আশা’র কথা
সাঁওতালি ছবি “আশা” সাড়া ফেলেছে চলচ্চিত্র মহলে। রায়গঞ্জে শুট্যিং হওয়া এই ছবি প্রশংসিত হয়েছে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। এছাড়াও নয়ডায় ১২তম দাদা সাহেব ফালকে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন “আশা”র অন্যতম মুখ্যচরিত্রাভিনেত্রী ডগর টুডু। সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন আশাকে নিয়ে নানান চর্চা। কিন্তু এই ছবি তৈরির পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না। “আশা”র নানা অজানা কথা অবেক্ষণের পাতায় উঠে এল স্বয়ং ছবির পরিচালক পল্লব রায়ের কথায়/
পল্লব রায় ##
“আশা” ছবির প্রথম স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ শুরু করে শ্রাবণ রায়। ছবিটির মূল ভাবনা ও গল্প প্রবীর মহাপাত্রর। সেখানে গল্পটি ছিল এমন যে, আশা একজন প্রতিবন্ধী মেয়ে। মায়ের অনাদরে বড় হওয়া একটি মেয়ে। পাড়ার ছেলেদের কাছ থেকেই সে পড়াশোনা শেখে। এক সময় গ্রামের এক দিদিমণি দেখেন এবং তাকে শহরে নিয়ে যান। শহরে গিয়ে পড়াশোনা করে। মেধাবী আশা পরিশ্রম করে ডাব্লিউবিসিএস অফিসার হয় এবং গ্রামে সে ফিরে আসে। এই ছিল প্রাথমিক অবস্থায় গল্পের কাঠামো। গল্পটি শুনে প্রাথমিক অবস্থায় আমার মনে হয়েছিল এটি একটি মেলোড্রামা ফিল্ম হবে। তখনই গল্পকার মহাপাত্রকে আমি জানাই গল্পটিকে আমি একটু পরিবর্তন করতে চাই। তখন তিনি আমাকে সাহস দেন, যাতে আমি প্রয়োজন মত পরিবর্তন করতে পারি। গল্পের প্যাটার্ন শুনে উনার খুব ভালো লাগে। শ্রাবণ আমার ছোট ভাইয়ের মতো ও অনেকদিন ধরে এই গল্পটির স্ক্রিপ্ট করেছিল। তাই আমি পুরো গল্পটি ফেলে না দিয়ে, ওই গল্পের ৩০ শতাংশ রেখে বাকিটা আমার মত করে সাজালাম। সবাই জানত এটি একটি শর্ট ফিল্ম হতে যাচ্ছে, কিন্তু আমি জানতাম এটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্মই হবে। ৯ দিনে আমরা কাজটা শেষ করলাম দ্বিতীয় লকডাউন এর সময়। খাওয়া-দাওয়া যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে আমরা কাজটা কোনমতে শেষ করি। দু’একজন ছাড়া আমাদের অধিকাংশ ক্রু মেম্বার অনভিজ্ঞ। তবে এরা হচ্ছে সবাই মাল্টি ট্যালেন্টেড।
ওদের বুদ্ধির একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, আমাদের একটা বৃষ্টির সিন ছিল। রায়গঞ্জের সেরকম ভাবে সিনেমায় ব্যবহৃত বৃষ্টির সিন করার সরঞ্জাম ছিল না। নিবাস বর্মন খুব ট্যালেন্ট ছেলে ও বুদ্ধি খাটিয়ে ও একটি শাওয়ার তৈরি করে। নিবাসের কৌশলেই শেষ পর্যন্ত আমরা শটটা নিতে পারলাম।
আর একটা মজার ঘটনা বলি প্রথম দিনের শুটিংয়ের। আশার বাবার বাঁশি বাজানোর দৃশ্যের পর, আমরা আশাকে শিকলে বাধা হবে এই দৃশ্যের শর্ট নেব। শট এর সমস্ত কিছু প্রস্তুতি হয়ে গেছে। এমন সময় আমার চোখ পড়ল যে আশাকে যে শিকল দিয়ে বাঁধা সেই শিকল টা কোথায় । প্রোডাকশন ম্যানেজার জানালো শিকলটা আদতে কেনাই হয়নি। ভাবুন একবার। এমনিতেই প্রচন্ড গরম। তার উপর এই রকম ঘটনা, অন্য কোন পরিচালক হলে শুটিং সেট থেকে বেরিয়ে আসত। কিন্তু আমি তখন মাথা ঠান্ডা করে, আমার সহকারীকে চেন কিনতে পাঠালাম। এক ঘন্টা শুটিং বন্ধ রেখেছিলাম। তখন ভাবলাম ওদের কোনও দোষ নেই। ওরা ওদের ক্ষমতার বাইরে গিয়েও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
শুটিং এর মাঝে হঠাৎ জানতে পারলাম আমাদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেত্রী ডগর টুডু অনুপস্থিত, তিন চারদিন বাদে ফিরবে। কি মুশকিল… তবে এই সুযোগেই আমি আমার স্ক্রিপ্টটা আরেকটু ঝালাই করতে পারলাম। ওই দুই তিন দিন রাতে আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমার রুমমেট উঠে দেখতো যে আমি জেগে বসে আছি আবার লিখছি। আমার মনের মধ্যে কত যন্ত্রণা হত সেটা প্রকাশ করতে পারছি না । কোথায় যেন আশার সব মনের কষ্টগুলো তুলে ধরতে পারছিলাম না। কি করলে কি হবে, এই ছটফটানি চলতে থাকল দুই তিন দিন ধরে। তারপরে মাথা থেকে বের হলো একটা সিন। এটা একটা ইম্প্রভাইজ সিন। সহকারি পরিচালককে বললাম, আশার জন্য একটা এক্সট্রা প্যান্ট লাগবে। আমার স্ক্রিপ্টেও এই সিনটা ছিল না। আশা তার মাকে দূরে ফেলে আসে শহরের এক প্রতিবন্ধী সেন্টারে। মাকে ফেলে আসার ফলে আশা ভীষণ একাকীত্ব বোধ করে। বাড়িতে প্রতিদিনই বাথরুম যেতে হলে মাকে নিয়ে যেতে হতো। এখানে তার মা নেই, তাকে সাহায্য করারও কেউ নেই। মাকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট ও চেপে রাখা হিসু মিলে মিশে এক হয়ে যায় ছবি আঁকার মাধ্যমে। ডগর ভালো ভাবে ফুটিয়েও তুলেছে এই কঠিন দৃশ্যটি।
এই দৃশ্যটি তুলতে সময় লাগলো ৫ মাস। কারণ এই দৃশ্যটি বোঝার মতো কাউকেই পেলাম না আমার টিমের মধ্যে। একটা সময় প্রতিবাদ উঠলো এবং কি করে কাজ বন্ধ রাখা যায় তার সব চেষ্টাই করলো টিমের কেউ কেউ। অবশেষে টিমের কিছু সদস্যদের এবং প্রযোজক এর সহযোগিতায় মাস পাঁচেক বাদে প্যাচওয়ার্কটি করা সম্ভব হয়। পরিচালক ও প্রযোজক চাইছে কাজটি হোক দ্রুত, অভিনেত্রীরও কোনো আপত্তি নেই কাজটি করতে। কিন্তু কিছু মানুষের ধারণা হল এই দৃশ্যর মধ্যে দিয়ে নাকি নুডিটি প্রকাশ পাবে। ভাবুন একবার। যাই হোক সিনটি যেভাবে ভেবে ছিলাম তার ৩০ শতাংশ করতে পারলাম। কিন্তু আমারও প্রতিজ্ঞা এটা না হলে ছবিটা রিলিজই করতাম না। আমার প্রযোজক কৃষ্ণ কল্যাণী আমাকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার কাছে আমি ঋণী। তিনি আদিবাসীদের জন্য যে রকম অর্থ ব্যয় করছেন যা নজিরবিহীন।
ডগর প্রানবন্ত অভিনয় করেছে। টোটাল টিমকে নিয়ে যেদিন ওয়ার্কশপ করি সেদিনই ডগরকে বলি “এতদিন যে ধরণের অভিনয় করেছ এটা সম্পূর্ণ আলাদা। তোমাকে এই ছবি আলাদা জায়গায় পৌঁছে দেবে।” ওকে যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছি তার থেকে অনেক বেশী হাতটা বাকিয়ে মুখটা বাকিয়ে অভিনয় করেছে। শুটিং করতে করতে ওর হাতে শিরায় শিরায় টান ধরে যেতো। অনেক ক্ষণ ম্যাসাজ করার পর ঠিক হত। শটের পর মেকাপ ম্যান অভিক এই ম্যাসাজের কাজটা করত। বড় বড় অভিনেত্রীও এই কাজ এত সময় ধরে হয়তো করতে পারবেন না। যেভাবে সিকুয়েন্সগুলো সাজিয়েছিলাম তাতে ওর পক্ষে কাজ করা অনেক সহজ হয়েছিল। ভাল কাজ করেছে আশার মা এবং বাবার ভুমিকায় মেনকা টুডু ও কৃষ্ণ মার্ডিও। আরও কয়েকজনের কথা না বললেই নয় যাদের সরাসরি অবদান রয়েছে আশার সাফল্যের পিছনে। সৈকত দত্তরায় (চিত্রগ্রাহক), শ্রাবণ রায় (স্ক্রিপ্ট), রাজমোহন শোরেন(সম্পাদক), অনুপ মন্ডল (সহকারী পরিচালক), সাজেন হাঁসদা (সহযোগী পরিচালক), দেবজিৎ দাস (সঙ্গীত), উজ্জ্বল কিস্কু ( আবহ সঙ্গীত), মাধাই সরকার( শিল্প নির্দেশক)। রাধা হেম্ব্রম ( কণ্ঠ), সুজয় মিশ্র। এরা সকলেই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
ছবিটার গল্প পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমি বেশ কিছু জিনিস ভাবতে শুরু করলাম – ছবির প্রধান চরিত্র হবে সিম্বলিক। কেননা প্রধান চরিত্র আশা পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতিনিধি। পিছিয়ে পড়া মানুষকে আমার সবাই তাদের নিচু ভাবেই দেখি । তাদেরকে যদি একটু সুযোগ সুবিধে করে দেওয়া যায়, তাহলে সমাজে তারাও কিছু করে দেখাতে পারে। আমার কাছে আনন্দের কথা এই যে, বিভিন্ন সমস্যা, বাধা, অসুবিধা স্বত্বেও আমরা সকলেই এই ছবিটি শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছি। সকলের পরিশ্রম এবং মেধার ফসল “আশা” কিন্তু আমাদের আশা পূর্ণ করেছে। পূর্ণ করেছে দর্শক এবং সমালোচকদের আশাও। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আমার প্রথম সাঁওতালি ছবির আত্মপ্রকাশ “আশা” ছবিতেই। এই ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডগর টুডু। নয়ডায় , ১২তম দাদা সাহেব ফালকে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নিয়েছেন পুরুলিয়ার মেয়ে ডগর। ছবিটি প্রশংসা কুড়িয়েছে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবেও। আশা ছবির সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলিদের সকলেই তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুফল পেয়ে খুব আনন্দিত। আমরাও আনন্দিত দর্শকদের একটা ভাল ছবি উপহার দিতে পেরে।