বাঙালির গান (পর্ব ২)

পার্থসারথী সরকার ##

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন:

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাঁকিল্যা গ্রাম নিবাসী বৈষ্ণব সাধক শ্রীনিবাস আচর্যের দৌহিত্র বংশীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গৃহের গো-শালা থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র পুঁথি আবিষ্কার বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। বসন্তরঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ কর্তৃক এই পুঁথি সম্পাদিত হয় ও ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাম নিয়ে। প্রকাশকালে পুঁথি খন্ডিত হওয়ায় বসন্তরঞ্জন লোকবিশ্বাসকে মান্যতা নিয়ে পুঁথির নামকরণ করেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ । তথাপি পুঁথিমধ্যে প্রাপ্ত চিরকুটে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ নামটি থাকাতে মতভেদ তৈরী হয় এবং অনেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামের বিরোধিতা করেন। যদিও পরবর্তীতেও এই নাম বহাল থাকে এবং এই গ্রন্থের পুঁথির অন্য কোন নিদর্শন না পাওয়া পর্যন্ত সম্পাদককৃত নামেরই মান্যতা থাকবে ব’লে আশা করা যায়। এই কাব্যের ভূমিকায়  চণ্ডীদাস, বড়ু চন্ডীদাস, অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস ইত্যাদি ভনিতা পাওয়া গেলেও বড়ু চন্ডীদাস ভনিতাটি সর্বাধিকবার (২৯৮) এসেছে এবং কবি হিসাবে বড়ুই সর্বাধিক মান্যতা পেয়েছেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র মধ্যে প্রাপ্ত চিরকুটটি ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দের। পুঁথির রচনাকাল হিসাবে ১৪০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যের সময়কালকেই চিহ্নিত করেছেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. রাধাগোবিন্দ বসাক। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পুঁথির হরফ পরীক্ষা করে মত দেন সেই হরফ খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর বা তারো আগের।

       ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে ‘নাট্যগীতপাঞ্চালী’ (অর্থাৎ পুতুল নাচ ও অনুষঙ্গী গীত) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন ড. সুকুমার সেন তাঁর ‘নট-নাট্য-নাটক’ গ্রন্থে। এই কাব্যের মধ্যে ধ্বনিপ্রধান হয়ে উঠেছে ঠিকই তথাপি পাশাপাশি এর মধ্যে গীতিকবিতার সুর  অনুরণিত হয়ে চলেছে অন্তঃসলিলার মতো। কাব্যটির সামগ্রিক বিচার করলে দেখা যায়, কাব্যের শুরুর দিকে অনেকাংশে ঝুমুর-জাতীয় লোকসংগীতের প্রভাব অনিবার্যভাবে এসে পড়েছে এবং ক্রমে কাব্যকাহিনি যত এগিয়েছে সেক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তার সমস্ত নাটকীয় বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে গিয়ে ‘বংশীখন্ড’ এবং ‘রাধাবিরহে’র মধ্যে দিয়ে তা গীতিকবিতার মধ্যে লীন হয়ে গেছে—যেখান থেকে শুরু হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীর পথযাত্রা। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র শুরুর চরিত্রগুলি ক্রমশই কাব্যের শেষের দিকে গিয়ে তাদের দেবত্ব হারিয়ে  মানবিক ধর্মকে আশ্রয় করেছে। ভাবের আতিশয্য, উপমার ঘনঘটা, গ্রাম্যতা, স্থূল কামনার চিত্রণ—এ সবই শেষদিকে পরিত্যক্ত হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য চৈতন্যপূর্ববর্তী বলে সেখানে গৌড়ীয় নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব প্রভাব এসে পড়েনি এবং মানবিক আবেদন বৈষ্ণব তত্ত্বানুশাসনের কবলে পড়ে খর্ব হয়ে যায়নি। তবে ‘বংশীখণ্ডে’ ও ‘রাধাবিরহে’র পূর্বেও বেশ কিছু ক্ষেত্রেও গীতিরস এসে পড়েছে—দানখন্ডের ‘নীল জলদ সম কুন্তলভারা’, দানখণ্ডের ‘কাল ভ্রমরে কমলবন’ ইত্যাদি পদগুলির মধ্যেও সেই রসের হদিস পাওয়া যায়।

       ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মোট তেরোটি খণ্ডে বিভক্ত। এই খণ্ডগুলি হল—জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালিয়দমনখণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ। এই কাব্যের চরিত্র মূলত তিনটি—কৃষ্ণ, রাধা এবং  বড়াই। এই সংস্কৃত সাহিত্যের ত্রয়ী চরিত্রাশ্রিত ‘বীথী’- জাতিয় কাব্যনাট্যগোত্রীয়। এই তেরোটি খণ্ড এবং মূলত তিনটি চরিত্রের মধ্যে দিয়েই কাহিনিধারা আদ্যন্ত প্রবাহিত। কাব্যটির কাহিনি আংশিক পৌরাণিক ভিত্তির উপর দাঁড় করালেও মূলত লৌকিক কাহিনিকেই অবলম্বন করে তা নির্মিত হয়েছে। কাব্যের সূচনায় যে কংসবধের জন্য শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যে আগমন, তা সমগ্র কাব্য পাঠে বিস্মৃত হতে হয়। রূপের পন্থায় সম্ভোগ, নানা আছিলায় তার নিবৃত্তি এবং শেষে শ্রীরাধিকার হাহাকার। নাট্যধর্মিতা ও গীতিরসের চমৎকার সংমিশ্রণ রক্ষিত হয়েছে এখানে—আর এজন্যই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে ‘নাট্য গীতপাঞ্চালী’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন সমালোচক ড. সুকুমার সেন। তিনি এতে গীতের সঙ্গে ‘পাঞ্চালিকা’ বা পুতুলনাচের নৃত্যাভিনয়ের যোগ দেখিয়েছেন (বিশেষত কাব্যের ‘যমুনাখণ্ডে’)। সনাতন গোস্বামী ভাগবতের ১০.৩৩.৬৬ শ্লোকে কাব্যের অর্থ বিশ্লেষণে টীকা ‘বৈষ্ণবতোষণী’তে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দানখণ্ড নৌকাখণ্ড ইত্যাদির উল্লেখ আছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ চণ্ডীদাসের গীতের বা নাটক-গীতের উল্লিখিত হয়েছে। সে সময় সমাজে দানখণ্ড ও নৌকাখণ্ড জনপ্রিয় ছিল। মহাপ্রভু একাধিকবার দানখণ্ডের অভিনয় করেছিলেন এবং করিয়েছিলেন।

       ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ খানিকটা ঝুমুর জাতিয় গান। ঝুমুরে শৃঙ্গাররসের বাহুল্য থাকে। মধুর ও মৃদু এবং ছন্দাদির মাধ্যমে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম থাকে না। ঝুমুর একপ্রকার উক্তি প্রত্যুক্তিমূলক গান, যা চাপান-উতরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর সমর্থন করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র ‘বাহ্যগঠন’ ঝুমুরের মতো, তবে পুরোপুরি ঝুমুর গীতি নয়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র গীতি লক্ষণ সুস্পষ্ট, তবে সে গীত গৌণ, এবং এ কোন উৎকৃষ্ট গীতিকবিতাও নয়, এখানে ‘Personal intense emotion’ ব্যক্ত হয়েছে ‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি’র মতো পদের মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেন যে—কালিন্দীর কূলে গোঠে গোকুলে অবিরত যে বংশীধ্বনি হ’চ্ছে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে তা গোলক অভিমুখে আকর্ষণ করছে। বড়ু চণ্ডীদাস বাঙালিকে তার দূরাগত প্রতিধ্বনি শুনিয়ে দিয়েছেন। সেই বাঁশীর স্বরের কাছে সকল তত্ত্বকথা , সকল শাস্ত্রকথা মিলিয়ে যায়।

       তবে এ সকল মতামতের পাশাপাশি একথা স্বীকার করতেই হয় যে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ একটি সুষ্ঠু সাংগীতিক আদর্শকে সামনে রেখেই রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে বত্রিশ রাগের পরিচয় পাওয়া যায়। এই রাগগুলি হল—আহের, ককু, কুহু, কুহূ গুজ্জরী, কেদার, কোড়া, কোড়াদেশাগ, গুজ্জরী, দেশবরাড়ী, দেশাগ, ধানুষী, পটমঞ্জরী, পাহাড়ীআ, বঙ্গাল, বঙ্গালবরাড়ী, বরাড়ী, বসন্ত, বিভাস, বিভাসকহূ, বেলাবলী, ভাটিয়ালী, ভৈরবী, মল্লার, মালব, মালবশ্রী, মাহারঠা, রামগিরি, ললিত, শৌরী, শ্রী, শ্রী’রামগিরি ও সিন্ধোড়া। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ প্রযুক্ত পাহাড়ীআ বা পাহাড়ী রাগেই সর্বাধিক পদ রচিত হয়েছে। পাহাড়ীআ রাগে রচিত পদের সংখ্যা সাতান্নটি। এর পরে যথাক্রমে রামগিরি (৫৪), গুর্জরী (৩৯), কোড়া (৩৪), ধানুষী (৩২), দেশাগ (২৯), মালব (১৮), ভাটিয়ালী (১৭), মল্লার (১৪), দেশবড়ারী (১৩), বেলাবোলী (১১), আহের (১০), ভৈরবী (৮), শৌরী (৭), কুহূ (৭), কেদার (৬), বসন্ত (৬), বিভাস (৬), কুহূ গুজ্জরী (৫), ললিত (৫) , বরাড়ী (৪), মালবশ্রী (৪), মাহারঠা (৪), ও কোড়া দেশাগ (৪) এবং অবশিষ্ট রাগগুলিতে একটি করে পদ রচিত হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনাকার বড়ু চন্ডীদাস পূর্ববর্তী জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছেন। ‘গীতগোবিন্দে’ ব্যবহৃত কর্ণাট এবং গোণ্ডাকিরী ছাড়া আর সমস্ত রাগই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সেগুলি প্রথাগত-ভাবে প্রচলিত ছিল। গীতগোবিন্দের রামকিরি রাগই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রামগিরি রাগ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে চর্যাপদের বহু রাগ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত হয়েছে। এই রাগগুলির মধ্যে অন্যতম হল গুর্জরী, পটমঞ্জরী, বঙ্গাল, বরাড়ী, ভৈরবী ইত্যাদি। এছাড়া চর্যায় ব্যবহৃত কহ্নু গুঞ্জরী, দেশাখ, ধানসী এবং রামক্রী ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ সম্ভবত কহ্নু গুজ্জরী, দেশাগ এবং রামগিরি নাম লাভ করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাঢ় বাংলায় লিখিত ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ একটি রাগতালিকা পাওয়া যায়। এই রাগের অনেকগুলি চর্যাপদ-শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-গীতগোবিন্দের সঙ্গে মেলে। পুরাণোক্ত এই রাগরাগিণীগুলি হল—কামোদ, বসন্ত, মল্লার, বিভাস, গান্ধার, মায়ূরী, তোটিকা, গৌড়ী, বড়ারী, বিলোলিকা, ধানশ্রী, বাগীশ্বরী, শারদী, শ্যামা, বৃন্দাবনী, বৈজয়ন্তী, জয়ন্তী, পরজ, কেদারী, কল্যাণী, সিন্ধুরা, সুহা, অশ্বারূঢ়া, কর্ণাটী, শ্যামকেলী, দেবকেলী, মালিনী, কামকেলিকা, সম্ভাবতী, সম্বরা, হিল্লোল, নটী, সুরহট্টী, পাহাড়ী, চারুরূপিণী, নীলা, জয়জয়ন্তী, চক্রবাকী, চন্দ্রমুখী, রসিকা, বিলাসিকা, যামিনী, শ্যামঘটিকা, রামকেলি, ললিতা, কোরড়া, কৌমুদী, ভৈরবী, শর্বরী, তরঙ্গিণী, নাগিনী, কিশোরী, হেমভূষণা, কল্লোলিনী, ভীমনেত্রা, শ্রী, রূপবতী, গৌরী, ধানশী, মঙ্গল, গান্ধর্ব, পটমঞ্জরী, মঞ্জীরা, মহাপদ্মাবতী, বেলাবলী, গন্ধিনী, ভূপালি, গৌড়রাজ, উত্তরা,  পূর্বিকা, গুর্জরী, কালগুর্জরী, গোণ্ডকারী, মালা, দীপহস্তা, দীপবর্ণা, দীপকর্ণা, প্রদীপিকা, দীপাক্ষি, দীপবক্ত্রা, প্রদীপনাভ—মোট ৮১ টি রাগ। এই রগগুলির মধ্যে অধিকাংশ এখন লুপ্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রগের নাম পরিবর্তীত হয়েছে—রূপও বদলেছে। শৌরী রাগ আদতে গৌরী হওয়ার সম্ভবনা আছে। শর্বরীর অপভ্রংশ সাবেরী ইত্যাদি। মৃদঙ্গাদি আনদ্ধ বাদ্য তালের ক্ষেত্রেও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র তালের ভূমিকা আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত মৃদঙ্গের তাল শেখার একটি পুঁথিতে উল্লিখিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ প্রাপ্ত তালগুলি হল—ক্রীড়া, রূপকং, যতি, একতালী, লঘুশেখর, কুড়ুক ও আটতালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 3 =