নীলের নিরালায় একদিন
সুমেধা চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা ##
নীল দ্বীপ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপূঞ্জের একটি অতি ক্ষুদ্র সংযোজন। অনেক সময়ে জলিবয়, হ্যাভলক, ডিগলিপুর এই সব বড় বড় নামের ভিড়ে এই ১৯ বর্গ কি.মি আয়তনের দ্বীপটি প্রায় হারিয়ে যায়। কিন্তু এই দ্বীপে রয়েছে চারটি সৈকত। লক্ষ্মণপুর ১, লক্ষ্মণপুর ২, সীতাপুর এবং ভরতপুর। কোরালের বর্ণাঢ্য জগৎ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মধুরিমা, প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে তৈরি পাথরের সেতু— এই সবই রয়েছে নীলে।
আমাদের দশম বিবাহবার্ষিকী যাপনের প্রায় দশ দিনের ট্রিপে একরাত্রি আমরা ছিলাম নীল আইল্যান্ডে। হ্যাভলকের জেটি থেকে আমাদের সরকারি লঞ্চ ছাড়ল দুপুরবেলা। রোদের তেজ থাকলেও মাল-পত্র গ্যারাজ করে দেড় ঘন্টার যাত্রাপথের প্রায় পুরো সময়টাই কাটল ডেকে। সুনীল জলরাশি পরিবেষ্টিত যাত্রাপথ, হাওয়ায় প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। যখন নীলের জেটিতে পৌঁছলাম তখন দিনের আলো অনেকটাই পড়ে এসেছে। নামামাত্র আমাদের রিসিভ করল পূর্বনির্ধারিত ড্রাইভার সূরজ। বলল ‘তাড়াতাড়ি চলুন। দেরী করলে সূর্যাস্ত মিস করবেন। ‘ গাড়ি ছুটল লক্ষ্মণপুর ১ বীচের দিকে। কাঁচা-পাকা রাস্তা দিয়ে এবং বেশ কিছুটা পথ আবার জঙ্গলাকীর্ণ। নির্জন পথের শেষে বিচ দেখা গেল। সূর্য তখন পাটে নামছেন যেন। সোনালি আভায় দিগন্ত সেজে উঠেছে যেন নববধূ। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সানসেট পয়েন্টে পৌঁছলাম। ইংরেজির ‘এল’ আকৃতিতে বালিয়াড়ি বেঁকে গেছে। শেষপ্রান্তে উন্মুক্ত বিস্তৃত জলধি মাঝে রক্তিম বলয়। মন ভরে অস্তরাগে স্নাত হলাম আমরা। সূরজ পৌঁছে দিল জেটি থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে আমাদের রাতঠিকানা আন্দামান পর্যটনের “হাওয়াবিল নেস্ট রিসর্ট”-এ।
হ্যাভলকের মত প্রচারের আলোয় না থাকায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা সীমিত। এই সৈকতগুলিতে কৃত্রিমতা প্রবেশ করে নি, নির্জনতাও সুলভ। পরদিন ভোরের আলো ফোটার বেশ খানিকক্ষণ আগেই গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম ৫ কি মি দূরে সীতাপুর বিচে সূর্যোদয় দেখতে। পথ শেষ হল সীতাপুর বিচে। পাখির কলতান। হাল্কা আলোর আভা চারিদিকে। বেশ খানিকটা নীচে নামতে হয়। সীতাপুর সৈকতের সামনের দিকটা রকি শোর। কিন্তু দূরের দিকে মিহি বালির বিচ অনেকটা চলে গিয়েছে। ভাটার সময় বলে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়া গেল। জোয়ারের সময়ে পুরো বালিয়াড়ি সমুদ্রের তলায় চলে যায়। দুটি গাছের মাঝে দেখি দোলনা করা, বেশ চওড়া। আমরা ওখানেই বসলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। বালিয়াড়ির পাশে খাড়া পাথরের দেওয়াল বেশ অনেকটা উঁচু হয়ে গেছে। আর জোয়ারের জলের অবিরাম আঘাতে নানারকম৷ আকৃতি ফুটে উঠেছে। অবাক বিস্ময়ে যখন এইসব দেখছি রক্তিম আভা দেখা দিল আকাশে। আবার দোলনায় গিয়ে বসলাম এবং এক অবিস্মরণীয় সূর্যোদয়ের সাক্ষ্মী রইলাম।
স্থানুবৎ আমাদের সম্বিৎ ফিরল সূরজের ডাকে। ‘তাড়াতাড়ি চলুন ভাটা থাকতে থাকতে ন্যাচরাল ব্রিজটা দেখে নেবেন। তারপর হোটেলে ফিরে ব্রেকফাস্ট।’ পৌঁছলাম নীল দ্বীপের সবচেয়ে মনকাড়া জায়গা লক্ষ্মণপুর ২ সৈকতের ‘ন্যাচরাল ব্রিজে’। কত শত বছর ধরে প্রকৃতি নিজের খেয়ালে ধীরে ধীরে তৈরি করেছে এই ব্রীজটি। পাশে গড়ে উঠছে আরও একটি। এরকম প্রাকৃতিক স্থাপত্য পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়।
ভাটা বা লো টাইডের সময়ে সমুদ্রের জল দূরে চলে গেলে, এই ব্রিজের চারপাশে অনেক ধরণের রঙিন প্রবাল, স্টার ফিস, সামুদ্রিক শসা, নানা রঙিন মাছ, লবস্টার, বিভিন্ন রঙের কাঁকড়া দেখা যায়। এখানে সাথে গাইড নেওয়া বান্ছনীয়, না হলে সঠিক জায়গায় সঠিক জলজ প্রাণীটি চেনা যাবে না। যাওয়ার পথেই আমাদের ভাগ্যে জুটে গিয়েছিল এক বাঙালি গাইড। খুব যত্ন সহকারে উনি আমাদের পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা দারুণ সব জলজ প্রাণী দেখালেন। পাথর বেয়ে সমুদ্রের বেশ খানিক ভিতরে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেলেন কত যে মাছ আর প্রবাল সেখানে! মুগ্ধ হলাম। আমরা যখন ফিরছি তখন জল বাড়তে শুরু করেছে, সঠিক সময়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সূরজকে বিশেষ ধন্যবাদ জানালাম।
ওদিকে ব্রেকফাস্টের জন্য তাড়া আসছে রিসর্ট থেকে। উত্তাপাম সহযোগে আহারাদি সম্পন্ন করে আমরা পা বাড়ালাম নীলের শেষ গন্তব্য ভরতপুর বিচের দিকে।
ভরতপুর বিচে স্নান করা এবং জলক্রীড়ার ব্যবস্থা আছে। এখানে আমরা গ্লাসবটম বোট রাইড করেছিলাম। এখানকার জল বেশ স্বচ্ছ। প্রচুর সামুদ্রিক পাখিও চোখে পড়ল। এই বিচে একটি অদ্ভূত জিনিস লক্ষ্য করলাম। মাঝে মাঝে ছায়ার জন্য মাথার ওপর চাঁদোয়া করা, সেখানে ব্যাগ রেখে যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুরে আসতে পারেন, কেউ ছুঁয়েও দেখে না। সূরজের কাছে শুনলাম, সমগ্র আন্দামানেই চুরি ঘটিত অপরাধ কম হয় —- কারণ চারিদিক জলবেষ্টিত হওয়ায় ‘পালাবার পথ’ যে নেই। ভরতপুর বিচের ডানদিকে বেশ কিছুদূর হেঁটে গিয়ে একটি খাঁড়ির মত জায়গায় স্বল্প জলে অসংখ্য বড় শামুক হেঁটে যাচ্ছে দেখলাম। দৃশ্যটি মনে গেঁথে রইল।
এই ভরতপুর বিচে বেশ বড় ডাব খেলাম। শুনলাম ডাব বিক্রি করে এই দ্বীপের বেশ বড় সংখ্যক মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। অগত্যা বেশ কিছু স্মরণীয় মুহুর্ত ক্যামেরাবন্দী করে পা বাড়ালাম রিসর্টের দিকে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের পোর্টব্লেয়ার ফেরার সরকারি ফেরি প্রায় তিনটে নাগাদ। এই ফিরে যাওয়ার মুহুর্তগুলোই খুব বেদনাদায়ক হয়, মন বার বার ফিরে যেতে চায় প্রবাল-রাজ্যে সেই ‘প্রাকৃতিক সেতু'( ন্যাচরাল ব্রিজ)-র পাথর-সাম্রাজ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাণী-জগতে। তাও ফেরা তো অবশম্ভাবী। সূরজ ও ‘হাওয়াবিল’কে বিদায় জানিয়ে জেটির পথে পা বাড়ালাম আমরা, ফেরির ভোঁ-তে বিদায়ের সুর। বিদায় নীল, আবার দেখা হবে।
ছবিঃ সৌমিত্র মৌলিক
অসাধারণ
অপূর্ব। ছবিগুলিও অসাধারণ।