বিশ্বের বৃহত্তম পিলার বিহীন খিলানাকৃতি হল্‌: বড় ইমামবাড়া

 আবদুস সালাম ##

হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির  সম্মিলিত তীর্থভূমি হলো লখনউ শহর। শহরের মাঝে বরাবর চলে গেছে গোমতী। পূন‍্যশলীলা গঙ্গার শাখা নদী এই গোমতী। অম্লান সব  অমূল্য নিদর্শন রয়েছে গোমতীর পাড় ঘিরে। এখানকার নবাবী আদব কায়দাকে ম্লান করে দিতে পারেনি আধুনিক বিশ্ব। নবাবী আদব কায়দা লখনউ বাসীদের অমূল্য সম্পদ।  এখন ও আকাশে বাতাসে ভেসে আসে নবাবী আদব। সযত্নে লখনউ বাসীগণ  তা বহন করে নিয়ে চলেছে সেই সব অমূল্য সংস্কৃতি যা আধুনিক বিশ্ব এখনও বাহবা না করে থাকতে পারে না। এখানে স্থাপত‍্যের খিলানে খিলানে বহন করে চলেছে নবাবী সব কীর্তি কাহিনী। নবাব আসাফ্উদ্দৌলাহ্ এর সময় লখনৌ শহর খরাগ্রস্হ হয় ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।

নবাব চেয়েছিলেন প্রজারা তার দান গ্রহণ করে হীনমন্যতা নিয়ে না  বেঁচে থাকুক। নিজে  রোজগার করে অন‍্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকুক। তাই তিনি অনেক লোকের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এই কাজে হাত দেন। এবং তৈরি করান বিশ্বের বৃহত্তম পিলার ছাড়া খিলানাকৃতি হল্‌।

১৭২০ সালে তদানীন্তন মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ্ (১৭১৯_১৭৪৮) দিল্লির শাসনকর্তা। মোঘল রাজত্বের  সে সময় লখনৌ তখন অওধ, ঔধ, অবধ বা অযোধ‍্যার শাসনক্ষেত্রের অন্তর্গত ছিল।  ১৭৩২সালে পারস‍্যের খোরাসানের মোহাম্মদ আমির সাদাত খান তখন মোঘল সৈনদলে নিযুক্ত ছিলেন।তাকেই অযোধ্যার নবাব নিযুক্ত করেন। পাল্টে যায় ফৈজাবাদের ঢোল নলচে।পরে আসাফ্উদ্দৌলাহ্ লখনৌ এর নতুন রূপ দেন। আজ ও সারা বিশ্বের লোকের কাছে তা বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য স্বর্গ রাজ্য।

এখানের রাস্তায় ধূলো জমা হয়না। আর এখানে কোনো সিগন্যাল ব‍্যবস্থা নেই। বিশাল জ‍্যামে শহরের নাভিশ্বাসও ওঠে না।

        লখনউ শহর থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বড়া ইমামবাড়া।  ১৭৮৪ থেকে ১৭৯১ সালে অযোধ‍্যার নবাব আসাফ্উদ্দৌলাহ্ র আমলে তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম পিলার ছাড়া খিলানাকৃত হল । কর্ম যজ্ঞের সূচনা হয় ১৭৮৪ সালে আর শেষ হয় ১৭৯১  সালে। যার দেওয়ালে দেওয়ালে স্টাকো শৈলীর আস্তরণ। ইরানী স্থপতি খিফায়াতুল্লার তত্ত্বাবধানে  তৈরি হয়  এই চারতলা প্রাসাদ।  খরচ হয়েছিল তখনকার যুগে হাফ মিলিয়ন টাকা। আর এর মাথায় আছে ভুলভুলাইয়া বা গোলকধাঁধা। এখানে আছে ৪৮৯টি দরজা আছে।  লোক মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে নবাব নাকি বেগমদের সাথে লুকোচুরি খেলতে এই ভুলভুলাইয়া তৈরি করিয়ে ছিলেন। কিন্তু না এটা তৈরি করার আসল উদ্দেশ্য ছিল বহিরাগত সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করা। ত্রিমাত্রিক জ‍্যামিতিক স্থাপত্যের এমন নিদর্শন পৃথিবীর কোথাও গেলে পাওয়া যাবে না। এর থেকে অনুমান করা যায়  অষ্টদশ শতকে ভারতের জ‍্যামিতিক ও অঙ্কশাস্ত্র কত উন্নত মানের ছিল। গাইড ছাড়া পথের নিশানা পাওয়া দুষ্কর।

 ভুল ভুলাইয়ার উপর তলা থেকে দেখা যায় গোটা ইমামবাড়ার চত্ত্বরের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ । একটা প্রবাদ বাক্য আমরা হামেশাই শুনি যে দেওয়ালের ও  কান আছেএর প্রমাণ আমরা পাই এখানে এলে, ভুলভুলাইয়ার দেওয়ালে কান পাতলে জানা যায় সত‍্যি দেয়ালের কান আছে। 

 ইমামবাড়ার ডান দিকে  শাহী বাওলী পাঁচ তলা। বাম দিকে আসাফ্উদ্দৌলাহ্ মসজিদ। ইমামবাড়া বেরিয়ে আসার  মুখে রুমি দরওয়াজা বা টার্কিস গেট। ১৭৮৬সালে আসাফ্উদ্দৌলাহ্ ইস্তাম্বুলের দরজার রেপ্লিকা রূপে ৬০ ফুটের এই বিশাল দরওয়াজাটি নির্মাণ করেন। 

রুমি দরওয়াজা পেরিয়ে গেলেই  কাছে  ছোট ইমামবাড়া। ১৮৪২ সালে মহম্মদ আলি শাহ্ এটি নির্মাণ করেন। গোটা  ইমামবাড়ার দেওয়ালে আছে কোরআন শরীফের আয়াত উৎকীর্ণ করা। এটি দেখতে ছোট হলেও অসাধারণ নির্মাণ কৌশল আজও সবার কাছে  বিস্ময়কর।

দুই ইমামবাড়ার মাঝে আছে ক্লক টাওয়ার। ক্লক টাওয়ার এর কাছেই বরাদরি বা পিকচার গ‍্যালারি। হলের দোতলায় অযোধ‍্যার নবাবগণের পূর্ণ দৈর্ঘ্যের মূর্তি বসানো আছে। এখানেই ছিল নবাবগণের গ্রীষ্মাবাস।

 শহর থেকে দূরে (প্রায় আড়াই কিলোমিটার) হার্ডিঞ্জ ব্রিজের  দক্ষিণ পূর্বে রয়েছে সিপাহী বিদ্রোহীদের স্মৃতি বিজড়িত দি রেসিডেন্সি। ১৭৭৪ থেকে ১৮০০ সালের ভিতর এটি তৈরি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক উত্থান পতনের স্বাক্ষী এই রেসিডেন্সি।   স্বাধীনতা আন্দোলনের যুদ্ধে যে সব মহাত্মা প্রাণ হারান তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই শহীদ মিনার।

 অদূরে রাণা প্রতাপ মার্গ। সেখানে আছে শাহানজাফ ইমামবাড়া, এর পশ্চিম দিকে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ এর নির্মিত সিকান্দার ভাগ, বানারসীবাগ।

  উত্তর প্রদেশের পর্যটন উন্নয়ন নিগম চারবাগ স্টেশন থেকে বাসে করে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ২টো পর্যন্ত লখনৌ এর দর্শনীয় স্থান গুলো ঘুরিয়ে দেখায়। এছাড়া ব‍্যক্তিগত উদ্যোগে টাঙাগাড়ি ভাড়া করে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানো যায়। নবাবী সব মুখোরোচক খাবার ওপেন রেস্টুরেন্ট ও হোটেল রেস্টুরেন্ট এর ব‍্যাবস্থা আছে। এখানে তুন্ডে কাবাবি রেঁস্তোরার বিরিয়ানী রান্না স্বাদই আলাদা। এছাড়া মুর্গমুসল্লম, শামি কাবাব, মটন বিরিয়ানী রসনার তৃপ্তি দিতে বদ্ধপরিকর।

থাকার ব‍্যবস্থা একটু বেশি মহার্ঘ্য। অল্প খরচে থাকতে গেলে একটু খোঁজ লাগাতে হবে। টাঙাওয়ালাগণ এর বেশি ভালো খবর দিতে পারেন।

হাওড়া থেকে সরাসরি লখনৌ চারবাগ যায়  কুম্ভ এক্সপ্রেস ও দুন এক্সপ্রেস। কলকাতা থেকে ছাড়ে জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × two =