কৈকেয়ী
বিশ্বজিৎ রায় ##
“রামায়ণ” এর বহুবিধ নারী চরিত্রগুলির মধ্যে যে চরিত্রটি আমায় বিশেষভাবে আলোড়িত করে সেটি হল অযোধ্যার রাজা দশরথের কনিষ্ঠা পত্নী কৈকেয়ী ( কোনও কোনও গ্রন্থে মধ্যমা পত্নী হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। । বাল্মিকী রামায়ণের অযোধ্যাকান্ডে কৈকেয়ীকে কনিষ্ঠা পত্নী এবং অরণ্যকান্ডে মধ্যমা পত্নী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।) । কেকয় দেশীয় (পাজ্ঞাব প্রদেশ) রাজা অশ্বপতির মাতৃহীন কন্যা ছিলেন কৈকেয়ী । মাতৃহীন এই অর্থে নয় যে, কৈকেয়ীর মাতৃবিয়োগ ঘটে, মাতৃহীন এই অর্থে যে- অশ্বপতি তাঁর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে। এবং কৈকেয়ী দাসী মন্থরার নিকট লালিতপালিত হয়। অশ্বপতি একটি বিশেষ বর পেয়েছিল যে, সে পাখির ভাষা বুঝতে পারবে, কিন্তু পাখিরা কি বললো যদি সে কখনও কাওকে বলে দেয় তবে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য । একদিন শয়নকালে এক সোনালী বর্ণের জৃম্ভপক্ষীর ডাক শুনে অশ্বপতি হেসে ফেলে এবং তাঁর স্ত্রী জৃম্ভপক্ষী কি বললো এবং অশ্বপতির হাসির কারণ কি ? – জানতে চাইলে অশ্বপতি তা জানাতে অস্বীকার করে । মানুষ সব চাইতে যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সে হলো নিজেকে। আমাকে নিয়েই পরিবার, আমাকে নিয়েই সমাজ- কোনওটিই আমাকে বাদ দিয়ে নয়। হ্যাঁ, আমরা পরিবার, সমাজের জন্য কখনও কখনও. নিজেকে নিঃস্ব করে দেই – তাই বলে মৃত্যু ! – মেনে নেওয়া যায় না- এরকম অন্যায় আবদারের ক্ষেত্রে ত প্রশ্নই আসে না। সবাই দধীচি নন- দধীচির আত্মত্যাগের মধ্যেও একটি সার্বজনীন মঙ্গলের বিষয় ছিল , কিন্তু এক্ষেত্রে – সম্পূর্ণ অবিবেচক, অন্যায় শিশুসুলভ একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বোধের মত আবদার । ফলস্বরূপ উভয়ের মধ্যে চরম বাকবিতন্ডা এবং শেষ পরিণতি উভয়ের বিচ্ছেদ । ছোটবেলা থেকে মাতৃহীন কৈকেয়ী তাঁর মায়ের মতই ছিল অত্যন্তঃ জেদি – এইটিই স্বাভাবিক কেননা বাবা-মার স্বভাব সন্তান – সন্ততির উপরে বর্তাবেই। পাশাপাশি, পারিপার্শ্বিক প্রভাব, আমরা শিশুদের কতটা সন্তুষ্ট করতে পারছি, কতটা তাঁর Psychology বুঝতে পারছি – এই বিষয়গুলোও কাজ করে । আমরা মহাভারতের দুর্যোধনকে অতি সহজেই জেদি, একরোঁখা বলে থাকি – কিন্তু কেন সে এমন হলো ? একটি শিশু যার পিতা জন্মান্ধ, মা পতিব্রতার জন্য সারাজীবন চোখে কাপড় বেঁধে রাখলেন – হয়তো ছেলেটি একটি ভালো ছবি আঁকলো – পিতা জন্মান্ধ, সুতরাং তাঁর কাছ থেকে ছেলেটির প্রশংসা পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, মা চোখে কাপড় বেঁধে রেখেছেন – সে জানে মা চোখের কাপড়টি খুললেই ছবিটি দেখতে পারে, আমাকে উৎসাহিত করতে পারে কিন্তু না , পতিব্রতা হতে হবে , এখানেও সে বঞ্চিত- এরকম পরিবেশ হলে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছেলেটি বা মেয়েটির উপর পরবেই পরবে। এবং এরকম টুকরো টুকরো ঘটনার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে বিপথে চালিত হয় । তাই ত “উদ্যোগ পর্ব”-এ যখন শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনকে বোঝাতে চাইছিল যে, সে যা করছে তাতে তাঁরই সর্বনাশ হবে, বংশ ধংশ হয়ে যাবে, তখন দুর্যোধন বলছে-
” জানামি ধর্মম্ ন চ মে প্রবৃত্তি
জানামি অধর্মম্ ন চ মে নিবৃত্তি ” ।
( জানি আমি ধর্ম কি, কিন্তু তাতে আমার প্রবৃত্তি হয় না, জানি আমি, অধর্ম কি- কিন্তু তা থেকে নিজেকে নিবৃত্তি করতে পারি না।
I know what is dharma, but I don’t have any inclination to it, I know what is aadharma, but I can’t resist me from it. )
কারণ সে জানে ধর্মগামী ( ? ) হয়েই তাঁর মা তাদের শত পুত্রদের সাথে অন্যায় করছে, মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করছে, ঠিক যেভাবে কৈকেয়ীর মা জেদের বশে কৈকেয়ীকে ছোটবেলা থেকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছিল।
রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের পূর্বের রাত্রে কৈকেয়ী দশরথের কাছে তাঁর প্রাপ্য দুটি বর চেয়ে বসে। ‘প্রাপ্য’ এই অর্থে যে, কারাচাপার দেবাসুর যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রের পক্ষ নিয়ে মায়াবী শম্বরাসুরের (তিমিধ্বজ) সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে দশরথ যখন ভীষণভাবে আহত হয়, এবং অচৈতন্য হয়ে পরে, তখন যুদ্ধে পারদর্শী কৈকেয়ী তাঁকে উদ্ধার করে এবং সেবার দ্বারা প্রাণরক্ষা করে। দশরথকে নবজীবন দান করে। একজন মৃতপ্রায় মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দেবার মত মহৎ কাজের বিনিময়ে প্রতিদানস্বরুপ পুত্রের সমৃদ্ধির জন্য নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করা- খুব একটা অন্যায় দাবী বলে মনে না। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে, প্রাণ ফিরিয়ে দেবার বিনিময়ে কৈকেয়ী কিন্তু কিছুই দাবী করে নি। দশরথ নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চেয়েছিল, কৈকেয়ী শুধু বলেছিল সময়মত চেয়ে নেব।
এখন প্রশ্ন হলো কৈকেয়ী এমন দুটি বর চাইলেন কেন ?-
১) ভরতকে অযোধ্যার রাজা করতে হবে, এবং
২) রামচন্দ্রকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হবে।
কোন মা তাঁর গর্ভজাত সন্তানের সমৃদ্ধি চায় না ? মঙ্গল চায় না ? সকলেই চায়- অন্যায়টা কোথায় ? কৌশ্যলা কি নিঃস্বার্থ হতে পেরেছিল ? পারে নি। আমরা ত দেখেছি, কৌশ্যলাকে লক্ষ্মণের অন্যায় গর্হিত কাজে সায় দিতে। অযোধ্যাকান্ডে যখন রামচন্দ্র লক্ষ্মণের সম্মুখে কৌশ্যলাকে তাঁর বনবাসের বৃতান্তটি বললো, তখন লক্ষ্মণ কৌশ্যলাকে কি বলছে ? বলছে-
“দেবী পশ্যতু মে বীর্যং রাঘবশ্চৈব পশ্যতু।।
হরিষ্যে পিতরং বৃদ্ধং কৈকেয্যাসক্তমানসম।
কৃপণং চ স্থিতং বাল্যে বৃদ্ধভাবেন গর্হিতম।।
লক্ষ্মণ দশরথকে বৃদ্ধ বয়সে কৈকেয়ীর প্রতি আসক্ত, হীন, বালস্বভাব এমন কি হরণ বা হত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছে। ভরতের পক্ষে যারা থাকবে তাদেরকেও হত্যা করতে চেয়েছে। আর তার পরিপেক্ষিতে কৌশ্যলা রামচন্দ্র কি বলছে ? বলছে-
“লক্ষণ যা বলছে- উচিত বোধ হলে তাই কর।“ কোথায় কৌশ্যলা নিঃস্বার্থ ? সেও ত কৈকেয়ীর মতই ।
বাল্মিকী রামায়ণের বিশেষত্ব হোলো, বাল্মিকী সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষভাবে রামায়ণের চরিত্রগুলিকে ইহ জগতের রক্ত মাংসের মানুষ হিসাবে দেখিয়েছেন। প্রতিটি চরিত্রের psychology, emotion, mentality- এমন নিখুঁতভাবে তুলে ধরছেন যে, বাল্মিকী রামায়ণ অধ্যায়ন করলে মনে হবে- “হ্যাঁ, আমি হোলেও তাই করতাম। “ এখানেই বাল্মিকীর মুন্সিয়ানা, এখানেই বাল্মিকীর শ্রেষ্ঠত্ব। বাল্মিকী তাঁর চরিত্রগুলিকে ভক্তের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেন নি, একজন মানুষ ভালো মন্দ সংমিশ্রিত আর দশজন মানুষকে তাঁর কাব্যে স্থান দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, বাল্মিকী রামায়ণ রামচরিতমানস, কৃত্তিবাস রামায়ণ, যদুবংশ, বা দক্ষিণ ভারতের হাজার বছরের সঙ্গম সাহিত্যের রামায়ণ থেকে ভিন্নতর।( যেমন – বাল্মিকী রামায়ণে লক্ষ্মণরেখার প্রসঙ্গটি নেই।)
হ্যাঁ, কখনও কখনও আমরা কৈকেয়ীকে অতীব নিষ্ঠুর হতে দেখেছি। রাজা দশরথ যখন কৈকেয়ীর দুই পা জড়িয়ে ধরছে, মিনতি করছে, রাগে ভোক্ষে বলছে-
“ পাপীয়সী, আমি অগ্নির সমক্ষে মন্ত্রদ্বারা তোমার পাণিগ্রহণ করেছিলাম, এখন তোমাকে আর তোমার পুত্র ভরতকে ত্যাগ করলাম। …………. যদি রামের অভিষেক না হয় তবে সেই উপকরণে রামই আমার মৃতদেহের সৎকার করবে, ভরত নয়। “ (বাল্মিকী রামায়ণ, রাজশেখর বসু)
তবুও কৈকেয়ী দাবীতে অনড়। দশরথকে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলছে-
“রাজা, যদি বর দিয়ে অনুতপ্ত হও তবে লোকে কি করে তোমাকে ধার্মিক বলবে ? ………..তুমি নিজেকে সত্যবাদী দৃঢ়ব্রত বলে থাক, তবে কেন বর প্রত্যাহার করতে চাও ? ……তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন কেন পাপীর ন্যায় বিষন্ন হয়ে শুয়ে আছো ? ধর্মজ্ঞরা বলেন, সত্যই পরম ধর্ম, আমি তোমাকে সেই সত্যপালন করতে বলছি ।“ (বাল্মিকী রামায়ণ, রাজশেখর বসু)। যেন Lady Macbeth , Macbeth কে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন –
“I’ve given suck, and know
How tender is to love the babe that milks me ;
I would, while it was smiling in my face,
Have plucked my nipple from his boneless gum,
And dashed the brains out, had I so sworn as you
Have done to this”.
( Macbeth, Act I, Scene II, William Shakespeare)
যখন কৈকেয়ীর সম্মুখে রামচন্দ্র বন যাবার সম্মতি প্রকাশ করছে, তখন কৈকেয়ী অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য হৃষ্ট হয়ে রামচন্দ্র বলছে-
“ তোমাকেও তো গমনের জন্য উৎসুক দেখছি, অতএব তুমিও শীঘ্র বনে যাও। লজ্জার জন্যই রাজা ( দশরথ ) কথা বলছেন না, তুমি শীঘ্র যাত্রা করে এর দীনভাব দূর কর। তুমি না গেলে ইনি স্নান ভোজনও করবেন না। “(বাল্মিকী রামায়ণ, রাজশেখর বসু)
কৈকেয়ীর উপরোক্ত আচরণ ও কথোপকন শুনলে কৈকেয়ীকে একান্তই নীচ মনোভাবাপন্ন স্বার্থপর নিষ্ঠুর মহিলা বলে মনে হয়। আমি কিন্তু তা মানতে রাজী নই। কৈকেয়ী পিতৃরাজ্য রক্ষার্থে বৃদ্ধ দশরথকে যার ইতিপূর্বে দুটি স্ত্রী রয়েছে জেনেও বিবাহ করতে হয়েছিল। কৈকেয়ী শৈশব থেকেই মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত । কৈকেয়ী জেদী, কিন্তু কেন ?- আমাদের সেই কারণের উপরেও আলোকপাত করতে হবে। কৈকেয়ী দুটি বর চেয়েছিল আর দশটা সাধারণ মায়ের মতই নিজ পুত্রের জন্য , নিজের জন্য নয়। রামচন্দ্র নিজেই স্বীকার করেছে দশরথ কৈকেয়ীকে কথা দিয়েছিল যে কৈকেয়ীর পুত্র হলে তাঁকে রাজা করা হবে-
“পুরা ভ্রাতঃ পিতা নঃ স মাতরং তে সমুদ্বহন্।
মাতামহে সমাশ্রৌষীদ্ রাজ্যশুল্কমনুত্তমম্।।“
পুত্র কামনায় দশরথ ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে দিয়ে যে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিল, সেই যজ্ঞানি থেকে উত্থিত মহাবীর্য মহাবল মহাপুরুষ যে পায়স কৌশ্যলা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রাকে খেতে দিয়েছিল , অসম বন্টনের অভিপ্রায় নিয়ে সেই পায়সের ষোল ভাগের মাত্র দুই ভাগ পায়স দশরথ কৈকেয়ীকে খেতে দিয়েছিল। সর্বোপরি, রামচন্দ্র যদি স্বেচ্ছায় রাজপদ ছেড়ে দিয়ে অযোধ্যায় থেকে যেত তবে ভরত কি সিংহাসনে বসত ? কখনই না। তাই, রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠানো ছাড়া কৈকেয়ীর অন্য কোনও উপায় ছিল না।