ভাল নেই পাথরার ইয়াসিন
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
ভাল নেই ইয়াসিন পাঠান। হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছেন তিনি। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারনে সেভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তাই সকলের কাছেই সাহায্যের আশা করছেন তিনি। বাংলার শিক্ষিত, ইতিহাসপ্রিয় এবং ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ইয়াসিন পাঠান সম্পর্কে খুব ভাল করেই জানেন। যারা জানেন না তাদের জন্য ইয়াসিন পাঠান সম্পর্কে সংক্ষেপে জানিয়ে দিই একবার।
কংসাবতির ধারে পশ্চিম মেদিনীপুরের এক মন্দিরময় গ্রাম পাথরা। পাথরায় গুপ্ত যুগ থেকেই হিন্দু জৈন আর বৌদ্ধরা বাস করে আসছেন। ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর নানা প্রত্নচিহ্ন আবিস্কার হয়েছে এই গ্রামে। বাংলা সন ১৭৩২। নবাব আলীবর্দি খাঁ রত্নচক পরগণায় তহশীলদার করে পাঠান বিদ্যানন্দ ঘোষাল নামে এক ব্রাহ্মণকে। বিদ্যানন্দ জমিদারি পেয়ে প্রচুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। পরবর্তীতে এই মন্দির বা প্রত্নচিহ্নগুলি সংরক্ষণে অবিশ্বাস্য ভূমিকা নিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াসিন পাঠান। তাঁর প্রায় একার চেষ্টায় শুরু হয় মন্দির বাঁচানোর কাজ। নিজে ভিন ধর্মের মানুষ হয়েও ইয়াসিন লড়ে গিয়েছেন। পরে তাঁর পাশে দাঁড়ান স্থানীয় মানুষজন। ১৯৭১ এ শুরু হয় তাঁর মন্দির বাঁচাও আন্দোলন। ২০০৩ এ ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করে মন্দিরগুলি। মাত্র ৮টি বাদে বাকি মন্দিরগুলিতে কেউ আর পুজো দিতেও আসে না। এখন মাত্র ৩৪টি মন্দির টিকে আছে। ২৮ টি মন্দির পুনর্নিমান করা হয়েছে। অনন্য টেরাকোটার কাজ ও বাংলা ঘরানার গঠনশৈলী সম্পন্ন মন্দিরগুলি, যাতে ইসলামি স্থাপত্যেরও ছোঁয়া, এখন শুধু পাথরা নয় সারা দেশের গর্ব।
১৯৯৩ সালে ইয়াসিন পাঠান তার অভিজ্ঞতার নিরিখে একটি বই লেখেন, যা ‘মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটি সর্বশেষ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তার এই কর্মকাণ্ড ও অবদানের জন্য ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ শঙ্কর দয়াল শর্মা তাকে সন্ত কবির পুরস্কারে ভূষিত করেন। এই সন্ত কবির পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গের আর কোন ব্যক্তি এখনও পাননি।
ইয়াসিন পাঠানের নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্যাগের ফলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রণব মুখার্জী ২০ লাখ টাকা প্রদান করেন পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটিকে। এর ফলে সংরক্ষণের কাজে গতি বৃদ্ধি ঘটে এবং সর্বশেষ ২০০৩ সালে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ পাথরায় ৩৪ টি মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেন এবং সংরক্ষণ পক্রিয়া শুরু করেন।
ইয়াসিন পাঠানের এই অসামান্য অবদানে পাথরা আজ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পর্যটন কেন্দ্ররূপে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ইতিহাস মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। সারা বছর ধরে ভ্রমণ পিপাষু মানুষ পাথরায় ঘুরতে আসেন ও সরেজমিনে উপলব্ধি করেন পাথরার ইতিহাস ও ইয়াসিন পাঠানের দীর্ঘ সংগ্রাম। কিন্তু সেই ইয়ায়াসিন আজ রোগ শয্যায় কাতর। আর্থিক কারনে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। শুধু তাই নয় যে সমস্ত কৃষকের জমি ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করেছিল মন্দির নেওয়ার সময়, সেই কৃষকদের ক্ষতিপূরণ এখনও দেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ। এখন সেই কৃষকেরা ইয়ায়াসিনকেই দুষছেন। জীবনে এমন একটা ভাল কাজ করেও অন্যের অভিশাপ বইতে হচ্ছে বৃদ্ধ ইয়াসিন পাঠানকে। বহুবার এই নিয়ে দরবার করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু লাভ হয়নি। শেষ জীবনে এসে তাই হতাশ ইয়াসিন। রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি তার কবির সম্মান ফিরিয়ে দিতে চান। ইয়াসিন পাঠানের মত মানুষের শেষ জীবনে এমন পরিনতি কাম্য নয় মোটেই। এখন মানুষ অনেকটাই নিজের গণ্ডির বাইরে যেতে চান না। সেখানে ইয়াসিনের কথা শুনলে হয়তো অন্যের জন্য বা সমাজের উপকারে কোনও কাজ করবার মানুষেরই অভাব দেখা দেবে ভবিষ্যতে।