পাথুরে
সিদ্ধেশ্বর নাথ, সুভাষগ্রাম, দক্ষিণ ২৪ পরগণা
বিয়েটা বেশ হুটোপাটি করেই করে ফেলেছিলো কেয়া। কেয়ার মা মাঝে মধ্যেই কেয়ার বাবা সমীর বাবুকে বলতেন ‘আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো মেয়েকে’। সমীর বাবুদের একমাত্র সন্তান কেয়া। যে মানুষটা মেয়ে অন্তপ্রাণ।একটা দিনের জন্যও মেয়ে চোখের আড়াল হলে ঘুম আসতোনা যার।সেই সমীর বাবুই কোন আপত্তি ছাড়াই একফোঁটা চোখের জল না ফেলে মেয়ের পছন্দের ছেলের সাথেই বেশ আড়ম্বর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। বাবাদের যে চোখের জল ফেলতে নেই। বাবাদের দৃঢ় কাষ্ঠল মনের গোপনে যে সজীব প্যারেনকাইমা কলার অস্তিত্ব সে খবর তার সারা শরীর জুড়ে জড়িয়ে থাকা সবুজ লতানো সংসার অনুমান করতে পারলেও সর্বদা অনুভব করতে পারেনা। মেয়ের বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা ব্লাড সুগার আর কেয়ার মায়ের ওপেন সার্জারি সমীর বাবুকে দিনকে দিন এলোমেলো করে দিচ্ছিলো। এহেন সময় কোনো দাবিহীন সোয়েলের হাত ধরে কেয়ার আবদার শত আপত্তি সত্ত্বেও ফেলতে পারেননি সমীর বাবু। কেয়ার মা প্রথম প্রথম ঘোর নারাজ থাকলেও কেয়ার বাবার মুখের দিকে চেয়ে শেষমেস সেও বরণডালা সাজিয়েছিল।
সোয়েল আর কেয়ার আলাপ এক আর্ট এক্সিবিশনে। সোয়েল তখন উঠতি ভাষ্কর।বিভিন্ন মহলে তার বেশ নামডাক হয়েছে। দর্শক কেয়া বেশ কিছুক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে এক্সিবিশনে সোয়লের একটা কাজ পর্যবেক্ষণ করছিল।হঠাৎ সোয়েলের ডাকে চমকে ওঠে কেয়া, ‘কি, কোনো ভুল খুঁজে পেলেন?’ এহেন প্রশ্নে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কেয়া পাল্টা প্রশ্ন করে ‘না, কিন্তু আপনি কে?’ সোয়েলের পরিচয় জানতে পেরে জিহ্বা কেটেছিল কেয়া। প্রথম সাক্ষাতেই কেয়াকে ভালো লেগেছিলো সোয়েলের। চলেছিলো দীর্ঘ আলাপ। কেয়াও মজেছিলো সোয়েলে।তারপর? তার আর পর নেই, আপন হয়েগেল দুজন দুজনের। তাদের সাথে আপন হলো গঙ্গারপাড়, রেস্তরা, সিনেমাহল, মোহরকুঞ্জ, রবীন্দ্র সরোবর আর হাত ধরাধরি ফিসফিসানি। দুজনে বয়ে গেল এক অজানা স্রোতে।
সোয়েলের জীবনে কেয়া দ্বিতীয়। কেয়ার আগে এসেছিলো রাবেয়া। প্রায় ছ’বছর ছিল দুজনের প্রেম। তারপর নিকা,শাদি। তিনমাস। তারপর সবশেষ। মারা গেল রাবেয়া। ব্রেন ক্যানসার। সোয়েল জানতো সবই। তাই হয়তো শেষ ইচ্ছা পুরন করেছিলো। প্রায় চার বছর কেটে গেল রাবেয়া চলে গেছে। কিন্তু হাত ধরাধরি বিকেল, এক আকাশ স্বপ্ন, এসব কোনকিছুই ছেড়ে যায়নি সোয়েলকে। স্মৃতিগুলো তাকে দিনের পর দিন অসহায় করে তুলেছিলো। তার দমবন্ধ হয়ে আসতো। এহেন জীবনে কেয়া ছিল ফুরফুরে পাহাড়ী বাতাসের মতো। বহুকাল পর সোয়েল প্রানখুলে শ্বাস ভরেছিল বুকে। কেয়াকে সে তার ফেলে আসা জীবনের সব কথা বলেছিলো। কেয়া জ্বলজ্বলে চোখে জড়িয়ে ধরেছিলো সোয়েলকে। সোয়েলের রোমশ বুকে মাথা রেখে জিজ্ঞেস্ করেছিলো ‘শান্তি লাগে?’ নিশ্চুপ সোয়েলের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছিলো।
বিয়ের পর বেশ ভালই কাটছিলো দুজনের। বছর দুয়েক পর তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসলো। দুজনেই খুব আপ্লুত। কিন্তু সমস্যা শুরুহল মাস ছয়েক পর থেকে। সোয়েল কেয়ার কাছে কেয়ার নুড্ মডেল বানানোর আবদার করলো। পাথর কেটে বানাবে। কিন্তু কেয়া রাজি হল না। সোয়েলের মন বিমর্ষ হয়ে উঠলো। সে বারংবার কেয়াকে আবেদন করলো। কিন্তু কেয়া নারাজ। সোয়েল আর কেয়ার দূরত্ব বাড়তে থাকলো। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে সে ল্যাবে বসে পাগলের মতো আসমান-জমিন চিন্তা করতো, রাবেয়ার ছবিগুলো দেখতো আর নিজের মনে নানান কথা বলতো। সোয়েল আর কেয়ার মধ্যিখানের দেওয়ালটা ক্রমেই পাঁচিলে পরিণত হচ্ছিলো। প্রথম প্রথম কেয়া বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিলেও দিনের পর দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় অবশেষে সে রাজি হয়েছিলো সোয়েলের আবেদনে। তবে অনেক দেরী হয়ে গেছিলো ততদিনে। সোয়েল তলিয়ে গেছিলো রাবেয়ার সমুদ্রে। তখন সে রাবেয়ার কোরাল রিফের উপত্যকার সম্মোহনে মাতাল।
কেয়া মেনে নিতে পারেনি সোয়েলের রাবেয়া প্রেম। সে অভিমান করে সোয়েলকে ছেড়ে চলে এসেছিলো বাবার কাছে। ভেবেছিলো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সোয়েল ফিরে আসবে তার আপন হয়ে। কিন্তু না, বছর ঘুরে গেলেও ফিরে এল না সে। প্রথম দিকে কেয়া জেদ্ ধরে বসে থাকলেও সময়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ভেঙে পড়লো সে।সমীর বাবু মেয়েকে ভরসা দিয়ে বলেছিলেন ‘দুঃখ করিসনা মা। শিল্পী মানুষের মন মাটির মতো নরম হয়। দেখিস একদিন সে ঐ মাটিতেই তোর মূর্তি গড়বে’। কিন্তু সেই ভরসা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মারা গেলেন সমীর বাবু। আর ঠিক তার মাস ছয়েক পর কেয়ার মাও চলে গেলেন। কেয়া খুব একা হয়ে পড়েছিলো। খুব অসহায়। দিনগুলো তার চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিলো।
আর চুপচাপ বসে থাকতে পারেনি কেয়া। একদিন চলে গেলো সোয়েলের বাড়ি। সঙ্গে ছিল তাদের একমাত্র সন্তান কৈশিকী। বাইরের দরজা বন্ধ ছিলো। হালকা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। একদলা গুমোট ভ্যাবসা গ্যাসে দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো কেয়া আর কৈশিকীর। কেয়ার মন এক অজানা শীতে কাঁপতে লাগলো। সে বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে ঢুকে পড়লো অন্ধকার ঘরে। আলো জ্বালাতেই দেখলো সেই পুরোনো সোঁফা, টিভি, ওয়াশিং মেশিন সব একই আছে শুধু বদলে গেছে ছবিটা আর কেয়ার সাজের জিনিস, কাপড়-চোপড়। তাদের ড্রেসিং টেবিলের উপরে কেয়ার ছবির জায়গায় বসেছে রাবেয়ার ছবি। কেয়ার বেশ আশ্চর্য লাগলো ঘরগুলো দেখে। এত সুন্দর টিপটপ্ করে সে কোনদিন ঘর গোছাতে পারেনি। আর সোয়েল চিরকালই আগোছালো। ‘তবে কি কোন কাজের লোক রাখলো? নাকি……… ছি!ছি! এসব কি ভাবছে সে’ নিজের মনেমনেই কথাগুলো বলে কেয়া। এই ঘরে থাকা কেয়ার সমস্ত ছাপই প্রায় অবলুপ্ত হয়েগেছে এই দু’বছরে। শুধু বিছানার উপর পড়েছিলো সোয়েলের একটা শার্ট। যেটা কেয়া তাদের বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিলো। শার্টটা হাতে নিতেই তার চোখে জল আসে। সে বুকভরে সোয়েলের গন্ধ নেয়। মন ভিজে আসে তার। কেয়া ঘরময় খুঁজতে থাকে সোয়েলকে। কিন্তু কোথায় সোয়েল? হঠাৎ তার চোখ চলে যায় ল্যাবের দিকে। সেখান থেকে পাথর কাটার শব্দ ভেসে আসে। সে তীব্র অথচ শব্দহীন পা ফেলে ছুটে যায় সেদিকে। দ্যাখে চিজেল্ আর হাতুড়ি হাতে পাথরের শরীরে স্ট্রোক কাটছে সোয়েল। আর মাঝে মধ্যে তাকাচ্ছে সামনের সোনালী আলোয় ঢাকা বিছানাটার দিকে। কিন্তু বিছানাটা তো ফাঁকা। কোন মডেলই সিটিং-এ নেই। কেয়া বারকয়েক ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নেয় ঘরটাকে। সোয়েল ছাড়া কাউকে দেখতে পায়না সে। হঠাৎ তার নজর পড়ে পাথর খন্ডটার দিকে। এতক্ষণ সে ভালভাবে লক্ষ্য করেনি। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় সে পাথর জীবিত হয়ে উঠেছে। মুখের স্ট্রোক প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। শুধু ফিনিসিং কিছু বাকি আছে। বুকের কাজ চলছে। মুখটা বেশ চেনাচেনা লাগলো কেয়ার। বিদ্যুৎ বেগে ঝটকা দিল স্মৃতি। মাথা ঘুরিয়ে উঠলো কেয়ার। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর দেখলো ধীরে ধীরে পাথুরে মুখ-চোখ মাংসল রূপ ধারন করলো। একী! কী দেখছে সে! এতো রাবেয়া! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা সে। মুখের পর ক্রমে বুকটাও মাংসল রূপ ধারন করে।আর সেই মাংসল স্তনে হাত বুলিয়ে ফিনিসিং যাচাই করে নেয় সোয়েল।