সুখের খোঁজে

 শিবপ্রসাদ গরাই, বাঁকুড়া ##


                   
প্রত্যেক শনিবারের মতোই অশোক ট্রেনে উঠে বসে পড়ল জানালার ধারে একটি সিঙ্গল সিটে। ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে। মনটা আজ ভালো নেই তার। চুপ করে বসে বাইরের মানুষের কথাবার্তা, ছুটোছুটি ইত্যাদি দেখছিল। কোনকিছুই তাকে ভিতর থেকে শান্তি দিচ্ছিল না, ভিতরে ভিতরে সে ভীষণ একা অনুভব করছিল। ট্রেন মিনিট কুড়ি লেট করে আদ্রা স্টেশন ছেড়ে দিল একটা তীব্র হুইসেলের আওয়াজে তা জানান দিয়ে। আরণ্যক সুপারফাস্ট ট্রেন, ছাড়তে না ছাড়তেই তা দ্রুত স্পিড নিয়ে নিতে শুরু করলো। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অশোক নিজেকে আর কিছুতেই স্থির রাখতে পারছিল না। জানালার পাশ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, চোখেমুখে তা ধাক্কা দিয়ে তার অন্তরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। সে কিছুতেই আর নিজেকে ঐ সিটে ধরে রাখতে পারছিল না। সোজা উঠে দাঁড়াল, তারপর একটু একটু করে এগিয়ে গেল কামরার শেষপ্রান্তে বাথরুমের লাগোয়া যে গেটটা দিয়ে সে উঠে এসেছিল ট্রেনে, সেই গেটের সামনে গিয়ে তার সামনে লাগানো হ্যান্ডেলটা সজোরে টিপে ধরল। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাতাসের প্রবল ঝাঁকুনি সে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে চাইল। তার মনে হতে থাকলো এই ঝাঁকুনি কি আমাকে এক্ষুনি উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না কোন মহাসমুদ্রের কিনারে অথবা লোকচক্ষুর অন্তরালে কোন এক নির্জন বিছানাতে। ভাবতে লাগল আর অন্তরের চোরাস্রোত থেকে একটু একটু করে রক্তবিন্দু অশ্রুবিন্দু রূপে তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়তে লাগল তার জামার কলারে। তার মনে হতে থাকলো এই একটু আগেই সে স্কুলে পড়াতে গিয়ে জীবনের মহামন্ত্র শুনিয়ে এসেছে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের, আর সেই কিনা ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে… ভাবতে থাকে… ভাবতে থাকে… অবাক হয়…
অবাক হয়ে ভাবে… আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে সে মহানন্দে ট্রেনে চেপে স্কুলে এসেছিল চাকরিতে যোগদান করতে। ভেবেছিলো এই চাকরিটাই তার জীবনে সব সুখ এনে দিতে পারবে। এই চাকরিটাই তার সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে, একটা হাই স্কুলের মাস্টারির চাকরি ক’জন বা পায়! যা বেতন অনায়াসে সে নিজের মা-বাবা, দিদি-জামাইবাবু সবাই, সব্বাইকে সে মুঠো মুঠো সুখ দিতে পারবে। আমাদের মত গরিবদের কাছে সুখ মানে তো ভুরি ভুরি অর্থ!
কিন্তু কই ?
তা কি সে এনে দিতে পেরেছে ?
যখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত তখন ভাবত একটা চাকরি পেলে সব, সব সমস্যার সমাধান! তার নিত্যদিনের মা-বাবার ঝগড়া তাকে কোনদিন আর শুনতে হবে না! প্রত্যেকদিন ঘুম থেকে উঠার পর মা বাবার ঐ নিত্যদিনের চিৎকার- এই কটা টাকায় কি আর সংসার চলে?   তারপর…একে অপরকে দোষারোপ … হাতাহাতি তারপর কান্না … কান চাপা দিয়ে সে সহ্য করেছে অনেক, আর নয় …সে ভেবেছিল গরিবদের সুখ টাকায়… মুঠো ভর্তি টাকা আর আচল ভর্তি সুখ দুটোই সমার্থক। সে ভেবেছিল চাকরি পাওয়ার পর শুধু আঁচলে নয়, ঝুড়ি ভরে সুখ নিয়ে আসবে … হাই স্কুলের মাস্টার কম টাকা নাকি?সে মনে মনে বলতো মা একটু সবুর করো মা,তোমার ছেলে তোমাকে সোনার সিংহাসন বানিয়ে দেবে। তুমি একটু কষ্ট করো মা, একটু কষ্ট করো…
কিন্তু কই ?
তা করতে পেরেছে কি?
মাকে সে একটুও সুখ দিতে পারেনি!
পৃথিবীতে কটা ছেলে তার মাকে সুখী করতে পারে! যারা পারে, তারা ভাগ্যবান অতি ভাগ্যবান । সে তাদের মধ্যে থাকতে পারেনি ! …
মা আমাকে ক্ষমা করো!
বাবা তোমাকে ভেবেছিলাম আর বিড়ি খেতে দেবো না , তুমি এরপর সিগারেট খাবে। সাদা স্পেশাল এর প্যাকেট থাকবে তোমার পায়জামার পকেটে, তুমি বার করিয়ে ধরাবে সকলের সামনে; তোমার মুখের ওই পরিতৃপ্তির সাদা ধোঁয়া ক্রমশ কুণ্ডলীকৃত হবে আর আমার মন খুশিতে ভরে উঠবে …
এই ছিল আমার বাসনা । বাবা আমি পারিনি… আমি কিছুই পারিনি…
আমি সুখ দিতে পারিনি তোমায়…
আমি কাউকে সুখী করতে পারিনি …
আমি স্বার্থপর …
আমি শুধু ভেবেছি নিজের কথা …
নিজের কথা …
নিজের কথা…
আমি পারিনি
আমি পারিনি
আমি পারিনি
ভাবতেই ভাবতেই অজান্তেই তার মনে হল যেটা সে আগে পারেনি সেটাই আজ তাকে করে দেখাতে হবে -ট্রেনের হ্যান্ডেল ছেড়ে সোজা লাফিয়ে পড়তে হবে নির্জন মহাসমুদ্রের চিরশান্তির বিছানা চাদরে। তবেই হয়তো শান্তি আসতে পারে গভীর মজ্জায়, মস্তিষ্কের গ্রন্থিতে, শিরা-উপশিরার বিষাক্ত রক্তে…
দরজার গেটের শক্ত লোহার হ্যান্ডেল তাকে আস্তে আস্তে পৌঁছে দিতে পারে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে!
বাতাসের তীব্র ঝাঁকুনি উপেক্ষা করে তৈরি হচ্ছে সে একটু একটু করে… অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে…
সে এখনই হাত ছেড়ে দিতে প্রস্তুত …
সে এবং তার অভীষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান …
ট্রেনের গতি এখন একশো কুড়ি মাইল পার ঘন্টা…
সে মনে মনে বলছে
আমি প্রস্তুত …
হে ঈশ্বর… আমাকে তোমার মহাসমুদ্রের গভীরতম নির্জনতম শান্তির চাদরে আশ্রয় দাও…

এমন সময়…
হঠাৎ পিঠে আলতো ছোঁয়া
ঘুরে পিছনে তাকিয়ে দেখে
একটি ছোট্ট পাঁচ-ছয় বছরের শিশু ,রুক্ষ- শুষ্ক চুল, পরনে একটি ময়লা আধছেঁড়া প্যান্ট। পিছন থেকে তার পায়ের সামনে ঝুঁকে পড়ে সামনে হাত বাড়িয়ে মিনমিন করে বলে- বাবু একটা টাকা দাও না! ঘরে বাবা না খেতে পেয়ে মরছে… আমি গেলে ওরা একটু খেতে পাবে…

… ট্রেনের হান্ডেল ছেড়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অশোক যা পেল সব দিয়ে দিল আর ভাবল- আমার বাবাও আমার জন্য বাড়িতে একইরকমভাবে অপেক্ষা করে আছে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve − 3 =