সম্পাদকীয়, ডিসেম্বর ২০২২
দুপাশে অনুচ্চ পাহাড়, মাঝে সবুজ ক্ষেত। দুই একটা তাল গাছ আলের ধারে ধারে দাঁড়িয়ে এক পায়ে। সেই রকম একটা তাল গাছের ছায়ায় বসে চেঁচাচ্ছিল শিউলি মাড্ডি। কাছে গিয়ে বুঝলাম সে মাঠে কাজ করা তার স্বামীকে ডাকছে। খাবার সাজিয়ে বসে আছে কিন্তু সে বুড়ো কিছুতেই আসছে না। একটু ভাব জমালাম গিয়ে। তখনই জানলাম শিউলির স্বামী প্রভাত এই কয়েক কাটা জমিতে খুব কষ্ট করে ফসল ফলায়, বছরে এক দুবার হয়, জলের বড় অভাব। দুই ছেলে আছে, কিন্তু তারা মা বাবাকে দেখে না। বছর পঁচিশ আগে সামনের পাহাড়ে গাছ কাটতে গিয়ে পড়ে যায় শিউলি, কোমরে চোট লাগে, তার পর থেকে নিচের অংশটা অবশ তার। প্রভাত দুই একবার শহরে বড় হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করেছে বটে কিন্তু নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা বড় ঝক্কি, প্রচুর খরচ। সেই থেকে শিউলি বসেই থাকে। শিউলি বসে থাকে বলেই প্রভাত আর বসার সময়টুকু পায় না। বাড়িতে একা ভাল লাগেনা শিউলির, তাই প্রভাতের সঙ্গে এসে ক্ষেতের ধারেই বসে থাকে। দিনভর কথা বলে, গল্প করে তারা। আমাদের কথা হতে হতেই উঠে এল প্রভাত, ঘাম মুছে বসল পাশে। তারও বয়স ষাট ছুঁয়েছে কয়েক বছর আগেই, দেখে বোঝার উপায় নেই। আমাদের গল্পের মাঝেই যোগ দিল সেও। এদিকে পরম যত্নে খাবার বাড়ছে শিউলি, খাবার বলতে জলঢালা ভাত, একটা পেঁয়াজ আর একটু বেগুন পোড়া। আমার দিকে চাইতেই আমি খাব না জানিয়ে দিলাম। প্রভাতই জানাল বাড়িতে একা একা শিউলিকে রেখে এসে শান্তি পায় না। তাই মাঠেই নিয়ে চলে আসে, দিনভর দুজনে সামনাসামনি থাকে একে অপরের খোঁজ রাখতে পারে। তাছাড়া কাজের ফাঁকে একটু গল্প গুজব করলে পরিশ্রমটাও কম লাগে। বয়স হচ্ছে তো শরীর মাঝে মধ্যে বিশ্রাম চায়। দুজনের সঙ্গে গল্প করতে করতেই বেলা প্রায় তিনটে, আমি এবার ফিরব। প্রভাতও বলল তারাও এবার বাড়ি যাবে। আমি পা বাড়ালাম রাস্তার দিকে, প্রভাতও শিউলিকে কোলে তুলে এগোল ঘরের দিকে। হ্যা প্রায় দুই যুগ ধরে প্রভাতের কোলে চেপেই ঘোরে শিউলি, হুইল চেয়ার কেনার পয়সাও নেই, প্রয়োজনও পড়েনি বোধহয়। আচ্ছা প্রভাতকে কি একটুও সব্যসাচী বলা যায়?
এই গল্প পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার, এবারে আসি শহরের দিকে। বেশি দূরে যাব না, ঘরের থেকেই নজির টানি। আমার বাবা, মাকে বিয়ে করার আগেই জানতেন মায়ের দূরারোগ্য অসুখ আছে। এই অসুখ সারবার তো নয়ই, মায়ের আয়ুও অনিশ্চিৎ। তা স্বত্বেও তিনি আমার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মাকে বিয়ে করেন। জন্ম থেকে আমি দেখে আসছি আমার মা অসুস্থ। বাবা তার যত্ন করেন। মায়ের হাতে হাতে প্রায় সব কাজ বাবা করে দেন, এগিয়ে দেন। মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত বাবাকে কোনও দিন এক চিলতে বিরক্তি বা ক্লান্তি প্রকাশ করতে দেখিনি। বড় কোনও ঝগড়া তো দূরে থাক সাংসারিক মন কষাকষিও আমার এই দাম্পত্যে অদেখাই রয়ে গেল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার যত্নেই মা বেঁচেছিলেন এতগুলি দিন। এখন বড় হয়ে তাদের খুনসুটি, ভালবাসা, সেই পরস্পরকে বেঁধে রাখা প্রেমকে আমি অনুভব করতে পারি। বিয়ের আগে থেকে জীবনের শেষ দিন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মায়ের পাশে থেকেছে বাবা। আমিও সব সময় পারিনি, কাজের জন্য দূরে যেতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু নিশ্চিন্ত ছিলাম বাবা আছে, তার চেয়ে বেশি আর কেউ আমার মায়ের যত্ন করতে পারবে না। একটা রোগ সারবে না জেনেও সেই মানুষটিকে ভালবেসে বিয়ে করা, আমৃত্যু আগলে রাখা? আচ্ছা আমার বাবাকে কি সামন্য হলেও সব্যসাচী বলা যায়?
আসলে সেদিন একটা ফেসবুক পোস্ট দেখে এই লেখার কথা মাথায় এল। একটি মেয়ে তার একটি ছবি দিয়ে লিখেছে “কতটা পথ পার হলে একটা সব্যসাচী পাওয়া যায়?” সকলেই বুঝতে পারছেন সব্যসাচী বলতে এখানে সদ্য প্রয়াত ঐন্দ্রিলা শর্মার প্রেমিকের কথা বোঝানো হয়েছে। সব্যসাচীর ঐন্দ্রিলার পাশে আমৃত্যু থাকাটা এখন প্রেমের উদাহরণ। সেটা অনস্বীকার্যও নয়, সব্যসাচী প্রকৃত প্রেমিক, বন্ধু এবং সঙ্গীর কাজই করেছেন। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস তিনি নিশ্চয় উদাহরণ যোগ্য হয়ে উঠবেন বলে এই কাজ করেননি। আর পাঁচ জনের মতই ভালবাসার তাগিদে তিনি নিজের কাজটুকু করে গিয়েছেন। প্রেমের দুটি উদাহরণে একই সময়ে উত্তাল সংবাদ মাধ্যম। স্বাভাবিক ভাবে সেই স্রোতের মধ্যে পড়ে উত্তাল আমরাও। একটি দিল্লীতে শ্রদ্ধা এবং আফতাবের উদাহরণ। যেখানে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে মেরে, টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে দেয়। অন্য দিকে ঐন্দ্রিলা ও সব্যসাচী, যেখানে প্রেমিক তার ভালবাসার মানুষটিকে মৃত্যুর কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে গিয়েছে। দুটি বিপরীতমুখী উদাহরণ মানুষকেও কিছুটা দ্বিধায় ফেলেছে বৈকি। তবু তার মাঝে কিছুটা হলেও আলোচনা, চর্চা, ইতিবাচক অনুভুতিতে কয়েকগুণ এগিয়ে গিয়েছে সব্যসাচী ঐন্দ্রিলার প্রেম। একই সময়ে আরও একটা প্রেম মিডিয়ার নজরে সেভাবে আসেনি, প্রেমিকার মৃত্যুর পরে তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে অসমের এক যুবক। ঘোষণা করেছে সেদিন থেকে সে বিপত্নীক, আর বিবাহের প্রশ্নই ওঠে না। সেই যুবক অথবা সব্যসাচী ভবিষ্যতে কি করবেন তা আমরা জানি না, তারা যে কাজ করেছেন সেটা সঠিক মনে হয়েছে তাদের কাছে।
আসলে ফেসবুক পোস্টে ওই অচেনা মেয়েটির এই প্রেম আর্তি দেখে আমার মনে হল আমাদের মাঝে প্রেম এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতে বসেছে বোধহয়। সেই কারণেই তো মিডিয়া চিৎকার করে সব্যসাচীকে মহান করে তোলবার চেষ্টা করে, কেউ কেউ সায় দেয়। কিন্তু মিডিয়ার সেই হইচই থেকে সরে গিয়ে একটু ভাবুন তো সব্যসাচীর উদাহরণ আমাদের পাশে কিন্তু এখনও আছে। প্রেমহীনতার নজির এখন একটু বেশিই হয়তো, কিন্তু প্রেমের সুস্থতার উদাহরণও তো আছে। সংবাদ মাধ্যম একটা ইস্যু নিয়ে হয়তো বেশি সোচ্চার হয়। সব ঘটনা সামনে আসে না। হিংসা, বিচ্ছেদ, অস্থিরতার মাঝেও কিন্তু এটাই প্রমাণ করে আজও মানুষ প্রেম নিয়ে বাঁচতে চায়। এখনও তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে আমাদের মধ্যেই জেগে থাকে একাধিক সব্যসাচী। তাদের ঘিরেই তো বাঁচার স্বপ্ন দেখে অসংখ্য ঐন্দ্রিলা।
ভাল থাকবেন সকলে। আবার কথা হবে আগামী সংখ্যায়। সকলের জন্য বড়দিন এবং আগামী নববর্ষের শুভেচ্ছা এবং ভালবাসা রইল।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক
অবেক্ষণ