অ্যাডজাস্টমেন্ট

ধ্রুপদ ঘোষ, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগণা ##

পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে কৌশিক। রেলিং এর উপর সামান্য ঝুঁকে দুহাতে ভর দিয়ে সুখ টান টানছে সিগারেটে, হাতও লাগাতে চাইছে না। আহা – এ যে পরম শান্তি। সামনে বিশ্বের বিশাল জলপ্রপাত, কি তার জলধারা – কি তার গর্জন। বুনো বাইসনের পাল ছুটলে যে ধূলোর আবর্ত ঢেকে ফেলে চারণ তৃণভুমি ঠিক তেমনি জলের কণার ধোঁয়া ছেয়ে আছে। বেশ লাগছে তার এই স্মোকিং জোনে এসে। কারণ সে এখন একা।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যার সহ অধ্যাপক পদে চাকরি পেয়ে এ দেশে আসা। বউ সুমিতা আর ছেলে অংশুকে নিয়ে প্রথম বেরোনো। নিউ হেভেনের ভারতীয় কমিউনিটির বালা শ্রীনিবাসন ও তার মারাঠি স্ত্রী জয়া মাথুর তাদের এ সফরের সাথী। ছোট ক্যাবেই সফর সুখের হবে এরকমই আশা করেছিল কৌশিক। কিন্তু তা আদৌও হয় নি। কৌশিক একটু অন্যরকম মানুষ। যখন কম্পিউটারের সামনে বসে তখন যে রকম, যখন রান্নাঘরে তখন অন্যরকম, বিছানায় কিংবা বন্ধুমহলে একদম আলাদা, আর ঘুরতে বেরলে একদমই অন্যধাঁচের। কিছুতেই কথা বলে না কারর সাথে, নিজের মনে ঘোরে, চোখ দিয়ে প্রকৃতিরে যেন গিলে খায় আর ডি. এস. এল. আরে ফোটো তোলে। কৌশিকের এই যে ভিন্ন ভিন্ন রুপ এসবের সাথে সুমিতা বেশ পরিচিত। সুমিতা বেশ বুঝতে পারছে, কৌশিক বিরক্ত হচ্ছে। কারণ যাত্রা শুরু থেকে জয়া কানের কাছে আই লাইনার আনে নি বলে কাঁদুনি গেয়ে যাচ্ছে। সুমিতা আধো বাংলা – হিন্দী – ইংরেজি মিশিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে অনেকবার কিন্তু ফল হয়নি। জয়া থামবার পাত্রী নয়। শুধু কি লাইনার – চিত্রকূটের ট্রিপে কে পা পিছলে গিয়েছিল, কার ধোসায় চুল পাওয়া গিয়েছিল,   শেয়ারাড্ কারের ড্রাইভার টার গোঁফ কেমন ছিল সব – সব সে বলবেই। সুমিতার হয়েছে জ্বালা, সে জানে কৌশিক রেগে যাচ্ছে, সে কি করবে! সে নিজেও কম কথা বলে তার উপর বিদেশে এসে ইংরেজি টা এখনও রপ্ত হয় নি। আর ওরা সবাই ইংরেজিতেই ফটর ফটর করে কেবল, ওই সব ভাষা মিশিয়ে কোন রকমে জবাব দেয় নয়ত কৌশিক সামলে দেয় যখন পারে। সোজাসাপটা সাধারণ মেয়ে, কৌশিককে ভাল রাখাই যেন তার জীবনের একমাত্র কাজ। কিন্তু আজ সে নিরুপায়। ছেলেটাও বাপকে দেখলে ঘ্যান ঘ্যান বেশি করে। কাছ ছাড়া করতে চায় না। খালি বাবার কোলে। নায়াগ্রার সামনে এসেও জয়ার বকবকানি আর সেলফির অত্যাচার, প্রতিটি সেলফিতেই কৌশিকের মুখ বেজার তবু জয়া থামবার নয়। ওদিকে অংশুও বাবাকে ছাড়ছে না। 

একটু দূরের বেঞ্চে জয়া আর সুমিতা। বালাও পাশে বসে হেডফোনে গান শুনছেন। সুমিতা যে কেন হেড ফোন দুটো ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গেল। কৌশিক ছেলেকে কোলে নিয়েই ফটো তুলছে। জয়া কানের কাছে বকে যাচ্ছে হটাৎ মাথায় বুদ্ধি এল, বালা স্মোক করে না তাই সে জয়াকে বলল – এক্সকিউজ মি।

জয়া ওর মুম্বইয়ে ফার্স্ট এফ্যায়ারটা কেন টেকেনি, সেটাই আদ্যপান্ত বলছিল ও যেন হটাৎ ব্রেক কষল,

– what happened

– এক্সকিউজ মি, ek minute, উঠে গেল কৌশিকের কাছে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কৌশিকের বিরক্তি দ্বিগুণ হল আরও, চাঁপা গলা প্রায় দাঁত কিড়মিড় করে বলল – আর যদি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার নাম করেছো।

মনে মনে সুমিতা অভিমানের সুরে বলল – যেন আমি আসতে বলেছি, নিজেই তো তাল তুললো, এখন আমার দোষ। মুখে কিন্তু বলল –

বাবু এবার এসো, পাপাকে সিগারেট খেতে যেতে দাও, come সোনা, come

জয়া উত্তর দিল – where will you get the smoking zone? Lets enjoy the scenic beauty.

দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। আর থেমে থাকতে পারল না কৌশিক। ছেলেকে সুমিতার কোলে দিয়ে উত্তর দিল – ohh really, Don’t worry, I will find my..

বলেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। কথাগুলোর ঝাঁঝ জয়াকে এত ক্ষণে স্পর্শ করেছে, ভ্রু কুঁচকে সুমিতাকে জিজ্ঞাসা করল –

What da fuck, what’s wrong with him?

– kuch nahi, bohot der se smoke nehi giya toh little angry, so what about your first লাভ? বাবু – দুষ্টুমি করে না।

পর পর দুটো সিগারেট শেষ করল কৌশিক। ভাল লাগছে না আর ফিরে যেতে। নায়াগ্রার সামনে দাঁড়িয়ে সে একা, নিজেকে একা অনুভব করতে লাগল। পাঁচ হ্রদের মাঝেই এই জলপ্রপাত, একদিকে কানাডা আর অন্যদিকে আমেরিকা, হঠাৎ তার মাথায় প্রশ্ন এল 

– আচ্ছা এই যে নদী বা ধরো জলপ্রপাত, এরা কি জানে যে এরা দেশ ভাগ করে?

– জানলে হয়ত তারাও পালিয়ে যেত.

চমকে উঠল কৌশিক, এ যে তিস্তার গলা। ঠিক পাশে নীল রঙের পুল ওভার আর ব্ল্যাক জিন্স পরে তিস্তা দাঁড়িয়ে, কৌশিক ফিরল না সেদিকে, আবার সেই স্বর। 

– কি মিস্টার মিত্তির, আজ আমায় মিস করছেন বড়?

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কৌশিক উত্তর দিল – মিস করি কি সাধে, তোমার মত ভ্রমণ সাথী আর কেই বা আছে?

– সত্যি, কত সুন্দর সুন্দর ট্রিপ আমরা করেছি না.

– হুমম, সত্যি we are really compatible.

তিস্তাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছে কৌশিকের, সে জানে এটা কল্পনা, নায়াগ্রার সামনে এ যে মানস দৃশ্যপট – ফিরলেই  তা কেটে যাবে। তাই সে তাকাল না তার বাঁ দিকে তবে শেষ কথাটা কৌশিককে ভাবালো কিছু ক্ষণ। Compatible -হমম তিস্তা সত্যিই compatible তার সাথে। সত্যিই compatible ছিল। তারপর কৌশিক আবার প্রশ্ন করল –

আচ্ছা বলত এই যে নায়াগ্রা এর সামনে বসে আমার ঠিক কি করতে ইচ্ছা করছে?

– কবিতা বলতে, আবার তিস্তার গলা

– কি কবিতা

– আর কত দূরে নিয়ে যাবে হে মোরে সুন্দরী

– exactly!! প্রায় লাফিয়ে উঠল কৌশিক, কিন্তু কেউ নেই, লজ্জা পেল কৌশিক। একে একে সব মনে পড়তে লাগল তার লে, চাকরাতা, লাচুং, অরুনাচল, কোদাইকানাল সব ট্রিপগুলোর কথা। লে তে যাবার পথে সারারাত দুজনে কাটিয়েছিল চায়ের দোকানে, মেয়ে হয়েও কোন অভিযোগ করেনি তিস্তা – হাপুস নয়নে ম্যাগী খেয়ে ছিল দুজনে একই হিন্ডালিয়ামের বাটিতে, রোমাঞ্চ উপলব্ধি করেছিল প্রাণ ভরে যেন গাড়ি খারাপ হয়ে বেশ ভালই হয়েছিল।

তিস্তা একদম অন্যরকম, চটপটে, স্মার্ট, চমক আছে বুদ্ধিদীপত্তায়। ছিমছাম চেহারা -চুল ঘাড় অবধি, কটা চোখ কিন্তু তার চাহনির নেশা অফুরন্ত। JNU  তে সোসিউলজি নিয়ে  একবছরের জুনিয়ার ছিল কৌশিকের। বোলপুরের কৌশিক আর সল্টলেকের মেয়ে তিস্তা, বন্ধুত্ব না প্রেম বোঝা দায়। সেবার মনে আছে  লাচুং এ পূর্ণিমা চাঁদ দেখে কৌশিক শুনতে চেয়েছিল একটা রবীন্দ্র সংগীত। চারিদিকে তুষার ঢাকা পর্বত আর কনকনে শীতল বাতাস। একটা পাথরের উপর বসে তিস্তা দুরের পাইন গাছের মাথা নাড়া দেখছিল। পাশে খাড়া হয়ে কৌশিক দেখছিল রাতের নক্ষত্রখোচিত আকাশের গভীরতা। তিস্তা গাইছিল গান – আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।

ভালুংপং যাওয়ার পথে বাঙালি সহযাত্রীরা যে ভাবে বিরক্ত করেছিল ঠিক আজ যে ভাবে মিসেস শ্রীনিবাসন করছে, কিন্তু সেদিন তিস্তা ছিল পাশে। মুচকি হেসে একটা হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা এলিয়ে ইশারায় প্রকৃতি দেখাছিল আর চোখে চোখে কথা বলছিল এই  ভয়ে যদি সহযোগীরা টের পায় যে তারা বাঙালি। সে এক দিন ছিল কৌশিকের জীবনের, the most adventurous time and all credit goes to তিস্তা। টিকিট বুকিং থেকে লজিং সব তিস্তার নখ দর্পনে। 

– আর আজ!! আরও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের গভীর হতে। পকেট থেকে মোবাইলটা বার করল কৌশিক। whatsapp টা খুলে ডিপি টা দেখল তিস্তার। একটা ফ্যামিলি গ্রুপি। মাথায় ঘোমটা টেনে স্বামী আর ছেলে কোলে happy married life. ভাবল নায়াগ্রার একটা পিক তুলে পাঠিয়ে দেবে, না থাক। গত মাসে কথা হয়েছে, আজ তিন বছর কোথাও বেরোয় নি। স্বামী রাউরকেল্লার স্টিল প্লান্টের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। হানিমুনও পুরীতে। ঘোরার জন্য পাগল ছিল মেয়েটা। আর কতটাই না অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে ওকে। মোবাইল স্ক্রীণে ভেসে উঠল সুমিতা আর তার ছেলের ছবি। রিং টা বেজে চলেছে। সামনে তাকিয়ে কৌশিক। নায়াগ্রার জলধারা ঠিক তেমনি ভাবেই গর্জনরত হয়ে আছড়ে পড়ছে। না এবার ফিরতে হবে কৌশিককে। সিগারেটের শেষ অংশটা ঐ খাপেই ডলে একটা ওয়েস্টবিন খুঁজতে লাগল সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − eleven =