বৃষ্টি যাপন

মৌসুমী চৌধুরী, বেহালা, কলকাতা

বাঁধ-ভাঙ্গা উথালপাথাল শ্রাবণধারা। সাথে বাতাসের দামালপণা। এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় করে কাকভেজা হয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এলো অদিতি। রেইনি-ডে ঘোষণা হয়ে ছুটি হয়ে গেলো। এই “রেইনি-ডে”,শব্দটির সাথে প্রত্যেকেরই ছোটবেলা যেন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকে। তাই রেইনি-ডে হলে আজও ছাত্রদের সাথে তারও মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। জামাকাপড় ছেড়ে চন্দ্রর মাকে এক কাপ কফি দিতে বলে গীতবিতান হাতে বারান্দায় এসে বসলো সে। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টির মেঘমল্লার রাগ। ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর। অনেকদিনের কাঠফাটা গরমের পর দূরের আম, কামিনী, নিম, পেয়ারা গাছগুলো যেন মেতেছে আনন্দের ধারা স্নানে। “টি.টি.টাওয়ার” এর মাথায় এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা কাক ভিজে চলেছে মনের খুশিতে। একমনে দেখতে থাকে অদিতি। চন্দ্রর মার ডাকে সম্বিত ফিরে পায়। “রাতে কি খিচুরি হবে বৌদি?সাথে ডিমভাজা – পাঁপরভাজা?”,ধূমায়িত কফি মাগটি হাতে ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে চন্দ্রর মা। চন্দ্রর মাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে অদিতি গরম কফিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে গীতবিতানের পাতায় ডুবে যায়। একান্ত যাপনে গীতবিতান পড়তে তার খুব ভালো লাগে। মনের একটা আশ্রয় খুঁজে পায়……
……….”আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে/সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।।/দিঘির কালো জলের ‘পরে মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে, /বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে/সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।।” এমন বাঁধনহারা বাদল দিনের অনুষঙ্গেই ধেয়ে আসে সেদিনের সেই বেদনাময় স্মৃতি। গভীর এক অপরাধবোধ আজও অদিতিকে কুরেকুরে খায়। তার ভেতরে যেন তীব্র রক্তক্ষরণ ঘটায়…….
সেদিনও ছিলো এমনই এক পাগলপারা বাদল দিন। তিন দিন থেকে আকাশটা যেন ফুটো হয়ে গিয়েছিলো। সকাল থেকে রাত পর্য্যন্ত অদিতিদের টিনের চালে বৃ্ষ্টির জগঝম্প উদ্দাম নাচন। চারিদিকে নদীগুলো ফুঁসছিলো। প্রশাসন থেকে জারি করা হয়েছিলো রেড এলার্ট। তৃতীয় দিন সকাল থেকে বৃষ্টিটা খানিক ধরেছিলো। যদিও রিমঝিম সুর তুলেই যাচ্ছিলো তখনও। রাস্তা-ঘাটেও ছাতা মাথায় লোকেদের গুটি গুটি দেখা গেলো। ছাত্রছাত্রীরাও স্কুল -কলেজমুখী। কাজেই অদিতিও কলেজে রওনা দিলো। স্কুল -বেলা থেকে আরম্ভ করে কলেজ- বেলা সব সময় তারা ভোলা কাকুর রিক্সা করে যেতো। সে আর বোন। বাবার বলা থাকতো। কড়া পাহারায় ভোলাকাকু নিয়ে যেতেন, আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতেন। এছাড়া, কখনও রাতে ট্রেন ধরতে হলে ভোলাকাকু। কাক ভোরে ট্রেন ধরতে হলে ভোলাকাকু। বাবা ভোলাকাকুকে খুব ভরসা করতেন। ভোলাকাকুদের সঙ্গে যেন গড়ে উঠেছিলো তাদের পরম আত্মীয়তা। ভোলাকাকুরা থাকতেন বাঁধের পাড়ে দু’কামরার এক চালা ঘরে। কাকীমা, দুই মেয়ে, পাঁচ বছরের বিল্টুকে নিয়ে ছিলো ওদের সংসার।
সেদিন অদিতিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে ভোলাকাকু বললেন, “আগে হয়ে গেলেও যাবি না। আমি এসে নিয়ে যাবো। চারদিকের অবস্হা ভালো না। বাঁধ কানায় কানায় ভরে গেছে।” কলেজে সেদিন উপস্হিতির হার ছিল বেশ কম। অনার্সের ক্লাসটা নিলেন ডি.কে.এম। তারপরই হৈ হৈ কান্ড! কলেজের নিচের তলায় অফিস রুমে জল ঢুকছে হু হু করে। কলেজের ক্লার্ক, ফোর্থ স্টাফেরা সবাই মিলে ফাইলপত্র দোতালায় তুলছেন। আশেপাশের নীচু এলাকার লোকেরা তাদের গরু-ছাগল নিয়ে কলেজে আসছে আশ্রয় নিতে। মালা, কাকলী, দেবিকা,
রীতাদের বাড়ী থেকে লোক এসে ওদের নিয়ে গেলো। অদিতি হঠাৎ দেখলো রিক্সা নিয়ে হন্ত-দন্ত করে আসছেন ভোলা কাকু, “শীগগীর চল, বাঁধ ভাঙ্গা জল ঢুকছে শহরে….. “। অদিতি আঁতকে উঠে বললো, “তাহলে তোমাদের ঘর কি হবে? তুমি নিতে এলে কেন কাকু? আমি তো এখানেই থাকতে পারতাম….. “। কাকু বললেন, “আর থাকতে হবে না। বেশি বুঝিস না। ভালোয় ভালোয় বাড়ি চল দেখি। ” বাড়িতে ফেরার পথে অদিতি দেখছিলো রিক্সার চাকা অর্ধেক জলে ডুবে যাচ্ছে। তাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ভোলা কাকু তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। দুদিন কেউ কারও খবর নিতে পারলো না। সারা শহর জলবন্দি। বাবা বাড়িতে ছিলেন না। বাবার কর্মস্থলে তাদের যে বাড়ি ছিলো সেখানেই ছিলেন তিনি। মা বোনেদের সহ তাকে নিয়ে পাশের বাড়ির দোতালায় দু’দিন কাটালেন….. পাড়ার আরও অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুদিন পরে জল নামলে সবাই ফিরে গেলো যে যার বাড়িতে। সবার ঘরেই পলি জমেছে পুরু হয়ে। বাড়িতে আসার পর ঘরের অবস্হা দেখে কান্না পেয়ে গিয়েছিলো অদিতির। তাঁর বইয়ে ঠাসা কাঠের বুক -সেল্ফটা জলের তোড়ে উল্টে ভেসে ভেসে ঘরের মাঝখানে চলে এসেছে।যাইহোক তারা সবাই মিলে ঘর পরিস্কার করতে লেগে গেলো।আর ঠিক সেই সময়ই ভোলা – কাকুর বড় মেয়ে মীনু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। জানালো সেই ভয়ংকর ঘটনাটা। ভোলাকাকু যখন অদিতিকে আনতে কলেজে গিয়েছিলো তখন হঠাৎ বাঁধ ভেঙ্গে যায়। জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া ঘরের জিনিস কিছু বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলেন কাকীমা। চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব…… ঘর থেকে বেড়িয়ে কাছের স্কুল বাড়িটিতে আশ্রয় নিতে গিয়ে জলের তোড়ে ভেসে গেছে তাদের ভাই বিল্টু। পাড়ার ছেলেরা খুব বাঁচানোর চেষ্টা করেও পারে নি। তারপর যে যার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় এতই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো যে, বিল্টু মুহূর্তেই মিশে গেছে রাক্ষুসে অতল জলোচ্ছ্বাসে। জল নেমে যেতে স্থানীয় পুলিশ ওর দেহ খুঁজেই চলেছে,এখনও পায় নি ……. স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো অদিতি,ভোলাকাকু তাকে আনতে না গেলে হয়তো বিল্টু এভাবে ভেসে যেতো না।হয়তো….. বিল্টুর মৃত্যুর জন্য নিজেকেই আজও দায়ী মনেহয় অদিতির । তীব্র অপরাধবোধে আজও তাড়িত হয় সে। বৃষ্টির রিমঝিম নুপুরে ছোট্ট বিল্টুর কান্না শুনতে পায়। বৃষ্টি ধারার সাথে সাথে আজও ভেসে আসে ভোলাকাকুর কর্তব্য নিষ্ঠা আর স্বার্থ ত্যাগের কথা। বৃষ্টিধারায় মিশে যেতে থাকে অদিতির ভেতরে আজীবন বয়ে যাওয়া নোনা নদীটি…….।
টুংটাং কলিংবেলের শব্দে চমকে ওঠে অদিতি…….! বাইরে অন্ধকার নেমে
এসেছে। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মনে হয়। কামিনী ফুলের গাছটা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।গাছের তলাটা সাদা হয়ে গেছে ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ডিম ভাজার গন্ধ। চন্দ্রর মায়ের
দরজা খুলে দেবার শব্দ পেলো। বোধহয়
অতীন ফিরে এলো…….জীবন এভাবে কেটে যাচ্ছে।কেটে যায়…… ঋতুচক্রের আবর্তনে বয়স বেড়েছে ভোলাকাকুর। কিন্তু প্রতি বর্ষাতেই তিনি নাকি বিল্টুর ফিরে আসার অপেক্ষা করেন……চিৎকার করে বিল্টুর নাম ধরে ডাকতে থাকেন। গত পূজোর ছুটিতে অদিতি ভোলাকাকু-
কে দেখতে গিয়েছিলো, বহরমপুর মেন্টাল অ্যাসাইলামে। নাঃ,তাকে চিনতে পারেন নি তিনি! বড়ই সেন্সেটিভ ছিলেন মানুষটা। সেন্সেটিভ মানুষদের কষ্ট খুব! বাইরে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এলো আকাশ ভেঙ্গে……..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 − three =