। ব্যবসা বানিজ্যের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের সঙ্গে খবর আদান প্রদানের জন্য দেশের প্রথম ডাকঘর এখানেই তৈরি হয। ১৮৫০ সালের কাছাকাছি সময়ে দেশের প্রথম ডাকঘরের পাশাপাশি এখান থেকেই ভারতীয় টেলিগ্রাফ ব্যবস্থারও শুরু।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘ইম্পিরিয়াল গেজেট অফ ইন্ডিয়া থেকে জানা যায, ভারতের প্রথম তার যোগাযোগ ব্যবস্থাও শুরু হয়েছিল এই ডাকঘর থেকে। ১৮৫১ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডঃ ডব্লু বি ওসাগনেসে খেজুরি ও কলকাতার মধ্যে তার যোগাযোগ চালু করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পান। এর পরের বছরই চালু হয দেশের সর্বপ্রথম তার যোগাযোগ ব্যবস্থা-খেজুরি থেকে কলকাতা ভায়া ডাযমন্ডহারবার, বিষ্ণু্পুর, মায়াপুর, কুঁকরাহাটি। ৮২ মাইল লম্বা এই তার যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রথমে অবশ্য চালু হয় খেজুরি থেকে কুঁকরাহাটি পর্যন্ত। ডঃ ওসাগনেসের উদ্ভাবিত টেলিগ্রাফ সিমোফোর যন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে বার্তা পাঠানো হত। পরে চালু হয় মর্সকোড পদ্ধতি। এই ব্যবস্থা চালু হওযার দু-তিন বছর পরই বিধংসী এক সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যান তৎকালীন পোস্টমাস্টার বাটেলবে, তাঁর স্ত্রী মেরি ও পুত্র ইডজিন। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় খেজুরির এই গর্ব। এখন এই ঐতিহাসিক চারতলা ডাকঘরটির ভেঙেচুরে যাওয়া সিড়ি ঘরটি ছাড়া আর প্রায় কিছু অবশিষ্ট নেই।
বর্তমানে এলাকাটি বনদফতরের হাতে। তারাই সাজিয়ে তুলেছেন এলাকা, তৈরি হয়েছে পার্কও। ব্যাপারটি ভাল হয়েছে না মন্দ সেটা নিয়ে এখনও সংশয়ে আমি। আগের বার এসে এতটাই ঝোপঝাড় ছিল ভয়ে কাছে যেতে পারিনি। এখন অনেকটাই পরিচ্ছন্ন, তবে আশেপাশে গাছ কিন্তু অনেক কমে গিয়েছে। পার্ক হওয়াতে স্বাভাবিক ভাবেই সেই নির্জনতা কমে যাবে বলেই আশঙ্কা। রয়েছে তালা বন্ধ গেটও। এমনকি ঢোকার সময়ও নিয়ন্ত্রিত, সকালে বা বিকেলে ছাড়া ওখানে ঢোকাও মুশকিল। ছুটির দিনে কেউ অসময়ে এলে বনকর্মীদেরও পাবেন না।
তবে এ সব দোলাচল কাটিয়ে বলা যায় এখনও জায়গাটি বেশ নির্জন, সুন্দর। আমার স্ত্রী ছেলেরও দেখলাম ভালই লেগেছে। এবার চলা যাক নদীর পানে। গাড়ি বন দফতরের অফিসের সামনে রেখেই এগোলাম। ওরাই দেখিয়ে দিলেন রাস্তা সামনে, মিনিট সাতেক আটেক গেলেই নদী। নদীর ধারটি এখনও কাঙ্ক্ষিত নির্জনতা ধরে রেখেছে। আর কিছুটা গিয়েই গঙ্গা বা হুগলী নদী মিশেছে বঙ্গপোসাগরের সঙ্গে। তাই মোহনার কাছাকাছি এসে গঙ্গাও প্রায় সাগরের সমতুল। এপার ওপার দেখা যায় না।
সবুজ ঘাসের বুকে জোয়ারের জল থৈ থৈ। এদিক ওদিক পড়ে থাকা নৌকা। ঝাউ বনের ইতস্তত বিস্তার। সেই সঙ্গে হু হু হাওয়া। সব মিলিয়ে মন্দ লাগছিল না। মনে হচ্ছিল এখানেই কাটিয়ে দিই বেশ কিছুটা সময়। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। মনে অদ্ভুত প্রশান্তি এলেও পেটে শুরু হয়েছে অশান্তি। দুপুর গড়িয়ে যেতে বসেছে, এবার একটু সেবা না দিলেই নয়। বাকি দুজনেরও একই দশা। অগত্যা ফেরার পালা।
কাছাকাছি কিন্তু খুব ভাল খাওয়ার হোটেল পাবেন না। রাস্তা ভাল, কিন্তু ভাল হোটেল পেতে হলে হেড়িয়াতে এসে বা তার পরে হাইওয়েতে উঠে। বাসে যেতে পারেন। খেজুরির বাস তো আছেই, বোগা বা হিজলির বাস ধরেও বিদ্যাপীঠে নেমে যাওয়া যায় এখানে। গাড়িতে বা বাইকে গেলেও হেড়িয়া বিদ্যাপীঠ হয়ে যাওয়াই সুবিধা। একদিনেই ঘুরে আসা যায়। হিজলি যেতে চাইলেও ভোর ভোর বেরলে দুটোই সম্ভব। সেক্ষেত্রে অবশ্য নিজস্ব বাহন থাকলে ভাল হয়। থাকার জায়গা হিজলিতে কয়েকটা থাকলেও খেজুরির দিকে আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে হিজলির থাকার জায়গাও তেমন ভাল কিছু নয়।
বাহ্ একেবারে আনকোরা ইতিহাস জনলাম আর মানস-ভ্রমণ ও উপভোগ করলাম।
হিজলি,রসুলপুর নদীর মোহনায় অবস্হিত।ওখান থেকে নৌকো করে নদী পেরিয়ে গাড়িতে করে মিনিট কুড়ি দক্ষিণে পোর্তুগিজদের স্হাপিত লাইট হাউস ও কিছু পরে কপালকুন্ডলা মন্দির অবস্হিত।ঐ একই পথ ধরে কাঁথি পোঁছানো যায় খুব সহজে,যেখান থেকে দীঘা,জুনপুট,শঙ্করপুর,তাজপুর ইত্যাদি জায়গায় সহজে যাওয়া যায়।