সম্পাদকীয়, এপ্রিল ২০২২
গেল গেল রব। প্রতিবাদে উত্তাল গোটা অন্তর্জাল মাধ্যম। ফেসবুক টুইটারে বাংলা মাধ্যমে পড়বার সগৌরব ঘোষণার ছড়াছড়ি। গর্জে উঠেছে বাংলার একাংশ, বাংলা মাধ্যমে পড়া নিয়ে এমন অপবাদ, অপমান? না, মেনে নেওয়া যায় না। কি নিয়ে বলছি তা এতক্ষণে প্রায় সকলেই বুঝে গিয়েছেন। যারা বোঝেননি তারা কিন্তু এখন থেকে সঠিক বাঙালি নন। তাও সেই সব মানুষগুলির জন্য জানিয়েই দিই, সম্প্রতি এক বেতার সঞ্চালিকা একটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন বাংলা মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরা নাকি বহুজাতিক সংস্থাগুলিতে চাকরিলাভে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেন না। এই কথাটাকেই বাংলার অপমান, বাঙালির অপমান আখ্যা দিয়ে রীতিমত প্রতিবাদ এবং কটাক্ষের ঝড় উঠেছে সামাজিক মাধ্যমে। হ্যা, এ রাজ্যের বাঙালিদের প্রতিবাদের প্রধান বা একমাত্র জায়গা এখন এই সামাজিক মাধ্যমই।
পরে সেই সঞ্চালিকা কেন তিনি এই উক্তি করেছেন তার স্বপক্ষে একটি যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। ক্লিশে এবং চেনা সেই যুক্তি, বাংলা মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাল বলতে না পারায় হীনমন্যতায় ভোগেন, যার নাকি সরাসরি প্রভাব পড়ে চাকরির ইন্টারভিউতে। এ কথা আংশিক সত্যি তা স্বীকার করে নেওয়া ভাল। কারন সব মাধ্যমেই ভাল খারাপ দুই রকমের ছাত্রছাত্রী থাকে তাই ভাল ছেলেমেয়েরা যে কোনও মাধ্যম থেকেই ভাল ফল করে, ভাল জায়গায় প্রতিষ্ঠা পায়। বাংলা মাধ্যমে পড়া অসংখ্য ছেলেমেয়েই এখন বহুজাতিক তথা দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামীদামী সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। তাই এই আলোচনা এখানেই থামিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সেটা হওয়ার নয়। কারণ, বাংলা মাধ্যমে পড়া নিয়ে যতটা আত্মশ্লাঘা আমরা এখন অনুভব করছি, বাংলা ভাষা নিয়ে পড়ে যতটা গৌরব আমাদের মধ্যে রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। তা কি সত্যিই আন্তরিক? নাকি প্রতিবাদের স্রোতে গা ভাসানো?
বাংলাকে ভালবাসি, কিন্তু বাংলা বলতে খুব আপত্তি। কথায় কথায় ইংরেজি, হিন্দি বা অন্যান্য ভাষার শব্দ ঢুকিয়ে বাংলাকে অপদস্থ করতে আমাদের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জুড়ি নেই। বাংলা মাধ্যমে পড়া আশু গর্বিত বাবা মায়ের ছেলেমেয়েরা কি এখন বাংলা মাধ্যমেই পড়েন? উত্তরটা সকলেরই জানা। কলকাতা থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরে একটি মফঃস্বলে থাকা আমার এক বন্ধুর মেয়ে ভর্তি হল স্থানীয় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। তার স্ত্রী আমায় জানাল বাংলা মাধ্যমে নাকি পড়াশোনাই হয় না। বলাই বাহুল্য সেই মেয়েটি নিজে বাংলা মাধ্যমেই পড়েছে, আরও অবাক কাণ্ড আমার সেই বন্ধুটি কিন্তু একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক। এখানেই শেষ নয়, সেই বন্ধুটির মেয়ের স্কুলে প্রথম ভাষা ইংরেজি, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, কারন হিন্দিতে নাকি নম্বর ওঠে বেশি। এটা একটা উদাহরণ, শহর, মফঃস্বল, একটু আধুনিক গ্রাম সর্বত্রই এখন একই ছবি। আমার বাড়ি গোবরডাঙা বলে একটি মফঃস্বল শহরে। পৌর এলাকায় ২৬ টি বাংলা মাধ্যম প্রাথমিক স্কুল ছিল এখানে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীর অভাবে গত দশ বছরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে আটটি স্কুল। ভাবুন একবার, শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হয়ে গেল বাংলা মাধ্যম স্কুল। বদলে গজিয়ে উঠল দ্বিগুণ পরিমাণে ইংরেজি বা আধা ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুল। অর্থাৎ আমরা বাংলা মাধ্যমে পড়বার জন্য খুব গর্বিত হলেও আমাদের ছেলেমেয়েদের সেই গর্বের ভাগিদার হতে দিতে নারাজ।
আচ্ছা আমরা তো বাংলা মাধ্যমে পড়বার জন্য এত গর্বিত। দৈনন্দিন লেখালেখির যে সামান্য কিছু কাজ আমাদের করতে হয় তা কি আমরা বাংলায় করি? একটু বুকে হাত রেখে বলুন তো ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ফর্মে, এমনকি চেক বইতে বাংলায় কতজন লেখেন। রেলের আসন সংরক্ষণের ফর্মও কি কেউ ইদানিং কালে বাংলায় পূরণ করেছেন? কতজন বাংলা মাধ্যমে পড়া গর্বিত মানুষ নিজের সাক্ষরটি সব জায়গাতেই বাংলাতে করেন? এই সব গা জ্বালানে প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছেই আছে। উত্তরটাও আমাদের সকলেরই জানা।
রেলের টিকিটে অনেক সময়ই বাংলা ভাষা থাকে না। কেউ এ নিয়ে কখনও প্রতিবাদ করেছেন? বাহুবলি, আরআরআর নিয়ে পাগল গোটা দেশ। আপনি আমিও ব্যতিক্রম নই। বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে রমরমিয়ে চলছে এই সব দক্ষিনী ছবি। বাকিটা হিন্দি ছবি। বাংলা কই? প্রশ্ন করেছেন আপনি? অথচ আপনার জন্যই জানিয়ে রাখি এখানে আরআরআর হিন্দি ভাষায় দেখানো হলেও দক্ষিনের সব রাজ্যে তাদের ভাষায় ডাব করে দেখানো হচ্ছে এই ছবি। শুধু তাই নয় সব হিন্দি বা ইংরেজি ছবিই সেখানে তাদের নিজেদের ভাষায় ডাব করে দেখানো হয়, না হলে সেখানকার মানুষজন ছবি দেখতে আসেন না। আমাদের এই নিজের ভাষার প্রতি ভালবাসা আছে? আমরা কখনও বলেছি, সব ছবিই আমি নিজের ভাষায় দেখতে বা শুনতে চাই? না, আমরা উদার। তাই তো আমি অন্য প্রদেশে যাই বা অন্য রাজ্য থেকে কেউ এখানে আসুক, তাদের সঙ্গে হিন্দি বা অন্য ভাষায় কথা বলতে পারলে বর্তে যাই। কোনও মতেই বাংলা বলার ভুলটুকুও করি না। কারণ? উনি তো বাংলা বুঝবেন না। আমরা তাই বোঝাতেও যাই না। অন্য রাজ্যের মানুষ কিন্তু এই বোকামো করেন না।
বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলা সনাতনী সংস্কৃতিও আপনার আমার মত বাংলা মাধ্যমে পড়া গর্বিত বাঙালির হাতে পড়ে এখন আইসিইউতে। আচ্ছা একটু মনে করে দেখুন তো গত দশ বছরে কোনও পাত্রকে তার বৌভাতে ধুতি পাঞ্জাবী পরতে দেখেছেন? আমি কিন্তু বৌভাতের কথা বলছি বিয়ের দিন নয়। আমি নিশ্চিত আপনি দেখেননি। কারন বৌভাতে এখন স্যুট কোট পরে সাহেব সাজাটাই রীতি। আগে তেমনটা ছিল না। মেয়েদের ক্ষেত্রেও যেমন শাড়ি বিদায় নিয়ে চলে এসেছে লেহেঙ্গা চোলি। না না আমি গোটা বছর বা গোটা জীবন শাড়ি পড়তে বা ধুতি পরতে বলছি না। কিন্তু আমাদের বাঙালিদের যে পরিচিত পোশাক, রীতি তা কি এই দুটো দিনের জন্যও মানা অসম্ভব? না কি বড্ড আনস্মার্ট লাগে? বৌভাতে কোট টাই পরে সাহেব সাজা বরগুলির সিংহ ভাগই কিন্তু বাংলা মাধ্যমে পড়া। বাঙালির বিয়েতে এখন মেহেন্দি, সঙ্গীত হয়, মেয়েরা নাচ গান করেন। একটু মনে করুন তো গত দশ বছরে কোনও বিয়ে বাড়িতে বাসর রাতে জমজমাট গান গল্প আড্ডার কথা শুনেছেন? অথচ সেটা আমাদের সংস্কৃতি ছিল।
বাংলা মাধ্যমে পড়েও, একটা কর্পোরেট চাকরি বাগিয়ে ফেসবুকে সগর্ব ঘোষণাই যদি আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাহলে বলব আপনি ওই সঞ্চালিকার মুখে ছাই দিয়ে বেশ সফল। কিন্তু বাঙালি হিসেবে আপনি কতটা সফল, কতটা আন্তরিক তা নিজেই একবার বিচার করুন না, বুকে হাত রেখে। সম্ভব হলে বেরিয়ে আসুন “আমরা বাঙালি” নাটকের চরিত্রের খোলস ছেড়ে। মন থেকে ভালবাসুন বাংলা ভাষাকে, বাংলা সংস্কৃতিকে। তাহলে দেখবেন কেউ আর আপনার ভাষাকে অপমান করবার সাহস দেখাবে না, আপনাকেও ফেসবুকে টুইটারে সগর্বে ঘোষণা করে জানাতে হবে না আপনি কতটা গর্বিত বাঙালি।
পরিশেষে ধন্যবাদ অয়ন্তিকাকে, ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি এবং তাদের বাংলা প্রেমকে জাগিয়ে তোলার জন্য। হোক না বিতর্ক, তবুও জেগেছে বাংলা, এটাই বা কম কি?
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ