মন্দিরের মালা, মলুটি
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
কেউ বলে না দিলে মনেই হয় না বাংলার বাইরে কোনও গ্রামে এসেছি। চারিদিকে মুখোপাধ্যায়, চক্রবর্তী, বিশ্বাস অথবা সরকারের ছড়াছড়ি। বাংলায় লেখা, বাংলায় কথা, বাংলাতেই অভাগ অভিযোগ, পাওয়া না পাওয়ার গল্প। এদিকে দাঁড়িয়ে আছি ঝাড়খণ্ডের মলুটি গ্রামে। মন্দির গ্রাম হিসেবেই খ্যাতি মলুটির। আসার পথে বড় রাস্তার মোড়ে তোরণেও সেই কথাই লেখা। মলুটিতে পৌছে খুব মনে হচ্ছিল মেদিনীপুরের পাথরা গ্রামের কথা। সেখানেও তো এমনই মন্দির ছড়িয়ে। তবে মলুটিতে মন্দিরের সংখ্যা পাথরার প্রায় দ্বিগুণ, মলুটির মন্দিরে টেরাকোটার কাজও দেখার মত। তাই পাথরা আজও আঁধারে রয়ে গেলেও মলুটি কিন্তু প্রচারের আলো পেয়েছে ইতিমধ্যেই।
চতুর্দশ শতকের মল্লহাটি আজ হয়েছে মলুটি। রামপুরহাট থেকে দুমকা যাওয়ার পথে কমবেশি ১২ কিমি যাওয়ার পর পড়ে সুঁড়িচুয়ার মোড়, সেখান থেকে বাঁ দিকে ৪ কিমি গেলে বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে শক্তিসাধকদের তন্ত্রভূমি দুমকার গুপ্তকাশী মলুটি গ্রাম। এখান থেকে জেলা সদর দুমকার দূরত্ব ৫৫ কিমি। গ্রামের ধার দিয়ে বইছে দুটো নদী— চুমড়ে আর চন্দননালা। বাঙালি প্রধান হলেও মলুটিতে বেশ কয়েক ঘর ওঁরাও-এরও বাস।
সপ্তদশ শতকে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্র প্রিয় বাজপাখি উদ্ধার করে দিয়ে বসন্ত রায় রাজতালুক পান। হয়ে যান বাজ বসন্ত। বীরভূমের কাতিগ্রামের এই মানুষটির বংশধরেরা প্রথমে দামড়া থেকে পরে মলুটিতে আসেন। নানকার বা করমুক্ত রাজ্য মলুটিতে বাজ বসন্তর পরিবারটি চার তরফে ভাগ হয়ে যায়। আর চার তরফের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা থেকে অষ্টাদশ শতক থেকে উনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালে নির্মিত হয় ১০৮টি মন্দির। এই ১০৮টির মধ্যে ৭২টি আজও অক্ষত।
৭২টির ভেতর ৫৭টি চারচালা ঘরানার। বাকিগুলি রেখ দেউল, রাসমঞ্চ, সমতল ছাদ কিংবা একবাংলা। পরপর তিনটি চারচালা স্থাপত্যের শীর্ষে মন্দির মসজিদ গির্জার ধরনে সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরনো এক অন্য ইতিহাস। মন্দির গবেষক বা পর্যটকদের কাছে তাই মলুটি যেন স্বর্গসম।
অনেক মন্দিরেই আরাধ্য হন মূলত শিব। যদিও শাক্ত মন্দিরও কম নয়। অলঙ্করণে কোথাও ফুলপাথর। কোথাও টেরাকোটা। মহিষাসুরমর্দিনীর প্যানেল। রামায়ণ। বকাসুর বোধ। যক্ষ ও যক্ষী। সামাজিক ইতিহাসের ক্রনোলজি। মোঘল যুগ থেকে ব্রিটিশ ক্রমবিকাশের সিরিজ। সমতল ছাদের একটি দুর্গামণ্ডপের ওপরে অর্ধবৃত্তাকার প্যানেলে রাজপরিবারের ছবি। মন্দির গাত্রের পরতে পরতে উঁকি দিচ্ছে ইতিহাস। ইউনেস্কো ইতিমধ্যেই মলুটিকে হেরিটেজ ভিলেজ আখ্যা দিয়েছে। যদিও সংরক্ষণে ত্রুটি রয়ে গেছে বিস্তর। পেশাদারিত্বের অভাব স্পষ্ট।
এই মন্দিররাজির পাশাপাশি মলুটির প্রসিদ্ধি দেবী মৌলিক্ষার জন্য। মৌ অর্থাৎ মাথা, ইক্ষা অর্থাৎ দেখা। মূর্তির গড়নে বজ্রযানী বৌদ্ধমতের প্রভাব। বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রযানীদের আরাধ্যা সিংহবাহিনী দেবী মৌলিক্ষা হিসেবে নামাঙ্কিত হন। অবয়ববিহীন শুধুমাত্র দেবীমস্তক ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ। ল্যাটেরাইট পাথরকে ছেনি দিয়ে কেটে। কথন অনুযায়ী এই মৌলিক্ষা মন্দিরেই সাধক হিসেবে আসেন বামদেব চট্টোপাধ্যায় ওরফে বামাক্ষ্যাপা। যদিও তার আগে মলুটির আত্মীয় ফতেচাঁদের সাহায্যে চার তরফের বিষ্ণু মন্দিরে পুজোর জন্য ফুল তোলার কাজ পান। মলুটির সাধনা শেষ করে তারাপীঠ যাওয়ার আগে তাঁর ত্রিশূল এবং শঙ্খ রেখে যান বামদেব।
রামপুরহাট বা মল্লারপুর দুদিক দিয়েই মলুটি যাওয়া যায়। একটু ঘুরে দুমকা হয়েও এমনকি ম্যাসানজোড় হয়েও মলুটি যাওয়া সম্ভব। রামপুরহাট বা মল্লারপুর থেকে মলুটি আধ ঘন্টার পথ, তাই বিকেলের মধ্যে সহজেই ফিরে আসা যায়। মলুটিতে থাকার ব্যবস্থাও আছে, ঝাড়খণ্ড পর্যটন দপ্তর এবং দুমকা জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দুটি সরকারি বাংলো রয়েছে। আগে থেকে বলে রাখলে খাওয়ার ব্যবস্থাও মন্দিরের পক্ষ থেকে হয়ে যায়।