সম্পাদকীয় (নভেম্বর, ২০২০)
প্রাণময় দাসের বাড়ি বিড়া স্টেশন থেকে আরও চার কিলোমিটার ভিতরে। ট্রেনে পাজামা সায়ার দড়ি বিক্রি করতেন প্রাণময়। না, এত ভাল নামে তাকে ডাকার মানুষ বড় একটা নেই, সকলের কাছে তিনি পানু দাস। কোথাও কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানুর রোজগারে দাঁড়ি পড়ে গেল হঠাৎ। ছেলে মেয়ে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছিলেন পানু, ভাগ্যিস একটা রঙ চটা হাড়গিলে সাইকেল ছিল। তাই নিয়ে এখন বারাসতে গিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মাছ বেচেন পানু। সামান্য রোজগার হয় বটে তবে বিড়া থেকে বারাসত, এতটা পথ সাইকেলে যাতায়াত, ঘুরে ঘুরে বেচা কেনা, দিনের শেষে পানুর পা দুটো যেন আর চলতে চায় না। পানুর চেয়ে একটু ভাল বেড়াচাঁপার পদ্ম মণ্ডলের হাল। দমদমে প্ল্যাটফর্মে শাক বেচতেন। ট্রেনেই আসা যাওয়া, দিনের শেষে রোজগারও মন্দ হত না। কিন্তু সে সব এখন ইতিহাস। দুবার বাস পাল্টে চেপে কোনও মতে সপ্তাহে দু-তিন দিন দমদমে বাজারে আসেন বটে, কিন্তু খরচে আর পরিশ্রমে কুলায় না বছর পঁয়ষট্টির পদ্ম পিসির। বেশিদিন আর এভাবে আসতে পারবেন না বলছিলেন তিনি। ঠাকুর নগর থেকে ফুল মালা নিয়ে এসেছিলেন সরলা বিশ্বাসও। “লক্ষ্মী পুজোর দিনে না এলে হয়? এখনই তো দুপয়সা হয়”। সরল বিশ্বাসে কথাগুলো বললেও সরলা অনিশ্চিত, গাড়ি ভাড়া করে আবার কবে ফুল নিয়ে আসবেন কলকাতায়।
টুকরো টুকরো ছবিগুলিই একের পর এক গাঁথতে গাঁথতে মালা হয়ে ওঠে এই মানুষগুলির কষ্টমাখা জীবনের। লোকাল ট্রেন না চললে এই প্রান্তিক মানুষগুলির জীবনে কি অসহায়তা, তা শহরে বসে হাতের কাছে সব পেয়ে যাওয়া আমাদের মত মানুষের বোঝার অসাধ্য। ট্রেন নভেম্বরেও চলবে না শুনে এই ম্লান কষ্টক্লিষ্ট মুখগুলি আরও মলিন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। লোকাল ট্রেনের চলা না চলাটা ওদের জীবনে এখন খাওয়া না খাওয়ার দোলাচলতা। একই হাল বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় সামান্য রোজগেরে অসংখ্য মানুষগুলির।
এরই মাঝে খুশির খবর, চার চাকা গাড়ি বিক্রির হার ব্যপক বেড়েছে। বাইকের বিক্রি তো বেড়েছিলই এখন মানুষ গাড়িও কিনছেন ভালই। মারুতি জানিয়েছে গত বছরে (২০১৯) জুলাই, আগস্ট সেপ্টেম্বরে তাদের যা বিক্রি ছিল এবছরে একই সময়ে সেই বিক্রি বেড়েছে ১৮.৬% । এই সময়ের মধ্যে তিন লক্ষ সত্তর হাজার ছশো উনিশটি গাড়ি তারা বিক্রি করেছে। প্রত্যাশার চেয়ে গাড়ি বিক্রিতে ভাল ফলে পুলকিত টাটা মোটর্স, হুণ্ডাই, মাহিন্দ্রাও। গাড়ির বিক্রির এই জোয়ার দেশের অর্থনীতির জন্য ভাল বার্তা নিঃসন্দেহে। নিন্দুকেরা কিন্তু এর মধ্যে অন্য গন্ধ পাচ্ছেন। এক শ্রেণীর মধ্যবিত্তের হাতে টাকা ছিল, আছেও। কারণ করোনার লকডাউনে সরকারি বেসরকারি অনেক সংস্থাই বেতন ঠিকঠাক দিয়েছে, উল্টে অফিস যাওয়ার খরচ কমেছে। তাই টাকা রয়ে গিয়েছে হাতে। ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখে সরকার নাকি তারই সদ্ব্যবহার করছে। এই সন্দেহ একেবারে অমূলক তা বলা যায় না। এর আগেই সরকারি কর্মীদের এলটিসি দেওয়ার নামে টিভি ফ্রিজ সহ বিলাস বহুল জিনিস কেনার আবশ্যক শর্ত তারা চাপিয়েছিল। ট্রেন বন্ধ থাকলে যাতায়াত ব্যবস্থার বড় অংশই বসে যাওয়া। যারা কিছুদিন আগেও গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কিন্তু কিন্তু করছিলেন এই মরশুমে তারাই গাড়ি কিনতে চেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
সরকার জনদরদি। তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ মানুষের কথা ভেবেই। কিন্তু এই সহজ কথাটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না পানু দাস বা পদ্ম মণ্ডলের। তারা পড়ে আছেন ট্রেন চালুর পিছনে। আচ্ছা এই সব মানুষ যদি দুচার দিন না খেয়ে থাকেন, কিম্বা মরেই যান তাতে এত বিচলিত হওয়ার কি আছে? দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, গাড়ির শোরুমে ভিড় বেড়েছে, ভিড় বেড়েছে বৈদ্যুতিন সামগ্রীর শোরুমগুলিতে। অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিলের ছেলেগুলি নাওয়া খাওয়ার সময় পাচ্ছে না। দেশ যে এগোচ্ছে, এসব জানতেই চায় না প্রান্তিক এই মানুষগুলি।
করোনা কাণ্ডের প্রথম দিকে সাহায্যের জোয়ার এসেছিল, আমপানের পরে সেই জোয়ার ভরা কোটালের চেহারাও নেয়। কিন্তু মাসের পর মাস গিয়েছে, এখন সাহায্যকারীরা নিজেরাই সাহায্যের আশায়। সরলা বিশ্বাসকে দশ টাকার ফুল নেওয়ার সময় যখন বললাম সাহায্য তো প্রচুর পেয়েছো, তা দিয়ে চলছে না? একটু থমকে জানাল, বাড়িতে পাঁচটা পেট, দশ কেজি চাল, দুকেজি ডাল আর কিছু বিস্কুটে ছ’মাস কি চলে দাদা? চলে না বুঝি? তা হবে হয় তো, আসলে আমরা তো হিসেব কষেছি কি কি ভাল মন্দ খাওয়া যায়, ইউটিউব দেখে আজকে জিলাপি, পরদিন বাসন্তি পোলাও, তার পরে চিকেন রোগানজুস… আরও কি কি নতুম রেসিপি ট্রাই করা যায় এসব নিয়েই হিসেব কষেছি। চাল ডালের হিসেবটা আমাদের ঠিক আসে না। পানু দাসকে যখন বলি, বাইকের দাম তো কমে গিয়েছে, অনেক অফারও দিচ্ছে, একটা কিনে নিলেই পার। পানু অবাক মুখে উত্তর দেয় সোনার দাম দুশো টাকা কমলে ভিখারির কি এসে যায় দাদা?
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ